E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

হার্বাটের শিক্ষা দর্শন

২০২৪ জুন ০৭ ১৬:২৯:০৬
হার্বাটের শিক্ষা দর্শন

মারুফ হাসান ভূঞা


শিক্ষাকে যুক্তি ও বিচার বুদ্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত করে, শিক্ষার সার্থক ও কার্যকরী পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন জন ফ্রেডরিক হার্বাট। রুশো, পেস্তালৎসি যে শিক্ষা আন্দোলনের ভীত রচনা করেছিলেন তাঁর বাস্তব রূপ যাঁরা দিয়েছেন তাদের মধ্যে হার্বাট হচ্ছে অন্যতম। রুশো, পেস্তালৎসির যে শিক্ষা দর্শন সেখানে যুক্তির চেয়ে মনের আবেদন বেশি। কিন্তু হার্বাট ছিলেন শিক্ষায় সুসংহত চিন্তার অধিকারী। তাই মনের আবেগের চেয়ে যুক্তি ও বিচার কে প্রাধান্য দিয়েছেন। যাঁর স্পষ্ট প্রকাশ হার্বাটের শিক্ষা দর্শনে দৃশ্যমান। হার্বাটের শিক্ষা দর্শন শুধু দর্শন হিসেবে রচিত নয়, একটি কার্যকরী পদ্ধতির সন্ধান দেখিয়েছেন। যা হার্বাটের পূর্ববর্তী জমানায় কেউ দিতে পারেন নি। হার্বাট যুক্তি ও বিচারের সমন্বয়ে পুরো শিক্ষা পদ্ধতিকে ভেঙে ভেঙে তত্ত্বগত ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ্লেষণ ও তত্ত্বের গভীরতা এতো নিখুঁত যে খুব সহজে এর গুরুত্বকে অনুভব করা যায়। 

হার্বাটের শিক্ষাতত্ত্ব

হার্বাটের মতে একটি একক পদার্থ থেকে কতগুলো বিচ্ছিন্ন শক্তিকে ভাগ করা যায় না। তেমনি শিক্ষা থেকে সমাজিক পরিবেশ ও আলাদা করা যায় না। হার্বাট একপ্রকার রুশোর শিক্ষার লক্ষ সম্পর্কিত সমাজ বিরোধী ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করেন।হার্বাটের মতে শিক্ষার লক্ষ হবে সামাজিক। শিশু যাতে সমাজে সার্থকভাবে বাঁচতে পারে তার জন্য শিশুকে সামাজিক ভাবে প্রস্তুত করা। অর্থাৎ শিশু জন্মগ্রহণ করার পর সমাজিক পরিবেশ তাঁর উপর প্রভাব করে ঠিকই, কিন্তু সে সামাজিক পরিবেশের উন্নয়নও জরুরি। শিশুকে সমাজ থেকে আলাদা করে যে শিক্ষা গ্রহণ করানো হবে। সে শিক্ষার প্রভাব কোথায় রাখা হবে? যেহেতু শিশু সমাজ থেকে আলাদা হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছে, সেহেতু সমাজে শিক্ষার কোনো প্রভাব পড়ছে না। বরং সমাজের উন্নয়ন থমকে যাচ্ছে। হার্বাট এই জন্যই মনে করেছেন রুশো ও পেস্তালৎসির শিক্ষা দর্শনে যুক্তি ও বিচারের চেয়ে মনের আবেগের প্রকাশ বেশি রয়েছে। হার্বাটের মতে শিক্ষকদের সর্বপ্রথম শিক্ষার্থীর চরিত্র ও সামাজিক ন্যায়বোধ বিকাশে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। যাতে শিক্ষার্থী চরিত্রের সুপ্রকাশ করতে পারে এবং সামাজিক ন্যায়বোধের বিকাশ ঘটিয়ে সামাজিক পরিবেশের বিকাশ ঘটাতে পারে। আত্মার সঙ্গে পরিবেশের সংঘাতের ফলে ভাষা ও জ্ঞানের উদ্ভাবন। এই বিভিন্ন ভাব ও সংবেদন জন্মের মুহূর্তে আমাদের মনে প্রবেশ করে থাকে বাধাহীন ভাবে।

