E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

আলো দেখে অন্ধকার পালাবেই

২০২৪ নভেম্বর ০৩ ১৭:২২:২৯
আলো দেখে অন্ধকার পালাবেই

গোপাল নাথ বাবুল


কোটা বিরোধী আন্দোলন হাইজ্যাক হওয়ার কারণে ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তন হয়। এরপর থেকে সারাদেশে আওয়ামী লীগ নিধনের পাশাপাশি হিন্দুদের ওপরও নির্মমতা নেমে আসে। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান জবর দখল, বাড়ি-ঘর আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত, সহায়-সম্পদ লুঠপাট, পুরুষদের পিটিয়ে খুন, মহিলাদের অত্যাচার-সহ হেন কোনো কর্ম নেই, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে হয়নি। যখন-তখন যেকোনো অজুহাতে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার নেমে আসে। বিনাকারণে এসব অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে করতে বাংলাদেশে হিন্দুদের পিঠ বর্তমানে দেয়ালে ঠেকে গেছে। এসব অত্যাচার-সহিংসতা থেকে বাঁচতে বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত এবং দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ হতে চেষ্টা করে। হিন্দুদের ওপর অসহনীয় ও অবর্ণনীয় অত্যাচার-অবিচার দেখে দেশের সম্মানিত সাধু-সন্ন্যাসীরাও আন্দোলনে যোগ দেন। ফলে সাধু-সন্ন্যাসীদের নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ’ নামে সনাতনীদের একটা প্লাটফরম গঠন করা হয়। যার প্রধান নায়ক ইসকনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক চন্দন কুমার ধর প্রকাশ প্রভূ শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী।  

প্রভূ শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ’ ৮ দফা দাবি নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে এবং অল্প সময়ের মধ্যে সারাদেশে আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে। ৮ দফা দাবিগুলো হলোঃ ১) সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দোষীদের দ্রুততম সময়ে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান, ক্ষতিগ্রস্তদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ২) অনতিবিলম্বে ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে। ৩) ‘সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ গঠন করতে হবে। ৪) হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে হি্ন্দু ফাউন্ডেশনে উন্নীত করতে হবে। পাশাপাশি বৌদ্ধ ও খৃষ্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকেও ফাউন্ডেশনে উন্নীত করতে হবে। ৫) ‘দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন’ প্রণয়ন এবং ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন’ যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। ৬) প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘুদের জন্য উপসনালয় নির্মাণ এবং প্রতিটি হোস্টেলে প্রার্থনাকক্ষ বরাদ্দ করতে হবে। ৭) ‘সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড’ আধুনিকায়ন করতে হবে। ৮) শারদীয় দূর্গাপূজোয় ৫ দিন ছুটি ঘোষণা দিতে হবে।

গত ২৫ অক্টোবর ৮ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বীর চট্টলার ঐতিহাসিক লালদিঘী ময়দানে ‘বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ’র উদ্যোগে সনাতনীদের এক বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম হয়। ১৯৮৮ সালে সামরিক সরকার জেনারেল এইচ এম এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা দিলে তখনকার সময়ে সদ্য গঠিত হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে ঐতিহাসিক লালদিঘী ময়দানে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ব্যক্তিত্ব ও সংসদ সদস্য স্বর্গীয় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সেই জনসভায়ও লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়েছিল। উক্ত জনসভার পরে এটাই ছিল সনাতনীদের সবচেয়ে বড় জনসমাবেশ। ২৫ অক্টোবরের সনাতনীদের লালদিঘীর জনসমাবেশ দেখে সরকারের টনক নড়ে। হয়তো সরকার ভাবেনি যে, সনাতনীরা এভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন। আয়োজকরাও ভাবেননি, সমাবেশে এতো জনসমাগম হবে।

এই সমাবেশ নিয়ে দেশ-বিদেশে বিস্তর আলোচনা হয়। ফলে সংখ্যাগুরুদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর একটা গ্রুপ তৈরি করে। গ্রুপটি হিন্দুদের ঐক্যে প্রতিহিংসাপরায়ণ ও ভীত হয়। ফলে গ্রুপটি ঐক্যবদ্ধ সনাতনীদের ঐক্য ভাঙ্গার প্রচেষ্টা চালায়। ইসকনের চট্টগ্রাম জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক প্রভূ শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী যেহেতু ‘বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ’র নেতৃত্বে প্রধান ভূমিকা পালন করছেন, সেহেতু তিনি এবং ইসকনকে গ্রুপটি টার্গেট করে। তার অংশ হিসেবে ইসকনের সমালোচনা করে ‘আমার দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সম্প্রতি একটা প্রতিহিংসামূলক, সাম্প্রদায়িক ও উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। যে বক্তব্যে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘সাহস হয় কীভাবে ইসকনের মতো একটা সাম্প্রদায়িক ও ‘র’ এর সংগঠন চট্টগ্রামে সভা করে?

