E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Walton New
Mobile Version

এক অদম্য সাহসী রাজনীতিবিদ ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী

২০২৪ জুন ২৫ ১৬:২০:১৫
এক অদম্য সাহসী রাজনীতিবিদ ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী

মোহাম্মদ ইলিয়াছ


আন্দোলন সংগ্রামের অপর নাম মরহুম আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের কাণ্ডারী ছিলেন  মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি একজন অকুতোভয় বীর, আধুনিক চট্টগ্রামের রূপকার।'

মরহুম আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে বিশ্বাসী এবং দেশরত্ন শেখ হাসিনার একজন বিশ্বস্ত সৈনিক। তাঁর জীবন আখ্যান কখনও গল্পের বুননে, কখনও উপন্যাসের ঢঙে। যিনি জেল-জুলুম, নির্যাতন ভোগ করে নিপীড়িত মানুষের মাঝেই মিশে যেতেন। আবার কখনো পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার লক্ষে সংগ্রাম করেছেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানবতার কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।

এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য ছাত্রনেতা। একজন জননেতা, জনতার নেতা, গণ মানুষের নেতা, হাজারো অসহায়ের ভরসারস্থল, লাখো জনতার আরাধ্য পুরুষ, বঞ্চিত-নিপীড়িতের সূহৃদ-স্বজ্জন, দুস্থ-অবহেলিতের আশার বাতিঘর, মুজিবাদর্শের লড়াকু সৈনিক, জননেত্রী শেখ হাসিনার পরম বিশ্বাসের অদম্য সাহসী এক ত্যাগী সিপাহসালার। চট্টলবাসীর সুখে-দুখে, দুর্যোগ-দুঃসময়ে নিবেদিত বন্ধু। বিত্ত-বৈভব, সম্পদের মোহ, অবৈধ উপার্জন, বিলাসী জীবন কিছুই যাকে স্পর্শ করেনি এমন এক মানবিক নেতা, মানবতার ফেরিওয়ালা।

এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীপাকিস্তান আমলে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত থাকায়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশ শত্রু মুক্ত করার আন্দোলন করায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দলের অস্তিত্ব ধরে রাখায় বারবার শাসক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তারপরও রাজনীতি ছাড়েননি। আঘাত পেয়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এভাবেই দলমতের ঊর্ধ্বে গিয়ে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন। পেয়েছিলেন ‘চট্টলবীর’ উপাধি। তাইতো দল, মত নির্বিশেষে সবাই প্রয়াত এই নেতার প্রশংসাই করেছেন।

১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামের বক্স আলী চৌধুরী বাড়িতে তার জন্ম। বাবা হোসেন আহমদ চৌধুরী আর মা বেদুরা বেগম। আট ভাইবোনের মাঝে মহিউদ্দিন ছিলেন মেজ। তার বাবা চাকরি করতেন আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে। বাবার চাকরির সুবাদে মহিউদ্দিন পড়াশুনা করেছেন মাইজদি জেলা স্কুল, নগরীর কাজেম আলি ইংলিশ হাই, আর প্রবর্তক সংঘে। স্কুল জীবনেই তিনি জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। মাধ্যমিকের শেষে বাবার আদেশে ভর্তি হন ডিপ্লোমা ইন্জিনিয়ারিং কোর্সে। পরে সেখান থেকে ভর্তি হন চট্টগ্রামের অন্যতম বিদ্যাপিঠ চট্টগ্রাম কলেজে। সেখানে বেশিদিন ছিলেন না। এরপর ভর্তি হন কমার্স কলেজ। সেখানেও শেষ করতে পারেননি। শেষে ভর্তি হন সিটি কলেজ। সিটি কলেজেই তার বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

ছাত্র অবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া মহিউদ্দিন ১৯৬২ সালে এসএসসি, ১৯৬৫ সালে এইচএসসি এবং ১৯৬৭ সালে ডিগ্রি পাস করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং পরে আইন কলেজে ভর্তি হলেও শেষ করেননি। জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই মহিউদ্দিন চৌধুরী জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসেন।

১৯৬৮ ও ‘৬৯ সালে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা মহিউদ্দিন একাত্তরে গঠন করেন ‘জয় বাংলা’ বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে আইএসআই (পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা) চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমি সদর দফতরের কাছ থেকে আটক হন। এরপর অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় চার মাস। পরে পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যান ভারতে। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন সম্মুখ সমরে। যুদ্ধ করেন ভারত-বাংলা যৌথবাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে।

সম্মুখ সমরের যোদ্ধা মহিউদ্দিন স্বাধীনতার পর শ্রমিক রাজনীতিতে যুক্ত হন। যুবলীগের নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ পান। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন। পঁচাত্তরে জাতির জনক সপরিবারে নিহত হওয়ার পর প্রতিশোধ নিতে মৌলভি সৈয়দের নেতৃত্বে মহিউদ্দিন গঠন করেন ‘মুজিব বাহিনী’। সে সময় ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করা হলে তিনি পালিয়ে কলকাতায় চলে যান। এরপর ১৯৭৮ সালে দেশে ফেরেন।

