E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

সেতু নির্মাণে সাম্ভাব্য ব্যয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা

সেতুর অভাবে বিছিন্ন ২৪ গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ 

২০২৫ মার্চ ১৩ ১৭:৪৪:২২
সেতুর অভাবে বিছিন্ন ২৪ গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ 

মোহাম্মদ সিরাজ আল মাসুদ, টাঙ্গাইল : গ্রীষ্মে সূর্যের প্রখরতা ও বর্ষায় খেয়া এবং শীতে ঘন কুয়াশা ভেদ করে চরাঞ্চলের মাইলের পর মাইল রাশি রাশি বালু মাড়িয়ে নিদারুণ কষ্টে দীর্ঘদিন ধরে চলাচল করছেন ৩০ হাজার মানুষ। খরস্রোতা ধলেশ্বরী নদীর প্রকোপে একটি ইউনিয়ন দ্বীপে পরিনত হয়েছে। একটি মাত্র সেতুর অভাবে জনজীবনে বিরুপ প্রভাব পরেছে। আধুনিক টাঙ্গাইলের বাইওে বসবাস করছেন হাজার হাজার মানুষ। উন্নত টাঙ্গাইলে সদর উপজেলার মাহমুদনগর ইউনিয়নের এ চিত্র যেন বাত্তির নিচে অন্ধকার।

টাঙ্গাইল শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার পশ্চিমে প্রায় ২৪টি গ্রাম নিয়ে ৩০ হাজার মানুষের বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের নাম মাহমুদনগর ইউনিয়ন । ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ ইউনিয়নে চার হাজার ২০০টি পরিবারের বসবাস। নদীর পলিমাটির পাঁচ হাজার ১২৫ একর আবাদী জমি এবং ১৫টি বিল নিয়ে জলধারা রয়েছে ২২টি। রয়েছে একটিমাত্র ডাকঘর। বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপাঞ্চলে শিক্ষার হার ৭০ দশমিক পাঁচ শতাংশ। প্রধান পেশা প্রবাসী আয় ও কৃষি। পলিধোয়া সোনালী ফসলের আধার হিসেবে পরিচিত এলাকাটি ২০০৪ সাল পর্যন্ত সদর উপজেলার কাতুলী ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানের জন্মস্থান এ ইউনিয়নের মাকোরকোল গ্রামে হওয়ায় তার প্রচেষ্টায় ২০০৪ সালে ‘মাহমুদনগর’ স্বতন্ত্র ইউনিয়ন হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাঁর কল্যাণেই এ ইউনিয়নে অনেকগুলো পাকা সড়কের দেখা মেলে।

সরেজমিনে জানা যায়, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাতুলী ইউনিয়ন সংলগ্ন গোলচত্বর থেকে ধলেশ^রী নদী পাড়ি দিয়ে মাহমুদনগরের মাকোরকোল গ্রামে যেতে হয়। গোলচত্বর ও মাকোরকোলের মাঝখান দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার প্রশস্ত ধলেশ্বরী নদী। পাশের নাগরপুর ও সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলা থেকে মাহমুদনগরের মাকোরকোলে নদীতীরে এসে ওই এলাকার মূল পাকা সড়ক পৌঁছেছে।

মাহমুদনগর ইউনিয়নের ছাত্র-ছাত্রী, ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী সহ সিরাজগঞ্জের চৌহালী, নাগরপুরের ভাড়রা ইউনিয়নের পশ্চিম অংশের হাজারো মানুষের চলাচলের একমাত্র রাস্তা। এপাশে গোলচত্বর পর্যন্ত পাকা সড়ক রয়েছে। মাঝখানে প্রায় এক কিলোমিটার প্রস্থের ধলেশ্বরী নদী। ওই এক কিলোমিটারে গ্রীষ্মকালে ধূ ধূ বালুচর, বর্ষায় শুধু পানি আর পানি এবং শীতকালে ঘন কুয়াশার রাজত্ব থাকে। এতদাঞ্চলের মানুষ ওই এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে চরম ভোগান্তির শিকার হয়। গ্রীষ্মে সূর্যের খরতাপে ফুটন্ত বালুর সমুদ্রে পায়ে হেঁটে ধলেশ্বরী নদী পাড় হওয়ার কষ্ট না গেলে অনুভব করা প্রায় অসম্ভব। বর্ষাকালে যৌবনা নদীতে খেয়াপাড় পাড় হতে গিয়ে একবার মিস করে অনেকেই জীবনের মূল্যবান ধাপ চাকুরি কিংবা পরীক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ার যন্ত্রণা ভোগ করছেন। বর্ষায় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে খেয়া নৌকায় নদী পারাপার হওয়ার যন্ত্রণা ওই এলাকার ভোগান্তির অপর নাম। যাপিত জীবনের পরীক্ষায় এটা নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে গেছে। অসুস্থ রোগীকে জরুরি প্রয়োজনে জেলা সদরে নিতে না পেরে অনেকে অকালে জীবনও হারিয়েছে। মাহমুদনগর ইউনিয়ন হওয়ার আগে থেকে স্থানীয়রা গোলচত্বর থেকে মাকোরকোলে ধলেশ্বরী নদীতে একটি সেতুর দাবি করছেন। কিন্তু বার বার জনপ্রতিনিধিদের কাছে ওই দাবি উপেক্ষিতই হয়েছে।