এখন প্রশ্ন হলো, ইসকন যে সাম্প্রদায়িক এবং ‘র’ এর সংগঠন, এই তথ্য তিনি কোথায় পেলেন? কোন সূত্র থেকে তিনি এসব বাক্যগুলো বললেন? তিনি প্রমাণ দিতে পারবেন, ইসকন যে ‘র’ এর সংগঠন? ইসকন কী কোথাও বোমা হামলা করেছে? ইসকন কী কখনো এমন কোনো উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছে, যেজন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা সহিংসতা হয়েছে? তিনি কী কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবেন, আল কায়েদা, তালেবান, বোকা হারাম কিংবা আইসিস-এর মতো ইসকন বোমা হামলা বা গ্রেনেড বিস্ফোরণ কিংবা ব্রাশফায়ার করে নিরাপরাধ নারী, শিশু-সহ হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে? বাংলাদেশ কেন, সারাবিশ্বের কোনো দেশ কী ইসকনের নামে এমন কোনো তথ্য দিয়েছে, যেজন্য কোনো সম্প্রদায় বা জাতি অথবা দেশের মহাক্ষতি হয়েছে? আসলে সাম্প্রদায়িক উস্কানি এবং ব্রেকছাড়া মুখের বুলি আওড়াতে আওড়াতে ওনার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। যদিও ওনার মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছে এমন উস্কানিমূলক বাক্য কোনোদিন আশা করিনি। একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে সবসময় দায়িত্ব নিয়েই কথা বলতে হয়।

ওনি আরও বলেছেন, চট্টগ্রামে সভা করতে হিন্দুদের সাহস হয় কীভাবে? কেন গো, হিন্দুদের কী সাহস থাকতে নেই? সাহস করার অধিকার কী শুধু আপনাদের আছে? হিন্দুরা কী এদেশের জনগণ নয়? হিন্দুদের আবার সভা করতে আপনার থেকে সাহস ধার করতে হবে কেন? হিন্দুরা হলো নম্র, ভদ্র ও শান্তপ্রিয় সম্প্রদায়। সহজে ঝামেলায় জড়াতে চান না। ঝামেলা সবসময এড়িয়ে চলেন। এজন্য তারা প্রয়োজনে সহায়-সম্পদ ও চৌদ্দ পুরুষের বাড়ি-ভিটা-মাটি ত্যাগ করে নীরবে ওপার বাংলায় গিয়ে কষ্টকর শরণার্থী জীবন বেছে নেন। তারপরও তারা শান্তিতে থাকতে চান। কিন্তু অত্যাচার সহ্য করতে করতে হিন্দুদের পিঠ যে দেয়ালে ঠেকে গেছে, তাই তারা রুখে দাঁড়িয়েছেন। হিন্দুদের একেবারে এতো ফেলনা মনে করবেন না। হিন্দুরা অন্য কোনো দেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেননি। এদেশে যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় বাস করে আসছেন। যদি প্রমাণ দেখতে চান, তাহলে প্রতিটি হিন্দু কমপক্ষে তার ৭ পুরুষের বংশ তালিকা দেখাতে পারবেন। কারণ, তারা (যাদের মা-বাবা গত হয়েছেন) প্রতিবছর অমরপক্ষে তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে ৭ পুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পনানুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। আমার তো ১৪ পুরুষের বংশ তালিকা রয়েছে। ‘সভা করতে হিন্দুদের সাহস কীভাবে হয়’ বলা ব্যক্তিটি তার কতজন পূর্বপুরুষের বংশ তালিকা দেখাতে পারবেন?

