E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

গল্প

অচেনা ভিড়ে..

২০২৫ এপ্রিল ১৩ ১৭:৪৯:০৩
অচেনা ভিড়ে..










 

মীর আব্দুর আলীম

আকাশে কাক ডাকার শব্দ, বাতাসে নতুন ধান শুকানোর গন্ধ। আর ছিল এক টুকরো বৈশাখ-যেখানে রঙিন কাগজের ঘুড়ি উড়তো, ঢোল বাজতো, আর মেলার চাতালে পা রাখলেই মাটির খেলনার দোকান থেকে ডাক আসত-”এই যে ভাইসাব, হাঁস নেবেন?”

শান্ত তখন ক্লাস ফোরে পড়ে। দাদার হাত ধরে মেলায় যেত। পাজামা-ফতুয়া পরে পকেটে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট। সেই টাকায় কিনতো খই, মুড়কি, মাটির গরু, আর কখনো কখনো একটা বাঁশি।
রুপগঞ্জের শতবছরের গোলাকান্দাইল মেলা। সেদিন আকাশটা ছিল নীল। শান্তর পাশে থাকত জেবা। ওদের বাড়ি ছিল একদম পাশেই। মেলার ভিড়ে হাতটা ছিঁড়ে না যায় তাই শান্তর হাত আঁকড়ে ধরত জেবা।

- এই বাঁশিটা নিবি? - নে তোকে দিচ্ছি। বলেই দাদাকে বলে- ওকে বাঁশিটা কিনে দাও না দাদু। এভাবেই চলে জেবা শান্তর ছোট বেলা।

একদিন হঠাৎ করেই শুনল, জেবার বাবার শহরে চাকুরী হয়েছে। আর ওরা চলে যাবে।
কেউ কিছু বলল না। শুধু চলে গেল। খুব সকালে ট্রেন ধরবে-শুধু এইটুকু শুনে ছুটে গিয়েছিল শান্ত, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে।

জেবার চোখে জল ছিল।

-ঠিক একদিন ফিরে আসবো, শান্ত। তুই বাঁশিটা রেখে দিস।

বছর দশেক পরে শান্তর পা পড়ে ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সে। মাটির খেলনা আর বাল্যপ্রেম পেছনে ফেলে এসেছে সে অনেক আগেই, কিন্তু ভুলে যায়নি। সেদিন সেমিস্টারের প্রথম ক্লাস। সবার ভিড়ে শান্তর পাশে বসে এক মেয়ে। কপালে টিপ, চোখে কাজল।
নাম জানতে চায় শান্ত।

- আমি আফরিন জাহান।
ওর হাসিটা বড় চেনা লাগে। কেমন যেন পুরনো দিনের ঘ্রাণ লেগে থাকে। দিন যায়, সম্পর্ক গাঢ় হয়। এক বিকেলবেলা শান্ত বলে ফেলে,
- তোমাকে আমার ভালো লাগে।
আফরিন অবাক হয় না। কেবল হালকা হেসে বলে,
- আমি জানতাম।

একটা ছুটির দুপুরে আফরিন আর শান্ত ক্যাম্পাসে বসে চা খাচ্ছে। হঠাৎ শান্ত প্রশ্ন করে,
- তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়?
আফরিন বলে,
- রূপগঞ্জ। ভুলতা।
শান্তর হাত থেকে কাপটা পড়ে যায়। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
- তোমার ছোটবেলার নাম কি ‘জেবা’ ছিল?
আফরিন চুপ করে থাকে। একটুখানি কেঁপে ওঠে।
- তুই তাহলে শান্ত?

এরপর কোনো কথা হয় না। শুধু দুটো মানুষ আবেগে চোখ ভিজিয়ে ফেলে। হারিয়ে যাওয়া একটা ছোট্ট বাঁশি যেন ফিরে আসে ঝর্ণার শব্দ হয়ে।

এরপর জীবন যেন ঘুরে দাঁড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ হয়, প্রেম গভীর হয়। কিন্তু এ প্রেম কোনো এক রাতের এসএমএসে শুরু হয়নি, এ প্রেমের গোড়াপত্তন হয়েছিল এক মেলায়, এক জোড়া হাত ধরা আর একটা মাটির হাঁস কেনা দিয়ে।

দুজনেই বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। পোস্টিং পড়ে দূরে দূরে। কিন্তু মনের দূরত্ব কোনোদিন হয়নি।
বিয়ের সময় জেবা বলেছিল,

- বাঁশিটা কি তোর কাছে এখনো আছে?
শান্ত হেসে বলেছিল,
- তোকে দেয়ার জন্যই রেখেছিলাম এতদিন।

বিয়ের পর ভুলতার পুরনো বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল তারা। উঠোনে দাঁড়িয়ে জেবা বলেছিল,
- এই গাছটার নিচে বসে আমরা মুড়কি খেয়েছিলাম।
শান্ত বলেছিল,

- এইখানেই আমি প্রথম হাত ধরেছিলাম তোর।
দাদু তখনো বেঁচে। চোখে চশমা, হাতে লাঠি। বলেছিলেন,
- দ্যাখো বউমা, ছোট্ট শান্ত আর জেবা আজ সত্যি বড় হয়ে গেছে। মানুষ কতদূরই যাক, ফিরে আসে মাটির টানে।
এখন তাদের একটা মেয়ে হয়েছে। নাম রেখেছে ‘পলাশী’।
শান্ত মাঝেমাঝে পুরনো বাক্স খুলে দেখে—একটা ছোট বাঁশি পলিথিনে মোড়া, পাশে একটা জোড়া মাটির হাঁস।
জেবা হেসে বলে,
- তোর প্রেম তো তখনই হয়েছিল।
শান্ত মাথা নেড়ে বলে,
- না, প্রেম তখন হয়নি। প্রেম হয়েছিল যেদিন তুই ফিরে এলি, আর আমার বাঁশিটা চিনে ফেললি।”

পাঠকের মতামত:

১৫ এপ্রিল ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test