E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

শুদ্ধি এবং সংশোধনের সংলাপ

২০২৪ সেপ্টেম্বর ১০ ১৭:১১:৫৬
শুদ্ধি এবং সংশোধনের সংলাপ

আবু মকসুদ


আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের এবং নেতাদের একের পর এক গ্রেপ্তার করার ঘটনা সাম্প্রতিককালে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই গ্রেপ্তারগুলোর ন্যায্যতা কতটুকু এবং এই প্রক্রিয়াটি পূর্বনির্ধারিত কিনা। যদি তা হয়, তবে ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা কতটুকু? এ ধরনের গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া শুধুমাত্র বিচারব্যবস্থার প্রয়োগ, নাকি এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে।

আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। এ সময়ে তারা নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তও নিয়েছে। যেসব নেতারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের শাস্তি দেওয়া উচিত—তদন্ত সাপেক্ষে এবং যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতে। তবে যারা মন্দ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না, তাদের অহেতুক হয়রানি করা উচিত নয়। বিচারব্যবস্থা যখন নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ হয়, তখন জনগণের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। অন্যথায়, এ ধরনের কর্মকাণ্ড সরকারের প্রতি আস্থার সংকট সৃষ্টি করতে পারে।

এমন ভাবনা যে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী বা নেতা হলেই তারা দোষী, একটি ফ্যাসিস্ট মনোভাবের পরিচয় দেয়। ন্যায়বিচারের মূলনীতি হলো, শত অপরাধী ছাড়া পাক, কিন্তু একজন নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়। বর্তমান সরকার যেভাবে গণহারে গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছে এবং মামলা দিচ্ছে, তা দেখে মনে হচ্ছে পূর্ববর্তী সরকারের নীতি তাদের ওপরেও প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, বর্তমান সরকার কি আসলেই পূর্ববর্তী সরকারের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়েছে, নাকি একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করছে?

আমি লক্ষ্য করেছি, সরকারের আইন বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল একটি সাম্প্রতিক আদালত হামলার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অনেক বছর আগের মাহমুদুর রহমানের উদাহরণ টেনেছেন। তার বক্তব্য থেকে মনে হয়েছে, মাহমুদুর রহমানও যদি আদালতে হামলার শিকার হতে পারেন, তবে বর্তমান সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের ব্যাপারে সমালোচনা করা উচিত নয়। এটি পূর্ববর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা যেতে পারে, কিন্তু এর মাধ্যমে বর্তমান সরকারও একই ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।

এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আসলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায়। যদি বর্তমান সরকার সত্যিই পূর্ববর্তী সরকারের ভুলগুলোকে শুধরে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করতে চায়, তবে তাদের উচিত ছিল আদালতে হামলার চরম নিন্দা করা এবং এ ধরনের ঘটনা যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমরা যা দেখতে পাচ্ছি, তা হলো শুধুমাত্র আগের সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা। এতে মনে হয়, একই রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, শুধু নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটেছে।

সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টারাও একইভাবে অতীতের ভুলের দোহাই দিয়ে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে বৈধ করার চেষ্টা করছেন। তারা বলছেন, এটি মানুষের ১৬ বছরের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু যদি মানুষ ১৬ বছর ধরে তাদের ক্ষোভ সংবরণ করতে পারে, তাহলে তারা আরও ১৬ বছর তা করতে সক্ষম হবে। এ ধরনের যুক্তি আসলে সরকারের দুর্বলতারই প্রতিফলন। জনগণের ক্ষোভকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের অপ্রয়োজনীয় কার্যকলাপকে বৈধ করার চেষ্টা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ ধরনের আচরণ গণতন্ত্রের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রের সুশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

বর্তমান সরকার যদি সত্যিই একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে তাদের উচিত নিজেদের কর্মকাণ্ডে শুদ্ধি আনা। অতীতের ভুলগুলোকে শুধরে একটি নতুন পথ তৈরি করা, যেখানে প্রতিটি রাজনৈতিক দল সমান সুযোগ পাবে এবং কোনো দলকে অন্য দলের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া হবে না। গণতন্ত্রের মূলনীতি হলো, জনগণকে তাদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া। একদলকে দমন করে অপর দলকে সুবিধা দিয়ে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হলে, গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপ বিকৃত হয়।

আওয়ামী লীগের প্রতি এই ধরনের দমননীতি একেবারেই নতুন কিছু নয়। ১৯৭৫ সালের পরে আওয়ামী লীগের ওপরও একই ধরনের নির্যাতন চালানো হয়েছিল, কিন্তু এতে আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়নি; বরং দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত যে, কোনো রাজনৈতিক দলকে শক্তি দিয়ে দমন করার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয় না। আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতৃবৃন্দ হয়তো জনগণের বিপরীতে গিয়েছিলেন, তাদের জন্য আইনানুগ শাস্তি নিশ্চয়ই প্রাপ্য, তবে এই শাস্তি হতে হবে স্বচ্ছ এবং ন্যায়সংগত।

বর্তমান সরকারের উচিত, ক্ষমতার জোরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা না করা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সব দলকে সমান সুযোগ দেওয়া উচিত, যাতে জনগণ তাদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পায়। ১৬ বছরের পুরানো ক্ষোভের দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগকে কোনঠাসা করার চেষ্টা করলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। গণতন্ত্র শুধুমাত্র একটি শব্দ নয়, এটি একটি প্রক্রিয়া; এর মূলনীতিগুলো পালন করতে হবে এবং তা প্রমাণ করতে হবে।