মাহমুদনগর ইউনিয়নের মালেয়েশিয়া প্রবাসী জহিরুল ইসলাম জানান, একটা সেতুর অভাবে মাহমুদনগর ইউনিয়নবাসীকে দীর্ঘকাল ধরে অবহেলিত থাকতে হচ্ছে। ফলে এ এলাকার জীবনযাত্রার মান মূলধারার জীবমানের সঙ্গে খাপ খায়না। এখনও অনেকটা অন্ধকারে রয়েছে এলাকার মানুষ। তিনি জানান, মাহমুদনগর ইউনিয়নের গ্রামগুলোর মাটি অত্যন্ত উর্বর। এ ইউনিয়নে প্রতিবছর ধান, পাট, গম সহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ হয়ে থাকে। ধলেশ্বরী নদীর টাটকা মাছও সেখানে প্রসিদ্ধ।মাহমুদনগর ও আশেপাশে অনেকগুলো হাট রয়েছে। এরমধ্যে শাহ্জানী, করিমগঞ্জ, বালিয়াপাড়া, চাঁনবয়রা, কাতুলী অন্যতম। এসব হাটে গ্রামের মানুষ ছাড়াও শহরাঞ্চলের মানুষ অল্প খরচে পণ্য কিনতে ভির করেন।

তিনি আরও জানান, এ ইউনিয়নে মেজর মাহমুদুল হাসান উচ্চ বিদ্যালয় ও বালিয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় নামে দুইটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি পূর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্র কারিগরি স্কুল, ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি ফাজিল ও একাধিক হাফিজিয়া মাদ্রাসা রয়েছে। ৩০ হাজার মানুষের স্বাস্থ্য সেবার জন্য ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রই একমাত্র ভরসা। তিনি এতদাঞ্চলের মানুষের কষ্টের জীবন থেকে পরিত্রাণ দিতে ধলেশ্বরী নদীর ওই অংশে সেতু নির্মাণের দাবি জানান।

স্থানীয় কৃষক মুন্নাফ আলী, আব্দুল জব্বার, আরফান আলী সহ অনেকেই জানান, ধলেশ্বরী নদীতে সেতু না থাকায় তারা কৃষিপণ্য চাষ করেও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। সেতুর অভাবে উৎপাদিত ফসল বিক্রির জন্য সময়মতো বাজারে নিয়ে যেতে পারেন না। এছাড়া খেয়া পাড়ি দিয়ে বা নদীর তপ্তবালু পেড়িয়ে হাট-বাজারে যেতে সময় বেশি লাগার সঙ্গে খরচও অনেক বেশি হয়। শহরে পণ্য বিক্রি করে এজন্য তাদের পোষায়না। গ্রামেও বিক্রি করলে দাম অনেক কম হয়।

মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শান্তা আক্তার, শামসুন্নাহার, আরশেদ আলী সহ অনেকেই জানান, বর্ষাকালে নৌকায় আর অন্য সময় তপ্তবালু পথে পায়ে হেঁটে চলাচল করতে তাদের খুবই কষ্ট হয়। নদীর উপর সেতু নির্মিত হলে তাদের কষ্ট লাঘব হবে।