সামাজিক ভাবে এর প্রভাব মনের উপর বর্তায় এবং পরবর্তী শিক্ষাকে প্রভাবিত করে। এই জ্ঞান ও ভবনগুলোর মধ্যে আমাদের সচেতনতার কেন্দ্রস্থল যে গুলো অধিকার করে সেগুলো আমাদের উপর বেশি প্রভাব রাখে। আবার কোনো কোনো ভাব ও জ্ঞান অর্জন আমাদের সচেতনতার সীমারেখার নিচে চলে যায়, সেগুলো আমরা তখনই ভুলে যায়। অর্থাৎ ভাব ও জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে সচেতনতার কেন্দ্রস্থলও প্রাথমিক ভাবে সামাজিক ভাবে অর্জিত হয়। হার্বাটের মতে দুটি বৈশিষ্ট্য জ্ঞান বা ভাবকে সচেতন মনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থান করতে সাহায্য করে। একটি হলো সাদৃশ্য, অপরটি বৈসাদৃশ্য। পরিবেশের প্রভাবে আসাদের জ্ঞান ও ভাব বিশেষ বিশেষ সম্মেলনে আবদ্ধ হয়। আমরা কোনটির প্রতি মনোযোগ দেব এবং কোনটির প্রতি দেব না সেটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে একটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। হার্বাট এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছেন আত্নবীক্ষণ বস্তুপুঞ্জ। অর্থাৎ জ্ঞান বা ভাব অর্জনে ব্যক্তির মানসিক পটভূমিকা প্রকৃতি ও সমাজিক প্রকৃতি সবচেয়ে প্রয়োজনীয় শক্তি। নতুন জ্ঞান আমরা পুরাতন জ্ঞানের মাধ্যমে অর্জন করে থাকি।

হার্বাটের পঞ্চসোপান পদ্ধতি

হার্বাটের আত্নবীক্ষণ তত্ত্ব থেকে জন্মলাভ করেছে সোপান পদ্ধতি। আমরা যখন কোন বস্তু প্রত্যক্ষ করি তখন প্রকৃত পক্ষে সে বস্তুটি আত্নবীক্ষণ করে থাকি। সে আত্নবীক্ষণ পলে নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন ঘটে। সামগ্রিক ভাবে পুরানো থেকে নতুন এবং জ্ঞাত থেকে অজ্ঞাতে যাওয়ার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত সোপান পদ্ধতি। হার্বাটের পঞ্চসোপান গুলো হলো- প্রস্তুতি, উপস্থাপন, অনুষঙ্গ, সামান্যীকরণ, অভিযোজন।

প্রস্তুতি: শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পাঠদান প্রদানের পূর্বে শিক্ষার্থীর পূর্বের জ্ঞানকে যাচাই করে নতুন জ্ঞান আহরণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নিবেন। এতে শিক্ষার্থী নতুন জ্ঞান আহরণের প্রতি মানসিকভাবে প্রলুব্ধ হবে। পূর্বের জ্ঞান প্রকাশের ফলে নতুন জ্ঞান আহরণে শিক্ষার্থী স্ব প্রণোদিত হয়ে মনোযোগ দেবে।

উপস্থাপন: শিক্ষকের বর্ণনা, আলোচনা শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে ব্যাবহারিক ভাবে বুঝানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অর্থাৎ শিক্ষার্থীর উদ্দেশ্যে যে পাঠ বা আলোচনা উপস্থাপিত হবে সেটি যাতে শিক্ষার্থী নিজস্ব পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা ক্রিয়ার মাধ্যমে উৎফুল্ল হয়ে আয়ত্ত করতে পারে সে ব্যবস্থার আয়োজন করতে হবে।