এটা ঠিক যে আওয়ামী লীগ বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় আছে। তাদের নেত্রী পলায়ন করেছেন, অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে গেছেন এবং অনেকেই ভয়ে আছেন। তবে, এটা মনে রাখা জরুরি যে, কোনো নির্দোষ নেতা বা কর্মীকে অকারণে হয়রানি করা হলে তা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। সরকারের উচিত তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অহেতুক হয়রানি বন্ধ করা।

বর্তমান সরকার দেশের গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চায়, দেশের রাজনীতিকে সংস্কার করতে চায়। কিন্তু এ ধরনের কাজ শুরু করতে হলে প্রথমে তাদের নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করতে হবে। নিজেদের শুদ্ধি আনার মাধ্যমেই অন্যদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব। পূর্ববর্তী সরকারের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে, একই ধরনের অপশাসন থেকে দূরে থাকতে হবে। কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা ত্যাগ করতে হবে, কারণ এই ধরনের আচরণ কখনোই দেশের রাজনৈতিক অগ্রগতির পক্ষে সহায়ক নয়।

মানুষের আকাঙ্খাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে সরকারের উচিত ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়ানো এবং সব দলের প্রতি সমান আচরণ করা। কোনো দল বা গোষ্ঠীর প্রতি অবিচার করা হলে, তা শুধু তাদের নয়, পুরো দেশের জন্য ক্ষতিকর। সরকারের উচিত পূর্ববর্তী সরকারের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি নতুন এবং সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলো পুরোপুরি পালিত হবে। এটাই হবে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকারের পরিচয়।

তবে এটাও আমি বিস্মৃত নই যে, একটা বিপ্লবের পরে সাধারণত একটি জাতির মধ্যে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, কারণ দীর্ঘদিনের নির্যাতন ও দমনমূলক শাসনের পরে মানুষ হঠাৎ স্বাধীনতা ও ক্ষমতার মুখোমুখি হয়। তারা তখন শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে এবং কখনও কখনও তাড়াহুড়ো করে নিজেদের হাতে আইন তুলে নিতে শুরু করে। এর ফলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে এবং সমাজের মধ্যে আরও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে।

তবে আমাদের বিপ্লবের পর, যাদের আমরা ফেরেশতা বলে ভেবেছিলাম, সেই নেতারা ক্ষমতা গ্রহণ করলেন, কিন্তু তাদের কাছ থেকে আমরা যে শিক্ষা পেলাম, তা আমাদের পথভ্রষ্ট করল। তারা আমাদের বলেছিলেন, স্বৈরাচার পতনের সাথে সাথেই সমাজে মানুষ ফেরেশতার রূপ ধারণ করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এই প্রত্যাশা একেবারেই ভুল ছিল। তারা আমাদের বুঝিয়েছিলেন যে, পূর্ববর্তী স্বৈরাচার মানুষকে ফেরেশতা হতে দিচ্ছিল না—যদি কেউ ফেরেশতা হতে চাইত, তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হত, নির্যাতন করা হত, বা হত্যার শিকার করা হত।

কিন্তু আজ, শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পরেও আমরা কোথাও ফেরেশতার ছোঁয়া পাচ্ছি না। বরং, দেশে যা ঘটছে তা আরও বেশি করে শয়তানের প্রভাবের প্রকাশ করছে। সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ও দুর্নীতির প্রভাব আরও গভীর হয়েছে।

প্রশ্ন হল, যেসব নেতারা হঠাৎ করে বাংলাদেশকে স্বর্গভূমি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন, তারা কেন এই ঘোষণা দিয়েছিলেন? আসলে, তারা নিজেরাও শেখ হাসিনার পরিত্যক্ত পথে পিছলে পড়েছেন, যেমন শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার পথে পড়েছিলেন, আর খালেদা জিয়া পড়েছিলেন এরশাদের পথ ধরে।

বাংলাদেশ আজ যেন সেই পাটিগণিতের তৈলাক্ত বাঁশের মতো, যেখানে বাদররা এক মিনিটে পাঁচ মিটার উপরে উঠলেও পরের মিনিটেই সাত মিটার নিচে নেমে যায়। এই তৈলাক্ত বাঁশে চড়ে কখনো উন্নতির শীর্ষে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

বিপ্লব হলো এক মধুর ইউটোপিয়া, যা বাস্তব জীবনে কখনো পূর্ণতা পায় না। এটি এক প্রকার স্বপ্ন, যা মানুষের মনকে মোহিত করে রাখে, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখানো হয়, কিন্তু তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় যে বিশৃঙ্খলা ও হতাশা আসে, তা বিপ্লবের সেই মধুর ইউটোপিয়াকে ধূলিসাৎ করে দেয়। দেশের সকল মানুষের প্রত্যাশা শান্তি ও স্বস্তি। সেটা দিতে পারলে এই বিপ্লব স্বার্থকতা পাবে, নতুবা কি হবে সেটা ভবিতব্যই বলবে।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ 'শব্দপাঠ' সম্পাদক।

পাঠকের মতামত:

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test