তিনি আরো বলেছেন, আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকতে নাকি হিন্দুরা ক্ষমতা দেখান, হিন্দুরা দ্বিতীয় সরকার হয়ে যান। তিনি কী আসলে জানেন না নাকি জেনেও না জানার ভান করছেন যে, হিন্দুরা আওয়ামীলীগ আমলেও কী পরিমাণ নির্যাতীত হয়েছিলেন? কক্সবাজারের রামু থেকে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভোলা, সুনামগঞ্জের শাল্লা হয়ে রংপুর, প্রভৃতি স্থানে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলোর কী দৃশ্যত কোনো বিচার হয়েছে? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রসরাজ একজন মাছ ব্যবসায়ী। যিনি ভালো করে ফেসবুকও চালাতে জানতেন না। তার মোবাইল হ্যাক করে যারা সাম্প্রদায়িক অঘটনটি ঘটিয়ে আদালতের তদন্তে অপরাধী সাব্যস্থ হয়েছিলেন, তারা কিন্তু বর্তমানে আরামসে শার্টের বুকের বোতাম খুলে দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া খাচ্ছে আর রসরাজ এখনো আদালতের ঘানি টানছেন। রামুর উত্তম বড়ুয়ার তো কোনো খবরও নেই। বেঁচে আছেন কী মরে গেছেন তাও কেউ জানেন না। অথচ সরকারের উচিত ছিল, তাঁর খোঁজ-খবর নেওয়া এবং সঠিক পরিস্থিতি তাঁর পরিবারকে জানানো।

গায়ের জোরে ও মুখের জোরে মাহমুদুর রহমান ইসকনকে সাম্প্রদায়িক ও ‘র’ এর সংগঠন বা এজেন্ট বানিয়ে দিলেন। অথচ ইসকন সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই নাকি তার স্বভাব অনুযায়ী উস্কানি দিয়ে ইসকনকে গণমানুষের কাছে কালার করছেন? ইসকন যদি ‘র’ এর সংগঠন বা এজেন্ট হয়, তাহলে সরকারের উচিত, সংস্থাটি সম্পর্কে তদন্ত করা এবং অপরাধী সাব্যস্থ হলে সংস্থাটিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। আর যদি অভিযোগকারীর অভিযোগ সঠিক বা প্রমাণিত না হয়, তাহলে সরকারের উচিত, অভিযোগকারীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং আইনগত শাস্তির ব্যবস্থা করা। কারণ, ইসকন সম্পর্কে তার উস্কানিমূলক বক্তব্যের জন্য দেশে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছে এবং একটি পক্ষ বরাবরের মতো সাম্প্রদায়িক হামলার সুযোগ নিতে পারে।

তাছাড়া, প্রভূ শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী ‘ইসকন’ নন, তিনি ‘ইসকন’র একজন প্রভূ মাত্র। ইসকন হলো মূলত একটি অরাজনৈতিক, মানবকল্যাণমূলক, সেবামূলক ও আধ্যাত্মিক সংগঠন। সারাবিশ্বে যার সংগঠন, কার্যালয় ও কার্যক্রম রয়েছে। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়া, এশিয়ার বিভিন্ন দেশ-সহ মুসলিম দেশগুলিতেও সংস্থাটির কার্যক্রম রয়েছে। মানুষের আপদে-বিপদে, বন্যা-সহ বিভিন্ন দুর্যোগে ইসকনের প্রতিটি প্রভূ ঝাঁপিয়ে পড়েন। সম্প্রতি বাংলাদেশের বন্যায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ইসকন বন্যার্তদের ত্রাণ বিতরণ করেছে। একটি ইসলামি সংগঠনকে দেখলাম, তারা হিন্দুদের কলেমা পড়িয়ে ত্রাণসামগ্রী দিচ্ছে। এমন কোনো অভিযোগও ইসকনের বিরুদ্ধে নেই। এই গুনটির জন্য ইসকন আজ সারাবিশ্বে সমাদৃত। বিশ্বে দিনদিন এই সংগঠনটির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আরবের যে দেশে ইসলামের জন্ম, সেই সৌদিআরবেও ইসকনের কার্যালয় ও কার্যক্রম রয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ইসকনের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছেন এবং আধ্যাত্মিকভাবে শান্তি অনুভব করছেন।

