E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

সংস্কার প্রস্তাব

রাজনীতিবিদদের ব্রত হোক দেশের মানুষের কল্যাণ

২০২৪ অক্টোবর ৩০ ১৭:৪০:৩১
রাজনীতিবিদদের ব্রত হোক দেশের মানুষের কল্যাণ

আবদুল হামিদ মাহবুব


দুই হাজার চব্বিশ সালের জুলাই-আগস্ট মাস। কত শত প্রাণের বিনিময়, আর হাজার হাজার জনের পঙ্গুত্ববরণের মধ্য দিয়ে ছাত্র জনতার বিপ্লব বলুন, আর অভ্যুত্থান বলুন, সেটা হলো। এ থেকে কি বুঝা গেলো? বুঝলাম যারা ক্ষমতায় ছিলেন তাদের মধ্যে খাঁটি দেশপ্রেম ছিলো না, ছিলো না দেশের মানুষের প্রতি মমতা। তারা ক্ষমতা ধরে রাখা কিংবা টিকে থাকার জন্য যা ইচ্ছা তাই করেছেন। ছোট করে বললে এভাবেও কথাটা বলা যায়, ক্ষমতার রাজনৈতিক ব্যক্তিরা দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করেননি। তাদের সকল কাজ ছিলো দলপ্রেম, নিজপ্রেম (ব্যক্তি) আর স্বজনপ্রেম নিয়ে।

এ কারণে তারা স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। কেনো তারা স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠলেন? কেনো তারা খাঁটি দেশপ্রেমিক হয়ে উঠলেন না? কেবল কি এই বিগতদের কর্মকান্ডেই আমি দেশপ্রেমহীনতা বলবো?

-না আমি কেবল এই বিগতদের কথাই বলবো না। আমার উপলব্ধি (ভুলও হতে পারে) অতীতেররাও এমনই ছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, যেইসব রাজনৈতিক দল কিংবা দলসমূহ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন তাদের মধ্যেও দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি প্রেম থেকে বেশি মাত্রায় ছিলো, দলপ্রেম, নিজপ্রেম আর আত্মীয় স্বজনের প্রেম।

তা হলে করতে হবে কি? এই প্রশ্নের খুব ছোট জবাব হচ্ছে, দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি লোক দেখানো প্রেম নয়, সত্যিকারের দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। দেশের সব মানুষ গড়ে উঠবে দেশপ্রেমিক হয়ে। দল থাকবে। সকল দল মিলে সরকার গঠণ হবে। দেশ শাসন বলুন, আর পরিচালনা বলুন, সকল দল মিলে সেটা করবে। সবার উপরে থাকবে দেশ। আর সবার অন্তরে দেশের অবস্থান থাকবে সবচে উপরে।

এমন একটা সমাজ গঠণ করতে হবে। যে সমাজে নিজের স্বার্থ, দলের স্বার্থ, স্বজনের স্বার্থ প্রাধান্য পাবে না। প্রাধান্য পাবে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ। সকল দলের চিন্তা থাকবে দেশের মানুষের কল্যাণ। আর এমন একটা ব্যবস্থা তৈরী করতে পরলেই দেশের উন্নয়নের সাথে দেশের মানুষের উন্নয়ন হবে। সেই পুরোনো আমলের রাজনীতিবিদদের মতো নতুন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের ব্রত হোক দেশের মানুষের কল্যাণ। সেই রাজনীতিবিদ চাই; যারা খদ্দরের পাঞ্জাবি গায়ে পরে, কাঁধে একটি ঝোলা নিয়ে দেশ এবং মানুষের কল্যাণের জন্য সারাদেশ চষে বেড়াতেন। তাঁদের নিজেদের তেমন কোনো চাওয়া পাওয়া থাকতো না। সকল চাওয়া ছিলো দেশ ও দেশের মানুষের জন্য।

এমন কি সম্ভব? জানিনা, সম্ভব কি না। তবে আশা করতে দোষ কি? আমি এমনই আশা নিয়ে একটা স্বপ্নের কথা বলতে চাচ্ছি। এই কারণে বলতে চাচ্ছি যে, জুলাই অভ্যুত্থানে পাওয়া ‘নতুন বাংলাদেশে’ আওয়াজ উঠেছে সংস্কারের। সংস্কার সকল ক্ষেত্রের মতো রাজনীতির মাঠ ও রাজনীতিবিদদের মননেও ঘটুক। খাঁটি দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা উঠে আসুক। তারা দেশের নেতৃত্ব নিক।

