E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Walton New
Mobile Version

বঙ্গবন্ধু জাতির সম্পত্তি, আওয়ামী লীগের একক নয়

২০২৪ জুন ২৩ ১৬:১৪:০৫
বঙ্গবন্ধু জাতির সম্পত্তি, আওয়ামী লীগের একক নয়

শিতাংশু গুহ


লেখাটি পুরানো। সেপ্টেম্বর ২০২০-এর। কিন্তু এখনো সমধিক প্রযোজ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হন ৫৫ বছর বয়সে। এই স্বল্প সময়ে তিনি জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ, পতাকা ও একটি মানচিত্র দিয়েছেন। এটিই কি যথেষ্ট নয়? তার জীবন থেকে শিশুকাল, কিশোর ও যুবা বাদ দিলে থাকে ৫৫-১৮=৩৭ বছর। জেল খেটেছেন প্রায় ১৪ বছর। ৩৭-১৪=২৩ বছর। মুসলিম লীগের ভুল রাজনীতি করেছেন প্রায় ১০বছর। ২৩-১০=১৩ বছর। অর্থাৎ ১৩-১৫ বছর খোলা আকাশের নীচে রাজনীতি করে তিনি বাংলাদেশ এনেছেন। সেই বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র সাড়ে ৩ বছর। কারাগারের রোজনামচা বা অসমাপ্ত জীবনী’র পাতায় পাতায় বঙ্গবন্ধুকে আবিষ্কার করা যায় একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ হিসাবে। পিতার শাসন, মাতার স্নেহ, স্ত্রীর ভালবাসা, পুত্রকন্যার প্রতি তার আপত্য মমতা সবকিছু আর পাঁচটা বাঙ্গালীর মতোই সাধারণ। এই সাধারণ বঙ্গবন্ধু পুত্র, স্বামী, পিতা, ভাই হিসাবে সকল দায়িত্ব পালন করেছেন সুষ্ঠূভাবে। রাজনীতি করেছেন পুরো পরিবারকে সাথে নিয়ে, স্ত্রী-মাতাপিতা সবাই তাকে সাথ দিয়েছেন। জনগণের সাথে মিশেছেন ভাইয়ের মত, বন্ধু’র মত। মাঝির সাথে সখ্যতা, কয়েদিদের মাঝে দেশপ্রেম জাগানো, মাঠে-ঘাটে-প্রান্তরে সবাইকে আপন করে নেয়া, সকল অবস্থানে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার এক অপূর্ব ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। মানুষকে তিনি ভালোবেসেছেন। মানুষ তাকে ভালোবেসেছে। এরই মধ্যে দিয়ে, ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে একজন সাধারণ মুজিব কালের আবর্তনে অনন্য, অসাধারণ বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন। 

সোহরাওয়ার্দী’র হাত ধরে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান, মুসলিম লীগের ভুল রাজনীতি। নেতার প্রতি সন্মান ও আনুগত্য প্রদর্শনে কার্পণ্য করেননি। ‘লড়কে লেঙ্গা পাকিস্তান’ আন্দোলনে তিনি ছিলেন নিষ্টাবান। তিনিই আবার পাকিস্তান থেকে বাইরে এসে বাংলাদেশের জন্মদাতা। পাকিস্তান স্বাধীন হলে সোহরাওয়ার্দী পশ্চিম এবং বঙ্গবন্ধু পূর্ব-পাকিস্তানে অবস্থান করলেও নেতার মৃত্যু পর্যন্ত বঙ্গবন্ধ তাকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন, শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ভুল করেননি। বাংলার মাঠেঘাটে ঘুরে এবং পাকিস্তানী শাসকদের বিমাতা সুলভ আচরণে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মুসলিম লীগের রাজনীতি বাঙ্গালীর জন্যে নয়! নেতার প্রতি শ্রদ্ধার পরও নেতার আদর্শ মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসতে খুব বেশি সময় নেননি। এ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু’র জীবনে এক আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়, একজন মুসলিম লীগার, মুসলিম আওয়ামী লীগকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক চেতনায় ‘আওয়ামী লীগ’-এ রূপান্তরিত করতে তাঁর ভূমিকা অনেক। ঐ সময়ে এটি নি:সন্দেহে এক যুগান্তরী ঘটনা। বাকি পঞ্চাশের দশক, ষাটের দশকের ইতিহাস সবার জানা। এরপর ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান বঙ্গবন্ধুকে বাংলার অবিসংবিদিত নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়। ৭ই মার্চ ১৯৭১-এ প্রমাণিত হয় ‘বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ’। এরপর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা।

