E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

বীর মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকুর রহমান চৌধুরী

২০১৭ জানুয়ারি ১৭ ১২:৫৮:০৫
বীর মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকুর রহমান চৌধুরী

আবু নাসের হুসাইন: ঐতিহ্যবাহী ফরিদপুর জেলার কৃতি সন্তান যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মোঃ সিদ্দিকুর রহমান চৌধুরী। যার রাষ্ট্রীয় সনদ নং- ম/৮৭৫৫১ গেজেট নং- ২৫৯৬। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং বর্তমান রাজধানী ঢাকার মতিঝিল এলাকার ৯ ও পুরাতন ৫২ নং ঢাকা মহানগর ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ১৯৭৭-৭৮ এবং মহানগর আওয়ামীলীগের ত্রাণ কমিটির সন্মানিত সদস্য। ১৭ জানুয়ারী মঙ্গলবার তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে সবাইকে কাদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান সিদ্দিকুর রহমান।

মুক্তিযুদ্ধের এই বীরসেনা মোঃ সিদ্দিকুর রহমান চৌধুরী গতবছর ১৭ জানুয়ারি ২০১৬ রবিবার সকাল ১১ টায় মতিঝিল আরামবাগে তার নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, ফুসফুসে ক্যান্সার সহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৬৮ বছর।

ঐ দিন বাদ আছর তার প্রথম নামাজে জানাজা আরামবাগ জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর নিজ গ্রামের বাড়ী ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার ফুলসুতী গ্রামের স্কুল মাঠে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস.এম. আব্দুল কাদের এর নেতৃত্বে থানা পুলিশের একটি চৌকস দল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান শেষে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন পূর্বক দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাদা, বাবা ও বোনের কবরের পাশে দাফন করা হয়।

মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে ও নাতি-নাতনীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। দাফন শেষে পরম করুণাময়ের নিকট তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করা হয় এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন উপস্থিত সর্বস্তরের মানুষ।

সে সময় উপস্থিত বাক্তিবর্গের মধ্যে ছিলেন, নগরকান্দা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমাণ্ডার মোঃ ফজলুল হক, নগরকান্দা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোঃ আবু বকর মিয়া, নগরকান্দা থানার অফিসার ইনচার্জ সৈয়দ আব্দুল্লাহ, নগরকান্দা উপজেলা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি বেলায়েত হোসেন মিয়া, নগরকান্দা উপজেলা পরিষদ এর সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ মনিরুজ্জামান সরদার, বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ আরিফ মিয়া, সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ডাঃ আঃ সাত্তার চৌধুরী, সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ বকুল চৌধুরী, কেন্দ্রীয় শ্রমিক লীগ সহ-সভাপতি হাজী মোঃ ফিরোজ হাসান চৌধুরী, বাংলাদেশ কিন্ডার গার্টেন এসোসিয়েশন এর চেয়ারম্যান মোঃ নুরুজ্জামান কায়েস, জেলা বিভাগীয় সমিতির সেক্রেটারি মোঃ আনোয়ার হোসেন দুলু প্রমুখ।

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার কৃতি সন্তান সিদ্দিকুর রহমান। একাত্তরের রণাঙ্গণের বীর সৈনিক যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মোঃ সিদ্দিকুর রহমান চৌধুরি ছিলেন এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। ১৯৪৭ সালের ২ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার ফুলসুতী গ্রামের চৌধুরী বাড়ীর (বড় বাড়ী) মরহুম আঃ খালেক চৌধুরীর মেঝো ছেলে মরহুম মোঃ সিদ্দিকুর রহমান চৌধুরী। খুব ছোট থেকেই তিনি ছিলেন একজন সাহসী, সদা হাস্যোজ্জ্বল, মিষ্টভাষী ও প্রগতিশীল মনের অধিকারী, প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন সফল মানুষ। যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ গঠনের সাহসী এক যোদ্ধা, একজন সফল ব্যাবসায়ী, পরোপকারী সাদা মনের মানুষ।

দেশপ্রেম একজন মানুষকে কতটা শক্তি দিতে পারে তা তিনি দেখিয়ে গেছেন একাত্তরে রণাঙ্গনে ৯ নং সেক্টরের মেজর এম.এম. জলিল এর অধিনে যে কয়েক’শ মুক্তিযোদ্ধা বৃহত্তর ফরিদপুরের বৃহৎ অংশে জীবন বাজি রেখে বীরত্বপূর্ণ অবদানের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন, তাদের মধ্যে মরহুম মোঃ সিদ্দিকুর রহমান চৌধুরী ছিলেন অন্যতম।

