E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

সর্বধর্ম সমন্বয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতা

২০২৪ অক্টোবর ১৪ ১৭:০৫:১৯
সর্বধর্ম সমন্বয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতা

আবীর আহাদ


ধর্মীয় চিন্তার বৈপরীত্য থাকতেই পারে। কারণ, ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্ম। অপরদিকে কোনো ধর্ম স্রষ্টার সৃষ্টি- এমন কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। স্রষ্টার ধর্ম বলতে যদি কোনো ধর্ম থাকতো তাহলে পৃথিবীতে এতো ধর্মের আবির্ভাব না ঘটে একটি মাত্র ধর্ম থাকতো। মূলত: মানুষই ধর্ম সৃষ্টি করেছে। আর মানুষ মাত্রই ভুল করে। সে-নিরিখে মানুষের সৃষ্ট ধর্মের  মধ্যে ভুল থাকতেই পারে। সে-জন্যে জ্ঞান ও বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়ে কে কোন ধর্ম পালন করবে কি করবে না সেটা যার যার নিজস্ব বিশ্বাসের বিষয়। তাই ধর্ম নিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাত হিংসা বিদ্বেষ ও জবরদস্তির কোনো স্থান নেই। এসব বিষয়ের প্রেক্ষিতে পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে : যার যার ধর্ম তার তার কাছে, ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। অনুরূপ কথা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের মধ্যেও রয়েছে। সুতরাং ধর্মকে কেন্দ্র করে জঙ্গিপনা বা অপরের ধর্মের ওপর আঘাত হেনে কারো ধর্মমত কারো ওপরে চাপিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে জবরদস্তিমূলক কর্মকান্ডসহ রক্তপাত ঘটানোর কোনো অবকাশ নেই।

ধর্ম একটি বিশ্বাস। একটি অনুভূতি। পৃথিবীতে যেমন বহু মানুষের বাস, তেমনি তাদের বিশ্বাস ও অনুভূতিও হেরফের হতে বাধ্য। বিষয়টি এমন যে, আপনার কাছে যা বর্জনীয়, আমার কাছে তা গ্রহণীয়। আপনার কাছে যা পছন্দনীয় আমার কাছে তা অপছন্দীয়। আপনার কাছে যা সত্য আমার কাছে তা মিথ্যা। আপনার কাছে যা হারাম আমার কাছে তা হালাল। এভাবেই পৃথিবীর মানব সমাজের বিশ্বাসের ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি গড়ে উঠেছে। তাই আপনি হলফ করে বলতে পারেন না যে, আপনি যা ভাবছেন, সেটিই সত্য। আসলে সবকিছুই আপেক্ষিক। হ্যাঁ না, সত্য মিথ্যা- এ নিয়েই মানব মনের চিন্তার বৈপরীত্য গড়ে উঠলেও তাদেরকে একই সমাজে বসবাস করতে হচ্ছে। এর মূলে রয়েছে পারস্পরিক সহাবস্থানের মানবিক দর্শন।

কোনো মানুষ মানবিক দৃষ্টিকোণ ও যার যার মনোভাব থেকে অন্য মানুষকে মূল্যায়ন করলে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয় না। সমাজে প্রচলিত বহু ধর্মের শান্তিপূর্ণ অবস্থানসহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধনের মাধ্যমে বসবাস করা সুমানুষের কর্তব্য হওয়া উচিত। তাই ধর্ম নিয়ে আর কোনো হানাহানি হিংসা দ্বন্দ্ব ও সংঘাত নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের ভিত্তিতেই কেবল সর্বধর্ম সমন্বিত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে সমাজ দেশ ও পৃথিবী পরিচালিত হতে পারে। এটাই হোক সব মানুষের চিন্তাচেতনা।

আদি থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত পৃথিবীর সবক'টি ধর্ম আবির্ভূত হয়েছে একমাত্র সৃষ্টিকর্তাকে কেন্দ্র করে। আর ধর্মকে কেন্দ্র করে মানব সমাজ তিনটি চিন্তাধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে, তাহলো : আস্তিক, নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ। অপরদিকে সৃষ্টিকর্তার একমাত্র ধর্ম হলো সৃষ্টি করা ; সৃষ্টিশীল জগতকে প্রতিপালন ও নিয়ন্ত্রণ করা। পৃথিবীতে প্রচলিত কোনো ধর্মের প্রতি বা আস্তিক, নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষপন্থীদের প্রতি তার কোনোই পক্ষপাতিত্ব, অনুরাগ ও বিরাগ নেই। তিনি তাঁর কর্ম, চিন্তা ও চেতনায় নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছেন। তাঁর দৃষ্টিতে বিশ্বের সব মানবগোষ্ঠীসহ সমগ্র প্রাণীকূল সমান। তিনি সবার জন্যই নিবেদিত। সব ধর্মমত ও ধর্মানুসারী মানবসমাজ তথা আস্তিক, নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের সমান দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেন। অর্থাত্ এক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা নিজেই ধর্মনিরপেক্ষ।