আমি ইতিহাসবেত্তা নই, যা লিখছি তা মনের গরজ থেকে। আমি নিউইয়র্কে বসে তাঁর কথা বলছি, এটিও বঙ্গবন্ধু’র জন্যেই। যাঁরা তার বিরোধিতা করছেন, তাঁরাও তার দেয়া সবুজ পাসপোর্ট নিয়েই বিরোধিতা করছেন। অন্তত: এ জায়গাটুকু পর্যন্ত তাকে স্বীকার করে নিতে আপত্তি কোথায়? প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের সমালোচনা হতে পারে; ওআইসি-তে যাওয়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন, আবার বৈপরীত্য বাকশাল গঠন ইত্যাদি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হতে পারে, কিন্তু জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু বিতর্কের ঊর্ধ্বে। বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা মূলত: দেশ স্বাধীন হবার আগেই জনতা নির্ধারণ করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু’র অনুপস্থিতিতেই বাংলাদেশ-বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ একাকার হয়ে গিয়েছিলো। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু জাতির সম্পত্তি; আওয়ামী লীগের একক সম্পত্তি নয়। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু’র অনুসারী মানুষের সংখ্যা খুব কম নয়? বর্তমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যে ‘পচন’, বঙ্গবন্ধু প্রেমিকদের মধ্যে তা নেই? বঙ্গবন্ধু প্রেমিকরা ‘বঙ্গবন্ধু’ দোকান খুলে ব্যবসা করেন না।

১৯৭০’র নির্বাচন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ভোট পায় ৩৯.২%। সেবার পাকিস্তানের মোট ভোটার ছিলো ৫৬,৯৪১,৫০০। তন্মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানে ৩১.২১১,২২০ এবং পশ্চিম-পাকিস্তানে ২৫,৭৩০,২৮০। ভোট পড়েছিল ৬৩%। পূর্ব-পাকিস্তানে ভোট পড়েছিল আনুমানিক ১৯,৬৬৩,০৬৯ (৬৩x৩১,২১১,২২০/১০০=১৯,৬৬৩,০৬৯) ভোট। আওয়ামী লীগ পেয়েছিলো ১২,৯৩৭,১৬২ ভোট। আসন না পেলেও আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ভোট পড়েছিলো ৬,৭২৫,৯০৭ (১৯,৬৬৩,০৬৯-১২,৯৩৭,১৬২= ৬,৭২৫,৯০৭) ভোট। ৬৭ লক্ষের উপর এ ভোটগুলো কাদের? ভুট্টো’র পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস পার্টি) পূর্ব-বাংলায় ভোট পাওয়ার কোন কারন ছিলোনা, এই ভোটগুলো ছিলো মুসলিম লীগ এবং জামাত ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর। পাকিস্তানের ৩০০ আসনে ৮১টি সিট্ পেয়েছিলো পিপিপি এবং তারা ভোট পায় ১৮.৬%। তিনভাগে বিভক্ত মুসলিম লীগ পায় ১৩.৮% এবং ইসলামী দলগুলো ১৩.৯%। হিসাবটা পুরো পাকিস্তানের হলেও মুসলিম লীগ এবং ইসলামী দলগুলোর শক্তি স্বাধীন বাংলাদেশে একেবারে কম ছিলোনা। এরা পরাজিত হলেও সক্রিয় ছিলো, যা টের পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর। সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় পঞ্চম সংশোধনী বা ‘বিসমিল্লাহির রহমানের রাহিম’। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ রূপ নেয় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে। আরো পরে ১৯৮৮ সালে আসে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এ সবই সেই পাকিস্তানী ধারাবাহিকতার ফসল।

আওয়ামী লীগ একাধারে ক্ষমতায় এক দশকের একটু বেশি। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মাতামাতি করার মানুষ বা বঙ্গবন্ধু প্রেমিকের কোন কমতি নেই, ৭৪-৭৫’-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে আমরা এমন দৃশ্য দেখেছিলাম। তাই হয়তো রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমদ দুঃখ করে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্যে কোন বীরউত্তম, বীরবিক্রম এগিয়ে আসেননি’। কথাটা সত্য। প্রকৃতপক্ষে সেদিন আমরা কর্নেল জামিল ও কাদের সিদ্দিকী ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। আমাদের রাজনীতিকরা প্রায়শ: বলে থাকেন, বিদেশ অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু’র খুনীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জোর তৎপরতা চলছে। বঙ্গবন্ধু’র স্বীকৃত ও দণ্ডিত ১২ খুনির মধ্যে ৬ জন বিদেশে পলাতক। ২৭ জানুয়ারি ২০১০-এ ৫ জনের দণ্ড কার্যকর।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।

পাঠকের মতামত:

২৯ জুন ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test