ইসকন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে। বিশ্ববিখ্যাত রগ সংগীত প্রতিষ্ঠান ‘বিটলস্’-এর প্রাণপুরুষ জর্জ হ্যারিসন তাঁর পৈত্রিক খৃষ্টান ধর্ম ত্যাগ করে ইসকনের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর আমেরিকার বাড়িটিও ইসকনকে দান করেছিলেন। ‘ইসকন’-এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল প্রভূপাদের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ও অর্থ সংগ্রহের জন্য পন্ডিত রবিশংকরকে নিয়ে জর্জ হ্যারিসন ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট আমেরিকার বিশ্ববিখ্যাত ‘ম্যাডিসন স্কোয়ার’-এ ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামক একটি কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন। সে কনসার্টে যোগদান করেছিলেন হাজার হাজার সংগীতপ্রিয় মানুষ। সেই কনসার্ট থেকে যে অর্থ সংগ্রহ হয়েছিল, তার সর্ম্পূর্ণই তিনি মুক্তিযুদ্ধ ফান্ডে জমা দিয়েছিলেন। আমেরিকার শিল্পপতি ও বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাতা ফোর্ড কোম্পানীর মালিক হেনরী ফোর্ড-এর প্রপৌত্র আলফ্রেড ফোর্ড ১৯৭৫ সালে খৃষ্টান ধর্ম ছেড়ে ইসকনের ছায়াতলে আশ্রয় নেন এবং শর্মিলা নামক এক ভারতীয়কে বিয়ে করে ভারতেই বসবাস করতে শুরু করেন। শুধু তাই নয়, তিনি ওইসময ইসকনের কার্যক্রম চালানোর জন্য ২৬০ কোটি ডলার ইসকনের ফান্ডে জমা দিয়েছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মন্দির নির্মাণেও তিনি উদারহস্তে দান করেন। মাহমুদুর রহমানের মতে, যদি ইসকন সাম্প্রদায়িক, ‘র’ এর এজেন্ট ও জঙ্গী সংগঠন হতো, তাহলে বিশ্ববিখ্যাত এই লোকগুলো কী ইসকনের ভক্ত হতেন?

মাহমুদুর রহমানের উস্কানিমূলক বক্তব্যে যে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে তার প্রমাণ, তার বক্তব্যের ২ দিন পর চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার মোহরার বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান জাতীয় পতাকার সাথে ‘বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ’র দলীয় পতাকা উত্তোলন করার ঠুনকো অজুহাতে প্রভূ শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী-সহ ‘বাসজাম’ এর ১৯ জন নেতা-কর্মীর নামে কোতোয়ালী থানায় একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেন। মামলার অন্যান্য আসামিরা হলেন, লীলারাজ দাস ব্রহ্মচারী (৪৮), অজয় দত্ত (৩৪), গোপাল দাশ টিপু (৩৮), কথক দাশ (৪০), প্রকৌশলী অমিত ধর (৩৮), রনি দাশ (৩৮), রাজীব দাশ (৩২), কৃষ্ণ কুমার দত্ত (৫২), জিকু চৌধুরী (৪০), নিউটন দে (৩৮), তুষার চক্রবর্তী (২৮), মিথুন দে (৩৫), রুপন ধর (৩৫), রিমন দত্ত (২৮), সুকান্ত দাশ (২৮), বিশ্বজিৎ গুপ্ত (৪২), রাজেশ চৌধুরী (২৮) ও হৃদয় দাস (২৫)। এদের মধ্যে রাজেশ ও হৃদয়কে গত বুধবার রাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

বাংলাদেশের প্রতিটি দল জাতীয় পতাকার পাশাপাশি দলীয় পতাকা উত্তোলন করে থাকে। বাদী গেরুয়া পতাকাটিকে ইসকনের ধর্মীয় পতাকা হিসেবে অবিহিত করেছেন। আসলে ওটা ইসকনের পতাকা নয়, ওটা ‘বাংলাদেশ সনাতন গণজাগরণ মঞ্চ’র দলীয় পতাকা। গেরুয়া একটি রঙ। তাই গেরুয়া হলেই যে এটা ধর্মীয় পতাকা হবে, তেমন কোনো লেখা কোনো ডিকশনারীতে নেই। বাদী একটি দলের পতাকাকে ইসকনের পতাকা বলে ভুল করেছেন। মামলা করার আগে বাদীর পতাকা সম্পর্কে ধারণ নেওয়া প্রয়োজন ছিল। আসলে ইসকনের চট্টগ্রাম জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক প্রভূ শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের হিন্দুরা আজ একই পতাকাতলে এসেছেন, একটি সংগঠনের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, এটাই হলো স্বার্থান্বেষী মহলের যন্ত্রণা ও মাথা ব্যাথার কারণ। এ ছাড়া আর কিছুই নয়। পতাকার বিষয়টি ওদের কাছে মূখ্য বিষয় নয়।