১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে ঢাকা শহরের মতো সারা দেশেই পাক সেনাদের চলছে তান্ডব। শহরে শহরে ঢুকে পাকিস্তানি আর্মি ব্যাপক গণহত্যা চালাচ্ছে। হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। যুবকদের গুলি করে আর বেয়োনেটের খোঁচায় নির্মমভাবে হত্যা করছে। আতঙ্কিত হয়ে শহরের লোকজন গ্রামে দিকে পালাতে থাকে। এদিকে গ্রামের মানুষগুলোর অধিকাংশই তখন সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। সদ্য ২৪ বছরে পা রাখা টকবগে এক যুবক মোঃ সিদ্দিকুর রহমান দাঁড়িয়ে দেখছেন সে দৃশ্য। আর মনের মধ্যে গুঞ্জন করছে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু অস্ত্রধারী পাক সেনাদের কিভাবে রুখবে সে? এরপর খবর নিয়ে জানতে পারে অনেকই গোপনে চলে গেছে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দিতে। তেজোদীপ্ত যুবক মোঃ সিদ্দিকুর রহমানের মনে ঝড় ওঠে। বাড়ীর কাউকে না জানিয়ে এই বীর সেনানী ভরাযুদ্ধের মধ্যেই হেটে হেটে ২৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ২৮ জুন ১৯৭১ সালে বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি থানার সংখ্যার হাট গ্রামের সহপাঠী সহযোদ্ধা শেখ নিজামুদ্দিন কে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং এর জন্য তখনকার গোপালগঞ্জ থানার কমান্ডার বীর হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রম’র অধীনস্ত কোটালিপাড়ার জহরেরকান্দি হাই স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন। একটানা দীর্ঘ ২ মাস গেরিলা ট্রেনিং শেষে কোটালীপাড়ার রাজাপুর মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে অবস্থান করে গেরিলা কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে যুদ্ধে যোগদান করেন।


দেশমাতৃকার প্রতি তার অসীম মমত্ববোধের কারণে স্বতস্ফূর্তভাবে তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সৈনিক হেমায়েত উদ্দিন বীর বিক্রমের সাথে সরাসরি অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একেক’টি খন্ডযুদ্ধ তখন কেড়ে নিচ্ছিল দু-তিনটি সহ-যোদ্ধাদের তাজা প্রাণ তবুও তিনি দমে যাননি। তেজদীপ্ত বারুদের মতো জ্বলে উঠে তিনি সফলতার সাথে ফরিদপুরের কালকিনি, পয়সারহাট, কাশিয়ানি, গোপালগঞ্জ এবং মাদারীপুরের পশ্চিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকে হানাদারমুক্ত করতে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেন। ২৪ শে নভেম্বর ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমি কোটালীপাড়া কে পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত করতে সম্মুখসমরে তুমুল যুদ্ধচলাকালে শত্রু পক্ষের ম্যাশিনগানের বুলেটে বা’পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক জখম হন। পরে সহ যোদ্ধাদের সহায়তায় আহত অবস্থায় লেবুবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিকিৎসা ক্যাম্পে প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহন করেন। যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীনতার পরে আঘাত প্রাপ্ত স্থানে ইনফেকশন হওয়ায় ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ক্ষতস্থানে অপারেশন করে সুস্থ্যতা লাভ করেন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলার ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। অসীম সাহসের সাথে সমরাস্ত্র কাঁধে সম্মুখপানে এগিয়ে চলার যে অদম্য শক্তি তা কোথা হতে আসে? জাতিকে শত্রুমুক্ত করে একটি মানচিত্র, একটি পতাকা, একটি ভূখন্ড উপহার দেয়া কি এতোই সহজ? শত্রুর বেয়োনেটের খোঁচায়, বুলেটের আঘাতের রক্তস্রোতে যখন মাতৃভূমি তার তৃষ্ণা মেটায়, হাজারো মা-বোনের সম্ভ্রম যখন হায়েনার তিখœ নখের আঁচড়ে দগদগে ক্ষত বয়ে বেড়ায়, তখনইতো স্বাধীনতার লিপ্সায় টগবগ করে উঠে তাগড়া যোয়ানের খুন। স্বাধীনতা তখনই তার প্রাপ্য হয়ে যায়। যা থেকে পৃথিবীর কোন হানাদার তাকে বঞ্চিত করতে পারে না। স্বামীর ও বাবার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এমনই অনভূতি প্রকাশ করছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মোঃ সিদ্দিকুর রহমান চৌধুরীর সহ-ধর্মীনী স্ত্রী শেফালি রহমান চৌধুরী ও মেয়ে লুবনা আক্তার।

“আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি তবে শুনেছি এক বীরত্বগাথা বীর মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধের কাহিনী যা বাংলার ইতিহাসে চীর অম্লান হয়ে রবে। যতোই শুনেছি, ততোই মুগ্ধ হয়েছি, অপলক দৃষ্টিতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রবণ করেছি রণাঙ্গনে লড়াইয়ের সেই বীরযোদ্ধার খুরধার ইতিহাস। পরিশেষে বলবো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অনেক অনেক বড় একটি বিষয়, এর ইতিহাসের খুব সামান্য অংশই লেখা হয়েছে; স্বাধীনতার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ‘অরক্ষিত’ রাখা চলে না, তাই অনাগত হাজার বছর ধরে তিলে তিলে রচিত হবে এর ইতিহাস। শুধু আমরা লিখব না, লিখবে আমাদের সন্তানেরা, তাদের সন্তানেরা, তাদেরও সন্তান-সন্ততিরা”।

(এএনএইচ/এস/জানুয়ারি ১৭, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test