দেশে আসলে তার ওপর আরোপিত হয় একের পর এক হুলিয়া। শুরু হয় সামরিক বাহিনীর হাতে নিষ্পেশন, নির্যাতন আর একের পর এক কারাভোগ। জিয়া সরকারের আমলে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন মহিউদ্দিন। এসময় তার ভয়ে তটস্থ থাকাতো সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে দলের দায়িত্ব তুলে দিতেও তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন। দেশে ফিরে আসার পর শেখ হাসিনাকে নগন্য করতে যখন ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর তখন অদম্য সাহসী মহিউদ্দীন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে দলবল নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। সব বাধা অতিক্রম করে শেখ হাসিনাকে দলের কাণ্ডারির দায়িত্ব নিতে সহয়তা করলেন।

এরপর এরশাদ সরকারের শাসনামলে স্বয়ং এরশাদকে চট্টগ্রাম অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে সরকারের চক্ষুশূল হন মহিউদ্দিন। এসময় আবারও রাজনৈতিক বন্দি জীবন কাটে তার। ততদিনে চট্টগ্রামের আপামর জনতার নয়নের মণি হয়ে উঠেন মহিউদ্দীন চৌধুরী।

পরবর্তীতে নব্বইয়ের গণআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির অন্যতম সুপুরুষ বলে বিবাচিত হন সর্ব মহলে। ‘৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে দুস্থ জনতার পাশে দাঁড়িয়ে, অসহযোগ আন্দোলনে খালেদার সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে,গরিব-দুঃখী-শ্রমিকের অধিকারের কথা বলে মহিরুহে পরিণত হন আজকের মহিউদ্দিন।

প্রয়াত এ নেতার আত্মজীবনী ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’তে থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। এতে বলা হয়েছে, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের শীর্ষ পদে ছিলেন। চট্টগ্রামে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, বন্দর রক্ষা আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রায় দুই যুগ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকার পর ২০০৬ সালের ২৭ জুন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন।

পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে অনেক অর্জন থাকলেও কখনও সংসদ সদস্য হতে পারেননি তিনি। ১৯৮৬ সালে রাউজান থেকে এবং ১৯৯১ সালে নগরীর কোতোয়ালি আসনে নির্বাচন করে হেরে যান তিনি। তবে ১৯৯৪, ২০০০ ও ২০০৫ সালে তিন দফায় মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।

‘মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের গর্ব ছিলেন, অহংকার ছিলেন। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের নেতা, গণমানুষের নেতা। আমরা আজ তাকে হারিয়েছি। তার প্রস্থানে এখানে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়।’

মহিউদ্দিন চৌধুরী পুলিশের লাঠি, গুলি টিয়ার গ্যাসের সামনে বুক চিতিয়ে দিতেন। হাজার হাজার জনতা নিয়ে তিনি রাজপথ দখল করে ফেলতেন। চারদিকে শুনা যেতো তার বজ্রকন্ঠের কথা। সেই কাহিনী যেন রূপকথার মতো! ৯৬ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রেফতার হলে পুরো চট্টগ্রাম দাবানলের মতো জ্বলে উঠেছিল।

, ‘তিনি অবহেলিত চট্টগ্রামের কাণ্ডারি ছিলেন। তার হাত ধরেই চট্টগ্রামের মানুষের প্রত্যাশা অনেকাংশে পূরণ হয়েছে। তিনি জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রাণপণ লড়াই করে ইতিহাসে কিংবদন্তি হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন। সাবেক এ মেয়র স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রাজপথে ছিলেন। তিনি প্রজন্ম পরম্পরায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রতিবছর বিজয় মেলা আয়োজন করে ইতিহাসে বিরল অবদান রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে চট্টগ্রামবাসী একজন সফল সেবক ও অভিভাবক হারালো।’, তিনি কখনও ভোট দখলের রাজনীতি করেননি। তিনি কখনও জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেননি। রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজোশে যে অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন চলছে তিনি তার বিরুদ্ধে ছিলেন।’

‘মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামে রাজনৈতিক সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। জনস্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি আমৃত্যু প্রতিবাদ করে গেছেন। জনস্বার্থ বিরোধী নিজ দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন।’

মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো একজন মানুষ চট্টগ্রামবাসীর হ্নদয়জুড়ে সিংহাসন গেঁড়ে বসে কীভাবে পুরো বিশ্বে সৌরভ ছড়িয়েছেন, তা এক মহাবিস্ময়! চট্টগ্রাম প্রকৃত অর্থেই তাঁর মহাপ্রয়াণের পর কেমন জানি ফাঁকা। শুধু চশমাহিল নয়, পুরো চট্টগ্রামই এখন নেতৃত্বহীন অগোছালো। অবিশ্বাস্য শূন্যতার অদৃশ্য বিশাল কালো ক্যানভাস ঢেকে ফেলেছে চট্টগ্রামকে! শূন্যতার হাহাকার মাথা কুটছে বাতাসে!

লেখক : উপ-পরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

পাঠকের মতামত:

২৯ জুন ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test