মামলার বাদী যদি এতই পতাকা প্রেমিক হতো কিংবা এতই দেশপ্রেমিক হতো, তাহলে কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময় যাচ্ছেতাইভাবে জাতীয় পতাকার অবমাননা হয়েছে। জাতীয় পতাকার ওপর দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছে। এমন শত শত ভিডিও ফেসবুক-সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। মাথার ওপর আইসিস-এর পতাকা, বুকের ওপর ফিলিস্থিনের পতাকা আর পায়ের নিচে আমাদের লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা। যে পতাকার জন্য ৩০ লক্ষ শহীদ এক সাগর রক্ত দিয়েছেন, যে পতাকার জন্য ২ লক্ষের ওপরে মা-বোন ইজ্জত দিয়েছেন, যে পতাকার জন্য এখনো হাজার হাজার যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পঙ্গুত্ব জীবন-যাপন করছেন। রাজধানীর ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা জঙ্গী সংগঠন আইসিস-এর পতাকা মাথার ওপর নিয়ে মিছিল করেছে। আমার পতাকা দরদী বাদী মহাশয় কী এসব দেখেননি? নাকি তখন চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন? দেখি, মামলার বাদী হিম্মত থাকলে এদের বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করুক? দেখি, তার কতটুকু ক্ষমতা? নিশ্চয় তিনি তা করবেন না। কারণ, জীবনের মায়া তো সবার আছে। হিন্দুদের বিরুদ্ধে মামলা করতে তার কোনো ভয় ছিল না। সত্যিকার অর্থে জাতীয় পতাকা অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করলে তার ঘাড়ের ওপর মাথা না থাকার সম্ভাবনা বেশি। তাই তিনি ওই রিস্ক নিয়ে বোকামি করবেন না।

বাদীর অভিযোগ, বিবাদীরা এমন কর্মটি করায় দেশমাতৃকা ও এর সার্বভৌমত্বের প্রতীক জাতীয় পতাকার ওপর বড় আঘাত, স্বাধীন রাষ্ট্রের অখন্ডতাকে অস্বীকারের শামিল, দেশের ভিতর অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেশকে অকার্যকর করা, রাষ্ট্রদ্রোহের কাজে লিপ্ত থাকা, সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে শ্রেণি বিদ্বেষের জন্ম দেওয়ার শামিল।

আবারও বিশ্বাস করলাম, জাতীয় পতাকার প্রতি বাদীর অসম্ভব প্রেম, গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান রয়েছে। তাহলে বাদীর প্রতি একটি প্রশ্ন, কেউ কেউ যখন জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা পাল্টাতে বলেছেন, যখন কোনো অবুঝ উপদেষ্টা একাত্তর নিয়ে, জাতির পিতা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, পাকিস্তানের ধারায় ফিরে যাওয়ার মানসিকতা দেখিয়েছিলেন, প্রকাশ্যে শ্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান’, তখন দেশমাতৃকা ও এর সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হয়নি? যখন মাথার ওপর আইসিস-এর পতাকা এবং পায়ের নিচে লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা রেখেছিল, তখন সার্বভৌমত্বর প্রতীক জাতীয় পতাকার ওপর বড় আঘাত, রাষ্ট্রদ্রোহ, রাষ্ট্রের অখন্ডতাকে অস্বীকারের শামিল বলে গণ্য হয়নি? মাহমুদুর রহমান সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক যে বক্তব্য রেখেছেন, তা কী শ্রেণি বিদ্বেষ ছড়ায় নি? শ্রেণি বিদ্বেষ ছড়িয়েছে বলেই তো আপনি জাতীয় পতাকা অবমাননার ঠুনকো অজুহাত দেখিয়ে হিন্দুদের নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেছেন। তাহলে ওনার নামে একটি মামলা করা উচিত নয় কি? কিন্তু তা করবেন না। নরমপন্থী হিন্দু পেয়েছেন তো, তাই দৌঁড়ে মামলা করে দিয়েছেন।

পরিশেষে বলা যায়, আলো আর আঁধারের খেলা পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই চলে আসছে। ভোরের আলো যখন দ্যুতি ছড়ায়, তখন গভীর অন্ধকারও পালায়। তাই আলো আর আঁধার কখনো একসাথে থাকতে পারে না। এই দু’সময়ের অবস্থান সবসময় সাংঘর্ষিক। সারাবিশ্বে ইসকন যেভাবে আলো ছড়াচ্ছে, সেখানে অন্ধকার তো নস্যি মাত্র। আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি অনুরোধ থাকবে, সনাতনীদের ৮ দফা দাবি মেনে নিন। অন্যায়ভাবে কোনো দাবি করা হয়নি। এখানে সকল দাবিই ন্যায়সঙ্গত ও বাস্তবায়নযোগ্য।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৭ নভেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test