E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

শিক্ষার আলোর অপ্রকাশ

২০২৪ আগস্ট ২৮ ১৬:৩৩:২০
শিক্ষার আলোর অপ্রকাশ

আবু মকসুদ


অনেকেই দেখছি বলছেন শিক্ষকেরা ছাত্রদের সঠিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের প্রতি অসদাচরণ করছে, গায়ে হাত তুলছে, অপমান করছে, এমনকি ঘাড় ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীতে অনেকেই মনে করছেন যে ছাত্ররা কেবল সেই শিক্ষককেই অপমান করছে, যারা সেই অপমান পাওয়ার যোগ্য। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, যেসব শিক্ষকদের প্রতি এই ধরনের আচরণ করা হচ্ছে না, তারা কি শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষা দিয়েছেন? যদি শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহলে কোথায় লেখা আছে যে সেই ছাত্ররা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিতে পারবে? কোথায় লেখা আছে যে শিক্ষকদের অপমান করা, ঘাড় ধাক্কা দেওয়া অনৈতিক নয়।

এই ঘটনাটি আমাদের সমাজের এক গভীর সংকটের প্রতিফলন। আমাদের সমাজে নৈতিক শিক্ষার অভাব এবং মূল্যবোধের অবক্ষয় এতটাই গভীরে প্রবেশ করেছে যে, শিক্ষার্থীরা নিজেদের আচরণের সঠিকতা-বেঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন করার প্রয়োজনও অনুভব করছে না।

আমার মনে পড়ে, অনেক বছর আগে, যখন আমার বয়স ছিল আট অথবা নয়, তখন আমাদের বাড়িতে একটি চোর ধরা পড়ে। তাকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল, আর যেই তাকে দেখতে আসছিল, সেই তাকে অবলীলায় লাথি মারছিল। চোরটি অসহায় চোখে শুধু লাথি খেয়ে যাচ্ছিল। সবার লাথি দেখতে দেখে আমার মধ্যেও উত্তেজনা তৈরি হলো। আমি আমার চাচাকে বললাম, "চোরকে আমিও লাথি মারবো।" চোরের সামনে যে জটলা ছিল, সবাইকে সরিয়ে আমার চাচা বললেন, "এখন আমার ভাতিজা লাথি মারবে।"

আমাকে ছোট থেকেই শেখানো হয়েছিল যে, চোরকে লাথি মারা অন্যায়। কিন্তু তখন আমি সময়ের প্রেক্ষাপটে ভুল কাজটি করেছি, এবং এখন সেই ঘটনার জন্য আমি লজ্জিত হই। এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে, কখনও কখনও সমাজের চাপ এবং পরিস্থিতি আমাদের ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।

তেমনি, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সাথে যে অপমানজনক আচরণ করছে, তা সঠিক বলে মনে হলেও একদিন তারা অবশ্যই এই কাজের জন্য লজ্জিত হবে। এ ধরনের আচরণ শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধের অভাবকেই স্পষ্ট করে। যে বিপ্লবের জোশে তারা শিক্ষকদের অপমানিত করছে, নিগৃহীত করছে, সময়ের সিন্দুকে তা বন্দি থাকবে। এবং সেই অপমান তাদের তাড়া করবে, কারণ সময় কোন কিছুই ভুলে না, ভুলতে দেয় না।

শিক্ষা আমাদের সমাজের ভিত্তি। যদি সেই ভিত্তি নড়বড়ে হয়, তবে সমাজের অবক্ষয় অনিবার্য। শিক্ষার্থীদের হাতে যদি এমন ক্ষমতা আসে যেখানে তারা নিজেদের বিচার নিজেরাই করতে শুরু করে, তাহলে সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। সঠিক শিক্ষা শুধুমাত্র জ্ঞানার্জন নয়, বরং নৈতিকতা, মানবিকতা, এবং সহমর্মিতার বিকাশের মাধ্যমেও অর্জিত হয়। এই মূল্যবোধগুলো যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিফলিত না হয়, তাহলে আমাদের সমাজকে সেই অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচানো কঠিন হবে।

কোনো উপদেষ্টাকে বলতে শুনলাম ধৈর্য ধরো, ১৬ বছরের জঞ্জাল ১৬ দিনে সাফ করা যাবে না। আমরা একমত যে ১৬ বছরের সঞ্চিত দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা ১৬ দিনে দূর করা সম্ভব নয়। আমরা আশা করেছিলাম অন্ততপক্ষে সেই পরিবর্তনের সূচনা আমরা দেখতে পাবো। আমরা দেখতে চাই যে ফেরেশতারা ঈশ্বরের বাণী বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ শুরু করেছেন, এবং তাদের কার্যক্রমে ন্যায়বিচারের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু বাস্তবে যা ঘটছে, তা আমাদের হতাশ করছে। আদালতে যেভাবে গ্রেফতারকৃতদের উপর হামলা করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই ঈশ্বরের বাণী প্রতিফলিত করে না। বরং এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আগে যারা ছিল, তাদের চেয়ে বর্তমানের পরিবর্তনশীলরা কোনো অংশে ভালো নয়। তারা হয়তো নতুন মুখ, কিন্তু পুরনো শাসকদের মতোই নৃশংসতা প্রদর্শন করছে।

হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেনন যদি কেবল রাজনৈতিক কারণে নিগৃহীত হন, তাহলে স্বৈরাচারী হাসিনা এবং তথাকথিত 'ফেরেশতা' ইউনূসের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? যদি ইউনূসের অধীনে একই ধরনের নির্যাতন ও নিপীড়ন চলতে থাকে, তাহলে কীভাবে তাকে স্বৈরাচার থেকে আলাদা করা যায়? এমনটা চলতে থাকলে আবু সাঈদের আত্মত্যাগ অর্থহীন হয়ে পড়বে। তিনি তো কখনোই শিক্ষকদের অপমান বা বিচার বিভাগের ওপর হামলা চাননি।

আবু সাঈদের চাওয়া ছিল বৈষম্যহীন একটি সমাজ, যেখানে সবার অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। তিনি রক্ত দিয়ে যে পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, সেই পরিবর্তনকে বিকৃত করে শাসকেরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য শয়তানের রূপ ধারণ করেছে।

আমরা ১৬ বছরের জঞ্জাল একদিনে মুছে ফেলতে চাই না, কিন্তু আমরা অন্তত শুরুটা দেখতে চাই। আমরা দেখতে চাই যে পরিবর্তন সত্যিই আসছে, এবং তা কেবল কথায় নয়, কাজে প্রতিফলিত হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যা আমরা অবলোকন করছি, তা এক নতুন বোতলে পুরনো বিষ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই অবস্থায় জনগণের বিশ্বাস ভেঙে পড়ছে এবং পরিবর্তনের আশা ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। যদি এই পরিস্থিতি চলতে থাকে, তবে জাতির সামনে একটি অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক।

পাঠকের মতামত:

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test