আমার স্বপ্নের কথাটা এরকম: এমন যদি একটা ব্যবস্থা আমরা উদ্ভাবন করতে পারি যে, সকল সময় সব মত, সব পথের মানুষ নিয়ে দেশ পরিচালিত হবে। আমি বলতে চাইছি অনেকগুলো দল দেশে থাকবে। তবে দেশ পরিচালনা করবে সব দল মিলে। যে যেই দল করুন, সেটা তিনি করতে পারবেন। তার দলের নীতি আদর্শ মানুষের মধ্যে প্রচার করবেন। দেশের মানুষকে নীতি আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে নিজের দলে টানবেন। দেশের মানুষের মঙ্গল হবে এমন কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচন করবেন। নির্বাচনে কোনো দল বেশি আসন পাবে, কোনো দল কম আসন পাবে। এমনই হবে। কিন্তু দেশ পরিচালনায় বেশি আসন প্রাপ্ত দলের সংসদ সদস্যরা যেমন থাকবেন, কম আসন প্রাপ্ত দলের সংসদ সদস্যরাও থাকবেন। হোক সে দল জাতীয়তাবাদী, চেতনাবাদী, উদারপন্থী, অনুদারপন্থী, ডানপন্থী, বামপস্থী, পাহাড়ী, ইসলামিক, হিন্দুত্ববাদী, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টানের দল।

সংসদ সদস্য সবাই হবেন সরকারী দল, আবার সবাই বিরোধী দলও। অর্থাৎ দেশ পরিচালনায় কোনো ব্যত্যয় দেখলে কম আসন প্রাপ্ত দলের সংসদ সদস্যরা যেমন বিরোধীতা করতে পারবেন, তেমনি বেশি সংসদ সদস্য নিয়ে যারা সংসদে এসেছে তাদের দলের সংসদ সদস্যরাও বিরোধীতা করতে পারবেন। সংসদে বেশি সংসদ সদস্য নিয়ে আসা দলের সংসদ সদস্যরা কোনো প্রস্তাবে কিংবা বিলে বিরোধীতা করে ভোট দিলে তার সংসদ পদ বাতিল হবে না। কম সংসদ সদস্য নিয়ে সংসদে আসা দলের সংসদ সদস্যরা প্রস্তাব কিংবা বিলে পক্ষে ভোট দিলে তিনি যে দলের হয়ে নির্বাচিত হয়েছেন সেই দল তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারবেন সবাই। যার যার দল তাদের নিজের দলের মধ্যে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটিয়ে নিজেদের মতো শৃংখলা বজায় রাখবেন।

মন্ত্রী পরিষদ গঠণ হবে; সংসদে যে দল যত সংখ্যক আসন পাবে, তার রেশিও অনুযায়ী। সংসদ সদস্যরাই মন্ত্রী পরিষদে অংশ গ্রহণ করবেন। কোনো দলের দশজন, কোনো দলের সাত জন, কোনো দলের একজনও থাকতে পারেন। মন্ত্রীত্ব পাবার রেশিও অনুযায়ী কোনো দল সংসদে আসন নাও পেতে পারেন। সেই দলকেও মন্ত্রী পরিষদের বাইরে রেখে কোনো দায়িত্ব দিয়ে দেশসেবার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। আর যাদের দল সংসদে কোনো আসনই পাবে না, তারা জনগণের কাছে ভালো ভালো কর্মসূচি নিয়ে থাকবে। আগামীতে যাতে জনগণ তাদের নির্বাচিত করে সংসদে পাঠায়। তবে এটা কোয়ালিশন কিংবা জাতীয় সরকার, এমন ধরনের হবে না। সকল দলের মিলিত দেশপ্রেমিক সরকার হবে। এটা একবার দু’বারের জন্য নয়। সংবিধানে বিধান করে সকল সময়ের জন্য।

