E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধা কারা, এটা নির্ধারণ ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদে জাতীয় কমিশন গঠন করুন

২০২৪ আগস্ট ২৭ ১৬:৫৪:৪৯
মুক্তিযোদ্ধা কারা, এটা নির্ধারণ ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদে জাতীয় কমিশন গঠন করুন

আবীর আহাদ


চলতি আগস্টের ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে দেশে ভ. মুহম্মদ ইউনসের নেতৃত্ব অন্ত্রর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের 'বীরপ্রতীক' খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ই আজম। সম্ভবত নতুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা মহোদয় ১১/১২ আগস্ট শপথ গ্রহণ করেছেন। সেই থেকে আজকের মধ্যে তাঁর সাথে আমার দু'বার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। দু'দিনের আলাপচারিতার মধ্যে তিনি প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক জাতীয় মর্যাদা সমুন্নফ করা এবং মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের বিষয়ে সবিশেষ গুরুত্ব করেছেন।। নতুন উপদেষ্টা একজন মাঠপর্যায়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা। উপরোক্ত বিষয়ে তাঁর কণ্ঠে যে প্রত্যয় ধ্বনিত হয়েছে, তাতে আমার মনে হয়েছে, এতকাল ধরে আমি বা আমরা যেসব আর্তি উচ্চারণ করে আসছি, সেসব প্রাণ পেতে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন যে, বর্তমানে তিনি দুর্যেগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বন্যাপীড়িতদের কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছেন- এটা নিয়ন্ত্রণে আসার পরই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় নিয়ে বসবেন। তাঁর সদয় অবগতি এবং পরবর্তী কার্যক্রমের সুবিধার্থে আমি এ নিবন্ধটি উপস্থাপন করছি।

স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় পেরিয়ে এসেও এখনো 'মুক্তিযোদ্ধা' সম্পর্কে অনেকেই অস্পষ্ট ধারণার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুস্পষ্ট সংজ্ঞা থাকলেও সে-সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাবে এখনো অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন! যদিও অতীতে বলা হয়েছিল, এতকাল পরে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়, তবে পর্দার অন্তরালে ব্যাক-ডেটে দরখাস্ত নিয়ে প্রতিনিয়তই মুক্তিযোদ্ধা বানানো হহয়ে বলে আমরা জানি! কী দুঃখজনক ব্যাপার, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) চেয়ারম্যানসহ এমন কতিপয় সদস্র ছিলেন, যারা মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার দৃষ্টিতে আদৌ মুক্তিযোদ্ধা নন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, অথচ তারা মুক্তিযোদ্ধা তৈরিতে ইন্টারভিউ নিতেন, মুক্তিযোদ্ধা না-হয়েও অনেকে তাদের হাত দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন! কেউ কেউ বাদও পড়েছেন!

এখানে একটা কথা লক্ষ্য রাখতে হবে যে, পৃথিবীর ইতিহাসে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে যে বিশ্বালোড়িত মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো, সেই মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীরা যারা জীবন-যৌবন, আশা-স্বপ্ন, বাবা-মাসহ আপনজনদের মায়া ছিন্ন করে দেশমাতৃকার ডাকে সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বের মধ্যে অবগাহন করে পরাক্রমশালী পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সশস্ত্র সহযোগী রাজাকার আলবদর আলশামস ও তথাকথিত শান্তি কমিটিকে পরাজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে এনেছিলেন, সেই মুক্তিযুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে এখনো যাদের ভ্রান্তি কাটেনি, এখনো যারা তাদের সম্পর্কে হীনমন্যতা ও পরশ্রীকাতরতায় ভোগেন, তাদেরকে করুণাই করতে হয়।

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকার ফলে অতীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের গোঁজামিলের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার নিরিখে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকাররাও মুক্তিযোদ্ধা গেছে। অথচ এখনো সারাদেশে বেশকিছু প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়ে চরম মনোকষ্টের মধ্যে জীবন যাপন করছেন। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস বিকৃতির সামিল। মুক্তিযোদ্ধা না-হয়েও মুক্তিযোদ্ধা- এটা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না, তেমনি মুক্তিযোদ্ধা হয়েও অমুক্তিযোদ্ধা হয়ে থাকা, এটা কোনো সুস্থতার লক্ষণ নয়।

রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা অধিনায়ক এবং একজন মুক্তিযুদ্ধের লেখক-গবেষক হিশেবে জাতীয় নৈতিকতা ও কর্তব্যবোধের তাড়নায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই 'মুক্তিযোদ্ধা' এবং কোন সংজ্ঞায় তাদের কৃতিত্ব নির্ণয় করা হবে তা অবশ্যই মূল্যায়নের দাবি রাখে বলে আমি মনে করি। আশা করি নিম্নলিখিত বক্তব্যের আলোকে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং চলে-আসা বিভ্রান্তি ও ধুম্রজালের অবসান ঘটবে।