অনুষঙ্গ স্থাপন: হার্বাটের মতে এই ধাপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই ধাপে শিক্ষার্থীর সাথে স্বাভাবিক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষঙ্গ স্থাপিত করতে হবে। শিক্ষার্থীর সাথে অনুষঙ্গ যত স্বাভাবিক ও সুষ্ঠু হবে, শিক্ষার্থীর অণুবীক্ষণ ও জানবার তাড়না তত সুদৃঢ় ও স্থায়ী হবে। অর্থাৎ শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পূর্বে অর্জিত জ্ঞানের সাথে আজকের পাঠে লব্ধ জ্ঞানের তুলনা করে কোন কোন ক্ষেত্রে মিল নরই তা দেখিয়ে দেবেন। এতে পুরাতন জ্ঞানের সাথে নতুন জ্ঞানের সমন্বয় ঘটবে।

সামান্যীকরণ: সাধারণ সূত্র গঠন যা শিক্ষার্থীকে নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবনে ব্যাপক সহযোগিতা করবে। শিক্ষক কতগুলো বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে সাধারণ সূত্র গঠন করে প্রদর্শন করবেন।

অভিযোজন : অভিযোজন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞান ও তার ব্যবহারের দক্ষতা পরিমাপ করা হবে। শিক্ষার্থী যে-সব নতুন উদ্ভাবিত সূত্র বা তত্ত্ব আহরণ করে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে নতুন সমস্যার সমাধান করবে।

হার্বাটের যুগ কৃষ্টি তত্ত্ব

শিক্ষাক্রম রচনায় হার্বাট তাঁর আত্নবীক্ষণ তত্ত্বের প্রয়োগ করেছেন। শিক্ষাক্রমেন বিষয়বস্তু নির্ণয়ে হেগেলের মত হার্বাট ও ইতিহাস পাঠের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে পূর্বের মানুষের যে জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি এবং সমস্যা ছিল। সেটি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা অর্জন করে যুক্তি ও বিচারের মাধ্যমে সংযোজন এবং বিয়োজন করা। যুগ কৃষ্টি তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো বিবর্তনের দীর্ঘ সময়ে মানুষ জাতিগত ভাবে যে সব বিচিত্র অবিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর ও অগ্রগামী হয়েছিল। এবং সে সমস্ত যুগে মানুষের সম্মিলিত ভাগ্যকে নির্ধারণ করেছিল। সে সংগ্রামের সাথে পরিচিত করানোর জন্য নির্দিষ্ট বিষয়ের উপস্থাপন থাকতে হবে। যাতে শিশু সেসব ইতিহাসের সাথে পরিচিত হতে পারে। যাতে পুরাতন অবিজ্ঞতা সম্পর্কে জেনে নতুন অভিজ্ঞতায় সে সংগ্রামের চর্চাকে আয়ত্ত করতে পারে।

হার্বাটের আগ্রহ তত্ত্ব

হার্বাটের আগ্রহ তত্ত্ব শিক্ষা দর্শনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তত্ত্ব হিসেবে আবির্ভাব হয়েছে। হার্বাটের মতে শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও প্রচেষ্টা ছাড়া শিক্ষা হয় না। শিক্ষার্থীর শিক্ষা আহরণে আকর্ষণ সৃষ্টি করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি অংশ। প্রচলিত মতানুযায়ী আগ্রহের অভাব পূরণ হয় প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। কিন্তু হার্বাটের মত অনুযায়ী আগ্রহ তৈরির মাধ্যম হচ্ছে শিক্ষার্থীর মধ্যে পূর্বে আহরণ করা ভাব বা ধারণা কর্তৃক নতুন উদ্ভাবিত ভাব বা ধারণা গ্রহণ করার প্রবণতা। সুতরাং যখনই উপস্থাপিত বস্তু বা ভাবের সঙ্গে শিক্ষার্থীর আয়ত্তীকৃত পুরাতন বস্তু বা ভাবের সম্পর্ক মিশ্রিত থাকে তখনই তার প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহ জন্মে। শিক্ষার্থী সে জ্ঞান ও ভাব আহরণে প্রলুব্ধ হয়ে আকর্ষিত হয়ে পড়ে। হার্বাট আগ্রহকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন- স্বতঃপ্রসূত ও আরোপিত।