উদাহরণস্বরূপ: রাম, রহিম ও জন। এ-তিন ধর্মাবলম্বী তথা হিন্দু মুসলমান ও খ্রিস্টান- সবাই সমভাবে তাঁর করুণা লাভ করে থাকেন। যেমন একটি জনপদে বসবাসকারী এ রাম রহিম ও জনদের জমিতে ফসল উৎপাদনের সময় যখন বৃষ্টির প্রয়োজন হয়, তখন সৃষ্টিকর্তা ঐ জনপদে বৃষ্টি বর্ষণ করে থাকেন। সৃষ্টি কর্তার এ-বৃষ্টিবর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ম বিবেচনা করেন না। যেমন সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় চীনের ইয়ারলুং জাঙপু নদী নেপাল-ভুটানের উত্তর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারত-বাংলাদেশ পেরিয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নাম ধারণ করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়ার পথ পরিক্রমায় বৌদ্ধ, হিন্দু, খৃস্টান, মুসলমান ও ধর্মহীন সম্প্রদায়ের জনপদকে জল ও পলি দিয়ে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে আসছেন, সে-ক্ষেত্রে তো বিশেষ কোনো ধর্ম বা ধর্মানুসারীদের কথা তিনি কোনোই বিবেচনায় আনেননি! তেমনি সৃষ্টিকর্তার যদি নিজস্ব কোনো ধর্ম থাকতো তাহলে তিনি তো তার ধর্মের অনুসারীদের ওপরই তার যাবতীয় কৃপা বর্ষণ করতেন। পৃথিবীর সব ধর্ম-বর্ণের মানব জাতি বাতাসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অক্সিজেন গ্রহণ করে জীবনে বেঁচে আছে। সেই বাতাস ও অক্সিজেন সৃষ্টি করেছেন ঐ সৃষ্টিকর্তা মানবজাতিসহ অন্যান্য প্রাণীকূলের জন্য। অনুরূপ সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, নদী-সাগর, বৃক্ষ-তরুলতা প্রভৃতি সৃষ্টি করে প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। সৃষ্টিকর্তার যদি নিজস্ব কোনো ধর্ম থাকতো তাহলে তো তাঁর ধর্মের অনুসারীদেরকেই যাবতীয় করুণা করতেন! বিধর্মীদের বিনাশ করে দিতেন। কিন্তু তিনি গোটা মানবজাতিসহ প্রাণিজগতের সব প্রাণীকে অকৃপণভাবে আরো যা-কিছু আছে তা উজাড় করে দিয়েছেন। কারণ তিনি সব ধর্মের ঊর্ধে। নিরপক্ষে অবস্থানে আসীন।

বিশেষ করে সৃষ্টিজগতের একমাত্র জ্ঞানী প্রজাতি মানবজাতির ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে তিনি যে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখেন তার প্রমাণ পবিত্র কোরআনের এরকম একটি বাণীতেও মূর্ত হয়ে উঠেছে, যেমন : মুসলমান ইহুদি খৃস্টান সেবিয়ানস মেজিয়ান স্ক্রিপচার্স পলিথিস্ট, আর যারা আছে, যারা সৎপথে চলে, তাদের কোনো ভয় নেই, নিশ্চয়ই তারা পুরস্কৃত হবে। এ-মহান বাণীদৃষ্টে প্রমাণিত হয় যে, মহান সৃষ্টিকর্তা বিশেষ কোনো ধর্ম বা ধর্মানুসারীদের প্রতি নয়- সব সৎ মানুষ তাঁর কাছে আদরণীয়, তারা যে-ধর্মের বা ধর্মহীন অনুসারী হোক না কেনো।

উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা ও উদাহরণদৃষ্টে এটাই প্রমাণিত হয় যে, বিশ্বজগতের সব দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বস্তুর মহান স্রষ্টা সব প্রচলিত ধর্মের ঊর্ধে। তাঁর ধর্ম সৃষ্টি করা ও সৃষ্টিশীল জগতকে প্রতিপালন ও নিয়ন্ত্রণ করা। পৃথিবীর বুকে তাঁর নামে বিভিন্ন মনীষী যেসব ধর্ম প্রবর্তন করেছেন, সেসব ধর্মকে কেন্দ্র করে যে-অনুসারীগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে বা যারা কোনোই ধর্মানুসারী নয়- এসবের সাথে স্রষ্টার কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এটুকুই বুঝি যে, কোনো ধর্ম ও ধর্মানুসারী এবং ধর্মহীনদের প্রতি স্রষ্টার বিন্দুমাত্র পক্ষপাতিত্ব বা অনীহা নেই, তিনি সব ধর্ম ও না-ধর্মের উর্দ্ধে-ধর্মনিরপেক্ষ।

আমরা স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি আমাদের সৃষ্টি করে জীবন, জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেক দিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তার ওপর আস্থা রেখে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, মানবিক মর্যাদা ও মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে সুন্দর জীবনযাপন করার ব্রতই হোক সব মানুষের শাশ্বত কর্তব্য।

অতএব কে ধার্মিক, কে বিধার্মিক ও কে নাস্তিক- এসব নিয়ে হানাহানি কাটাকাটি মারামারি হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করার কোনো অর্থ নেই। কে কোন ধর্ম পালন করবে বা না-করবে, কে ধার্মিক বা ধর্মহীন, এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ও ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করা অথবা ধর্ম নিয়ে কারো ওপর জবরদস্তি করা মনুষ্যত্বের মধ্যে পড়ে না। পবিত্র কোরআনে এ-বিষয়েও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যেমন, যার যার ধর্ম তার তার কাছে ; ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।

সুতরাং সৃষ্টিকর্তার ধর্মনিরপেক্ষ জগতে, আসুন, আমরাও ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে দীক্ষা লাভ করি এবং সর্বধর্ম সমন্বয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক শান্তিময় ভুবন রচনা করে সম্প্রীতি ও কল্যাণে নিজেদেরকে সমর্পিত করি। যেমন ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃস্টান- পাহাড়ি-সমতলের সব আস্তিক-নাস্তিক সম্প্রদায় সর্বধর্ম সমন্বিত ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে উজ্জীবিত হয়ে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছি। এ-জন্য বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম আদর্শ হিশেবে গণ্য করেছেন।

লেখক :মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২১ ডিসেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test