মুক্তিযোদ্ধা। নামের মধ্যেই এর তাৎপর্য নিহিত। অর্থাৎ মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ করে সে-ই মুক্তিযোদ্ধা।আমরা একাত্তর সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে নির্দেশে ও নামে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন এবং সার্বিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিকসহ জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতা নিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ সশস্ত্র মানুষ হানাদার পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার আলবদর আলশামস ও তথাকথিত শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে এক রক্তাক্ত সংঘবদ্ধ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মুক্ত করেছিলাম। ঐ রক্তাক্ত সংঘবদ্ধ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধারাই স্বাধীন বাংলাদেশে 'মুক্তিযোদ্ধা' নামে খ্যাত।

আর এই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধটা বিশেষ করে একটি পরাক্রমশীল সংঘবদ্ধ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হলে তাকেও সংঘবদ্ধ বাহিনীর সাথে যুক্ত হতেই হয়--যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। আমরা উনিশশো একাত্তরে পরাক্রমশীল পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘবদ্ধ উপায়ে প্রথমে গেরিলা এবং পরে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম।

সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সময় এভাবে নির্ণয় করা হয়েছিল যা মহা যুক্তিযুক্ত। সংজ্ঞাটি হলো :,"মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যেকোনো সংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীর (ফোর্স ) সদস্য হিশেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।"

উপরোক্ত বক্তব্য ও বঙ্গবন্ধুর সংজ্ঞার আলোকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত বিভিন্ন দলে অন্তর্ভুক্ত সশস্ত্র অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কোনো অবস্থায়ই দেড় লক্ষের বেশি হবে না। এসব মুক্তিযোদ্ধাদের সিংহভাগ সদস্য ছিলেন ভারতে প্রশিক্ষিত : এফএফ বা গণবাহিনী এবং বিএলএফ বা মুজিববাহিনী। বাকিরা ছিলেন সামরিক বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ ও আনসারের পূর্ব-প্রশিক্ষিত সদস্য। আর ছিলেন বিভিন্ন স্থানীয়ভিত্তিতে গড়েওঠা বাহিনীর সদস্য। এসবেরই সম্মিলিত নাম ছিল মুক্তিবাহিনী। একমাত্র স্থানীয়ভিত্তিতে গড়েওঠা মুক্তিবাহিনী ছাড়া বাকি গণবাহিনী, সামরিক বাহিনী, বিডিআর ও পুলিশ বাহিনী সবাই ছিলেন মুজিবনগর সরকার প্রবর্তিত এগারোটি সামরিক সেক্টরের অধীন- অর্থাৎ মুজিবনগর সরকারের বাহিনী। এদেরকেই বঙ্গবন্ধুর সংজ্ঞানুযায়ী "মুক্তিযোদ্ধা" হিশেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তবে মুজিবনগর সরকারের সেক্টর কমান্ডের বাইরে স্থানীয়ভিত্তিতে যেসব ছোট-বড় সশস্ত্রবাহিনী যেমন কাদেরীয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, আফসার বাহিনী, হালিম বাহিনী প্রভৃতি বাহিনী গড়ে উঠেছিল তারাও বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার মধ্যে পড়েন। তারাও মুক্তিযোদ্ধা।

কারা বীর মুক্তিযোদ্ধা- এ বিষয়টি নিশ্চয়ই উপরোক্ত ব্যাখ্যার আলোকে পরিষ্কার হয়েছে। তবে যেহেতু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সম্পন্ন করা যায়নি, সেহেতু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণের বিষয়টি জটিল হলেও অসমাধানযোগ্য নয়। মূলত: তথাকথিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণের বিষয়টি জটিল করে অর্থের বিনিময়ে, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাবে যাকেতাকে যখনতখন মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে গেছে। ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণের লক্ষ্যে জামুকা বিলুপ্ত করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাকে মূলভিত্তি ধরে উচ্চতর আদালত, নেতৃস্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমিশন গঠন করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা ও কঠোর নীতিমালা। বেশ কিছুদিন আগে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে আমরা প্রধানমন্ত্রী সমীপে পেশকৃত স্মারকলিপির ২ নং দফায় সেই জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমিশন গঠনের কথা বলেছি।

মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সংগঠকবৃন্দ, মুজিবনগর সরকারের বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী, কূটনৈতিক মিশনের লোকজন, স্বাধীন বাংলা বেতারের সাথে জড়িত কলা-কুশলী, শিল্পী-গায়ক, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শরণার্থী, বীরঙ্গনা, গণশহীদ, খেলোয়াড়সহ বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারীদের অবদানের গুরুত্ব অপরিসীম বিধায় তাঁদেরকে অন্য কোনো অভিধায় সম্মানিত করাই যুক্তিযুক্ত কিন্তু আর যা-ই হোক কোনো অবস্থায়ই 'মুক্তিযোদ্ধা' নামে নয়। যে মুক্তিযোদ্ধারা জীবনকে পায়ের ভৃত্য মনে করে মহাশত্রুর বিরুদ্ধে সীমাহীন শৌর্য বীর্য ত্যাগ বীরত্ব ও রক্তের সাগরে ভেসে দেশকে হানাদারমুক্ত করেছিলেন তাঁদের সাথে অন্য কারো তুলনাই চলে না।

লেখক: গবেষক, চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test