তবে নির্বাচিত সকল দলের সংসদ সদস্যদের মধ্যের যোগ্যদেরে নিয়েই মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হবে। দলগুলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত করবে তাদের দলের কে বা কারা মন্ত্রী পরিষদে যাবে। তবে মন্ত্রিত্বে আসা সেই ব্যক্তিকে অবশ্যই জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হতে হবে। মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা তাদেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন প্রধানমন্ত্রী নির্ধারণ করবেন। সেটা কণ্ঠ ভোট কিংবা গোপন ভোটের মাধ্যমে হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য একাধিক প্রার্থী হবেন। যিনি মন্ত্রীদের দেওয়া ভোটের মধ্যে বেশি ভোট পাবেন তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীত্ব করার জন্য একাধিকজন নিয়ে প্যানেলও গঠন করে রাখা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী তার বিবেচনায় কে কোন মন্ত্রণালয়ে ভালো করবেন সে অনুযায়ী মন্ত্রীদের দায়িত্ব দেবেন।

ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সিতে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অবস্থান আগের মতোই রাখা যেতে পারে। তবে মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যরা আলাদা কোনো সুযোগসুবিধা পাবেন না। একজন সাধারণ মানুষের সংবিধান অনুযায়ী যে সুযোগ থাকবে, তারাও সেই সুযোগই পাবেন। মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যদের মোটা কোনো বেতন নয়, কেবলমাত্র সম্মানজনক একটি ভাতা রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাবেন। অর্থাৎ রাজনীতি ও দেশ পরিচালনাকে কোনো অবস্থাতেই লাভজনক পেশায় পরিণত করা যাবে না। যারা রাজনীতি করবেন তারা দেশ সেবার জন্য করবেন। রাজনীতিবিদদের অন্য পেশা থাকতে পারে। কিন্তু তিনি দলীয় কোনো পদ নিয়ে তার সেই পেশার আয় উন্নতি করবেন, সেটা হতে পারবে না।
আমি খুব সংক্ষেপে আমার স্বপ্ন, তথা মনের কথা বললাম। আমাদের সংবিধান যদি এইরূপ সরকার গঠণের আলোকে সংস্কার করা হয়, তবে আমি মনে করি রাজনীতিবিদরা অসৎ হবার কোনো সুযোগই থাকবে না। একই ভাবে ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদের কাঠামোও হতে পারে।

দেশ পরিচালনার এই সিস্টেম চালু করার পর, দেশের মানুষ মূল্যায়ন করবে কোন দলের কোন নেতা কিংবা কোন মন্ত্রী ভালো করেছেন। আবার এটাও মূল্যায়ন করবে কোন দলের কোন মন্ত্রীরা খারাপ করেছেন। এমন মূল্যায়নে পরবর্তী ভোটে দেশের মানুষ কম আসনপ্রাপ্ত দলগুলোকে আরো বেশি ভোট দিয়ে বেশি আসন দিতে পারে। আবার বেশি আসনপ্রাপ্তরা তাদের ভালো কাজের জন্য আরো বেশি আসন পেতে পারে। আর খারাপ করলে উল্টোটা হবে।

আমার জানার পরিধি সীমিত। বিশ্বের কোনো দেশে এমন ব্যবস্থা আছে কি না, আমি জানি না। তবে আমি মনে করি, যে কোনো দেশে এমন ব্যবস্থা চালু করতে পারলে রাজনীতিটা সত্যিকারের মানুষের রাজনীতিতে পরিণত হবে। আমি চাই আমার দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে বিশ্বে নজীর স্থাপন হোক। তবে এটা আমি জানি, প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক অংশ গ্রহণমূলক ক্ষমতা ব্যবস্থার কথা। আমি সেই ব্যবস্থার কথা বলছি না। আমি বলছি সংসদীয় আসনপ্রাপ্তির অংশ গ্রহণের মাধ্যমে দেশপ্রেমিক সরকার গঠণ ব্যবস্থার কথা।

শেষ কথা বলি, দেশের রাজনীতিবিদরা যদি দেশপ্রেমিক ও সৎ হন, তবে দেশের প্রশাসনের কোথাও অসততা দূর্নীতি স্থান পাবে না। শিল্পপতি ব্যবসায়ীরাও সততার সাথে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করবেন। এই লেখা কয়েক হাজার শব্দের হতে পারতো। আমি পাঠকদের বিরক্তি এড়ানো ও সংশ্লিষ্ট সম্পাদকের প্রকাশের সুবিধার জন্য লেখার কলেবর বড় না করে সকল কথাই বলেছি খুব সংক্ষিপ্ত করে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার, সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব।

পাঠকের মতামত:

৩০ অক্টোবর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test