স্থানীয় ভ্যানচালক শরিফুল ইসলাম জানান, বর্ষায় নদী পথে নৌকায় ভ্যান উঠানো আবার অন্য সময়ে বালুপথে ভ্যান চালানো খুবই কষ্টকর। বর্ষায় খেয়া নৌকায় ভ্যান ওঠাতে অনেক সময় নদীতে পড়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে।

প্রায় ২৬ বছর যাবত ওই স্থানের খেয়াঘাটের ইজারাদার মো. সোবহান মিয়া জানান, সেতু নির্মাণ করা হলে এলাকার মানুষের কষ্টের অবসানের পাশাপাশি জীবনমান উন্নত হবে। কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবে।

তিনি জানান, নদী পাড় হতে প্রতি মোটরসাইকেল ১০টাকা, সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও প্রাইভেট কারের ইজারা ৩০টাকা হলেও বেশিরভাগই ১০-১৫ টাকা দিয়ে চলে যায়। আবার অনেকে টাকা না দিয়েই চলে যান। অথচ প্রতি বছরে প্রায় দেড় লাখ টাকায় খেয়াঘাটটি তিনি ইজারা নেন।

সুবর্ণতলী গ্রামের আমির মোল্লা, কুকুরিয়া গ্রামের কামরুল, শাহজানীর শফিকুল, সিরাজুল ইসলাম, আব্দুর রহমান ও মাকোরকোল এলাকার রাওয়ান বিবি জানান, ধলেশ্বরী নদীর উপর সেতু নির্মাণের দাবি দীর্ঘ দিনের। জনপ্রতিনিধিরা বার বার আশ্বাস দিলেও এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ সেতু নির্মাণ করা হলে পশ্চিম টাঙ্গাইলের অর্থনীতি অনেক সমৃদ্ধ হবে।

জনতা ব্যাংকের টাঙ্গাইল কর্পোরেট শাখার এজিএম জাহাঙ্গীর আলম জানান, তাঁর গ্রামের বাড়ি মাহমুদনগর ইউনিয়নে। ধলেশ্বরী নদীতে সেতু না থাকায় ওই এলাকার মানুষের সমস্যার শেষ নেই। কৃষকের উৎপাদিত সব পণ্য শহরে বিক্রি করতে পরিবহণ খরচে পোষায়না। সীমাহীন কষ্ট ও অধিক ব্যয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে শহরে পণ্য পরিবহন করা হয়। ওই নদী পাড় হয়ে বা নদীর তপ্তবালু পথ দিয়ে ছেলে-মেয়েরা স্কুল-কলেজে যাতায়াত করে। প্রবাসী অধ্যুষিত হওয়ায় তারা যাতায়াত করে থাকে। নদীতে খেয়া মিস করে অনেক প্রবাসী ফ্লাইট মিস করার বহু নজির এলাকায় রয়েছে। প্রসূতি মায়ের উন্নত চিকিৎসার্থে দ্রুত শহরের হাসপাতালে নেওয়া যায় না। অনেক সময় নদীর খেয়ায়ই সন্তান ভূমিষ্ট হয়। আবার জরুরি রোগী নদী পাড় হতে বিলম্ব হওয়ায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। নির্বাচনের সময় ভোটের আশায় প্রতিনিধিরা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। ভোটের পর ভোট যায়। সেতুর কাজ আলোর দেখা পায়না।

মাহমুদনগর ইউপি চেয়ারম্যান আসলাম শিকদার জানান, তার ইউনিয়নের অভিভাবক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে সেতু নির্মাণে উদ্যোগ নিয়ে টেন্ডার করিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেটা বন্ধ হয়ে যায়। মাহমুদনগর ইউনিয়নের উন্নয়নের স্বার্থে, এলাকার মানুষের কষ্ট লাঘবে জরুরিভাবে সেতুটি নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান জানান, গোলচত্বরের ওখানে ধলেশ্বরী নদীর উপর সেতু নির্মাণের বিষয়ে আলোচনা ও প্রাথমিক পরিমাপ করা হয়েছে। প্রায় এক কিলোমিটার প্রস্থের ধলেশ্বরী নদীতে সেতু নির্মাণে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। অচিরেই প্রাথমিক প্রাক্কলন তৈরি করে অনুমোদনের জন্য এলজিইডি ভবনে প্রস্তাব পাঠানো হবে। অনুমোদন ও অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষে সেতু নির্মাণে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

(এসএম/এসপি/মার্চ ১৩, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

১৪ মার্চ ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test