স্বতঃস্ফূর্ত : শিক্ষার্থী অভ্যন্তরীণ চিন্তাগত অবস্থান থেকে যে ভাবগুলো নিজস্ব ভাবনার মাধ্যমে নতুন ভাবকে সরাসরি গ্রহণ করে নেয়। বা নির্দিষ্ট কোনো বাঁধা কিংবা সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হয় না। সে সব ভাব গ্রহণের আগ্রহ হয় স্বতঃপ্রসূত।

আরোপিত: শিক্ষার্থী অভ্যন্তরীণ চিন্তাগত অবস্থানের বাহিরে, নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতার আবদ্ধ থেকে যে আগ্রহ অর্জন করে। অর্থাৎ শিক্ষার্থী উপদেশ, অনুশাসন, শিখন ইত্যাদি দ্বারা শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ অর্জন করে সেটি হচ্ছে আরোপিত।

হার্বাটের অনুবন্ধতত্ত্ব

হার্বাটের অনুবন্ধতত্ত্ব শিক্ষার্থীর পাঠ্যবিষয় সম্পর্কিত, হার্বাটের মতে পাঠ্যবিষয় শিক্ষার্থীদের নিকট উপস্থাপনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থাকে বিবেচনায় রাখতে হবে। শিক্ষার্থী যাতে পাঠকে খুব স্বাভাবিক ভাবে বিনা আয়াশে গ্রহণ করতে পারে, মনের যে পূর্ব প্রত্যাশিত অবিজ্ঞতা পাঠ্যবিষয় সম্পর্কিত সেটি যাতে সে স্বাভাবিক ভাবেই এক করে নিতে পারে। অর্থাৎ পাঠ্য বিষয়গুলো যদিও স্বতন্ত্র তবুও সেগুলোর মধ্যে মৌলিক সমন্বয় করে বাস্তবিক তথ্যের শিক্ষার্থীদের মাঝে তুলে ধরা। এই জন্য হার্বাট দুটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে বলেছেন- উপযুক্ত পাঠ্যবিষয় নির্বাচন এবং বিষয়টি উপস্থাপনের জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি অনুসরণ।

উপযুক্ত পাঠ্যবিষয় নির্বাচন: এই ক্ষেত্রে হার্বাটের মত পাঠ্য বিষয়গুলোর মধ্যে মৌলিক ঐক্য এবং যোগসূত্র বর্তমান, সে তথ্যটি শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে বুঝিয়ে দিতে হবে যাতে শিক্ষার্থী পাঠ্যবিষয়গুলোর আকারগত বিষয় গুলোকে একটি একক সত্তার বিভিন্ন অংশ হিসেবে আয়ত্ত করে। অর্থাৎ বিষয়ের স্তর যাতে একমুখী হয়।

বিষয়টি উপস্থাপনের জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি অনুসরণ: যে একমুখী বিষয়টি নির্ধারিত হবে বা কেন্দ্রীয়করণ হবে সে বিষয়টির সঙ্গে অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে প্রদর্শনের মাধ্যমে পরিক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আয়ত্ত করাতে হবে।

সুতরাং হার্বাটের যে আধুনিক শিক্ষা দর্শন, সেটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনুসরণ ও অনুকরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। হার্বাটের আগ্রহতত্ত্ব, পঞ্চাসোপান পদ্ধতি কিংবা যুগ কৃষ্টি তত্ত্ব শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের অবদান। আধুনিক শিক্ষায় হার্বাটের আগ্রহতত্ত্ব শিক্ষার পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। দেশের কারিকুলাম বা শিক্ষাপদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে হার্বাটের দর্শন সম্পর্কে অবিজ্ঞতা অর্জনও জরুরি।

লেখক : লেখক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test