E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Walton New
Mobile Version

‘যে মানুষ বারবার পোড়ে, তার কাছে দাবানলও নত’

২০২৪ জুন ৩০ ১৬:৪১:০৩
‘যে মানুষ বারবার পোড়ে, তার কাছে দাবানলও নত’

সুচিন্ত্য কুমার সাহা


ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে রোহিত-রাহুল জুটি সবচেয়ে সফল ক্যাপ্টেন-কোচ জুটি হয়ে থাকবে। একটা ভালো টিম তৈরি করা একটা প্রসেস। আউটকামের কথা চিন্তা না করে রোহিত শর্মা-রাহুল দ্রাবিড় এই প্রসেসের মধ্যেই নিজেদের ডুবিয়ে রেখেছিলেন। একটা বছরে তিনটে আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলাও যথেষ্ট কৃতিত্বের। অতি বড় ক্রিকেট সমর্থক ছাড়া এটা কেউ বুঝবে না। 

রোহিত শর্মা একজন দুর্দান্ত অধিনায়ক। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি রোহিত-রাহুলের কম্বিনেশনকে আরো একটা টার্ম সুযোগ দিলে ভারতীয় টিম কোন শিখরে পৌঁছবে, তা আর তেমন বলার অপেক্ষা রাখেনা।

ক্রিকেট অনেককিছু কেড়ে নেয়। ক্রিকেট অনেককিছু ফিরিয়েও দেয়। খুব সত্যি কথা। হার্দিক পান্ডিয়াকে দেখুন। দু'মাস আগেও পুরো দেশের জনতা গালাগাল করছিলো দিনরাত। আজ লাস্ট ওভারটা দেখুন। খেলার শেষে দিকবিদিক বয়ে চলা হাওয়ায় পতপত করে ওড়া জাতীয় পতাকাটা জড়িয়ে ধরে যখন হার্দিক অশ্রু ভেজা চোখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে, শুধুমাত্র এইটুকুর জন্য সমস্ত দেশবাসী অপেক্ষা করে থাকে একজন খেলোয়াড়ের কাছ থেকে। শুধুমাত্র এইটুকুর জন্য! সূর্যকুমার আজকের হিট লিস্টেড ভিলেন ছিলেন অবধারিত। কিন্তু ওই একটা ক্যাচ! একটা ক্যাচ সমগ্র ভারতবাসীর হাত কাপের ওপর রেখে দিলো। মিলারের মাপা শটের সমস্ত হিসেব উল্টেপাল্টে দিলো সূর্যের এক অদম্য ইচ্ছাশক্তি।

রোহিত যেন আমাদেরই মতো মধ্যবিত্ত। সমস্ত কিছু ঠিকঠাক করেও যেন কিছুই ঠিকঠাক হচ্ছিল না। ভাগ্যের দোষ, আনফিট, লেজি ক্রিকেট বোদ্ধাদের এত সমস্ত কিছু বিশেষণ চামড়ায় গেঁথে রোহিত আজ বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক। কপিল দেব, ধোনি ছাড়া ক'জনের আছে এই কৃতিত্ব? ক'জন পারবে বুমরাহের মতো বলতে, 'রোহিত ভাইয়ের ক্রিকেট সেন্সের ওপর আমি আমার নিজের ইয়র্কারের চেয়েও বেশি ভরসা করি।'

কথায় বলে যার শেষ ভালো, তার সব ভালো। আর ক্রিকেটের রাজাকে বিদায়বেলায় ক্রিকেট কিছু ফিরিয়ে দেবে না, এটা হতে পারে? মাইক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বকাপ ফাইনালের প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ ছেলেটিকে দেখুন। ২০১১ বিশ্বকাপ জিতে শচীনকে কাঁধে তুলে ঘোরানো সেই কোহলি এই কোহলি নয়। এ এক অন্য কোহলি। মাপা অ্যাগ্রেসন, চাপা কাঠিন্য। যে কোহলিকে বরাবর পাল্টা দিতে দেখে এসেছি, তেড়ে যেতে দেখে এসেছি, সেই কোহলি ২০২৪ এর ২৯ জুন কিছুটা শান্ত। যেন অশেষ মনখারাপ ঘিরে ধরেছে তাকে কোনো এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যেতে। স্পষ্ট তাঁর জবানি, 'এই আমার শেষ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ভারতের হয়ে এটাই শেষ টি টোয়েন্টি ম্যাচ। আমাকে ছেড়ে যেতে হবে। নতুনরা বয়ে নিয়ে যাবে। শিখবে। পড়বে। উঠে দাঁড়াবে। লড়বে। জিতবে। আমার এটাই শেষ।' যা ফিটনেস, হয়তো আরো দু-বছর আরামসে খেলতে পারতেন। কিন্তু ওই, সিস্টেম। জায়গা ছাড়তে হয়। এটাই রীতি।

এই বিশ্বকাপ শুধুমাত্র ক্রিকেটের নয়। ক্লাসের চিরাচরিত সেকেন্ড বয়ের ফার্স্ট বয় হয়ে উত্তরণ। ২০০৭ এর বিশ্বকাপ গ্রুপ লিগ থেকে ছিটকে যাওয়া এক ‘হেরো’ অধিনায়কের বিশ্বকাপ জয়ী কোচ হিসেবে উত্তরণ। বরাবর বিরাট কোহলি নামক সুপারস্টারের ছায়ায় ঢাকা পড়ে থাকা এক মুম্বাইয়ের ছেলের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক হিসেবে উত্তরণ। আজকের রাত সততই সুন্দর। গর্বের রাত। যে কোহলি-রোহিতকে আমরা উদয়স্ত গালাগালি দিয়েছি, তাঁরা যখন ঘর্মাক্ত মুখে তৃপ্তির হাসি লেপ্টে বিশ্বকাপ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আগামী ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায়, সেখানেই হয়তো জাতি ধর্ম মিলে মিশে যায়। হানাহানি, মারপিট, অত্যাচার অপমান ফিকে হয়ে আসে। মানুষের আর এক চরিত্রের জন্ম নেয় - ‘সমর্থক’।

অভিনন্দন ভারতীয় মেন্স ক্রিকেট টিম।
অভিনন্দন রোহিত শর্মা।
অভিনন্দন বিরাট কোহলি।
এবং,
অভিনন্দন রাহুল দ্রাবিড়।

মনুষ্যরূপী দশটা-পাঁচটার সাংসারিক ক্রীতদাসদের দু-চার ঘন্টা ‘আমরাও সুপারহিরো, আমরাও পারি’ - শুধুমাত্র এই অনুভবটুকু দেওয়ার জন্যই যে’কোনো দিন, যে’কোনো মুহূর্তে প্রাণহীন পাথরের মূর্তির চেয়ে বড় ঈশ্বর এই রোহিত, কোহলি, দ্রাবিড়, বুমরাহ, হার্দিক, সূর্য, শিবম, অর্শদীপ-রাই।

শেষে,
কিছু রাত থেকে যায় কালো, কিছু দাগে থাকে উহ্য অমলিন ক্ষত;
যে মানুষ বারবার পোড়ে, তার কাছে দাবানলও নত।

লেখক : ব্যবসায়ী।

পাঠকের মতামত:

০২ জুলাই ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test