E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

সোনারগাঁয়ে মেঘনা নদীতে ব্যাপক চাঁদাবাজি

বিকাশে চাঁদা নেয় সন্ত্রাসী রনি হাসান, পুলিশ পায় মাসোহারা

২০২৫ মার্চ ১২ ১৯:২১:১১
বিকাশে চাঁদা নেয় সন্ত্রাসী রনি হাসান, পুলিশ পায় মাসোহারা

শেখ এনামূল হক বিদ্যুৎ, নারায়ণগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে নৌ পুলিশকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিয়ে মেঘনা নদীতে চলছে ব্যাপক চাঁদাবাজি। নদীতে চলাচলরত বিভিন্ন নৌযান থেকে প্রকাশ্যে ও মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের মাধ্যমে নেয়া হয় চাঁদা। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে সেই নৌযান শ্রমিকদের বেধরক মারধর করা হয়। অস্ত্র দেখিয়ে দেয়া হয় হত্যার হুমকি।

নদীতে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি রোধে নৌ-পুলিশের টহল থাকলেও চাঁদাবাজদের সঙ্গে তাদের সখ্যতা থাকায় কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা। নিরাপত্তা দেয়ার নামে পুলিশও করছে চাঁদাবাজি। বর্তমানে সোনারগাঁয়ের মেঘনা নদীর ত্রাস হিসেবে পরিচিত ডাকাতি, মারামারিসহ একাধিক মামলার আসামী এই চাঁদাবাজের নাম রনি হাসান। মেঘনা নদীর আড়াইহাজার উপজেলার খাগকান্দা এলাকা থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া পর্যন্ত চলে রনি হাসানের চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজির টাকা নৌ ফাঁড়ি ইনচার্জ থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পর্যন্ত ভাগ পায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সোনারগাঁ পৌরসভাধীন সাহাপুর গ্রামের নুরা মিস্ত্রির ছেলে রনি হাসান এক সময় পিরোজপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি জাকির হোসেনের শ্রমিক হিসেবে দৈনিক ৩শত টাকার বিনিময়ে মেঘনা নদীতে বিভিন্ন নৌযানে চাঁদা আদায় করতো। পরবর্তীতে সে জাকির হোসেনকে পল্টি দিয়ে নিজেই সিন্ডিকেট করে নদীতে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি শুরু করে মেঘনা নদীর ভয়ঙ্কর ত্রাস হিসেবে পরিচিতি পায়।

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, নরসিংদী ও ভৈরব থেকে সোনারগাঁ হয়ে ঢাকা, চাঁদপুর নৌ রুটে চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে রনি। মেঘনা নদীর এই নৌ রুটে শত শত বাল্কহেড, বার্জ, কার্গো, ইঞ্জিন চালিত বালুবাহী নৌকা, চুনা পাথর ও কয়লাসহ বিভিন্ন পন্য পরিবহন করা হয়। সেসব নৌযানকে টার্গেট করে রনি হাসান ও তার সিন্ডেকেট চাঁদাবাজি করে থাকে। প্রতিদিন প্রত্যেক নৌযান থেকে ২ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে থাকে রনি। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে তাদের করা হয় বেধরক মারধর। এমনকি অস্ত্র দেখিয়ে দেয়া হয় হত্যার হুমকিও। তাই প্রাণভয়ে ও নির্বিঘ্ন চলাচলের জন্য রনিকে প্রতিদিন চাঁদা দিয়ে পন্য পরিবহন করেন নৌযান শ্রমিকরা। তবে কিছু নৌযান থেকে নগদ ও অধিকাংশ নৌযান থেকে বিকাশের মাধ্যমে চাঁদা নেয় রনি হাসান।

চাঁদাবাজি ও ডাকাতি রোধে মেঘনা নদীতে বৈদ্যেরবাজার নৌ ফাঁরি পুলিশ নদীতে টহলরত থাকলেও চাঁদাবাজদের সাথে সখ্যতা থাকায় এবং মোটা অঙ্কের মাসোহারা পাওয়ায় তারা প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেনা চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে। তাছাড়া নিরাপত্তা দেয়ার আড়ালে পুলিশও করছে চাঁদাবাজি। তারা ২শত টাকা করে প্রতিটি পণ্যবাহী নৌযান থেকে নেন। যদি কোনো নৌযান থেকে পুলিশের কাছে চাঁদাবাজ রনি হাসানের নাম বলা হয় তাহলে পুলিশ ২শ টাকার পরিবর্তে ১শ টাকা নেয়। আবার অনেক নৌযানকে এমনিতেই ছেড়ে দেয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মেঘনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে রনি সন্ত্রাসী দিয়ে শ্রমিকদের মারধর করে টাকা পয়সা লুটে নেয়। সেখানে পুলিশকেও নিরাপত্তা দিতে বাঁধা দেয়। পরবর্তীতে নৌযান মালিক শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্বিঘ্নে চলাচলের সুযোগ করে দেবে বলে তাদের সঙ্গে চুক্তিবন্ধ হয়। চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিলেই কেউ তাদের সমস্যা সৃষ্টি করে না। পুলিশ থাকেন তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে। চুক্তির টাকা থেকে পুলিশও ভাগ পেয়ে থাকেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে। বৈদ্যেরবাজার এলাকার নৌ ফাঁড়ি থেকে শুরু করে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পেয়ে থাকেন মাসোহারা। তাই চাঁদাবাজ রনিকে গ্রেপ্তারে কোন ব্যবস্থা নেয় না প্রশাসন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার সিন্ডিকেটের এক সদস্য বলেন, রনি মেঘনা নদীর ভয়ঙ্কর ত্রাস। তার সিন্ডিকেটে মেঘনা উপজেলার আব্দুল বারেকের তিন ছেলে আলী হোসেন, আবুল হাসনাত ও মহসিন জড়িত। কিছুদিন বৈদ্যেরবাজার এলাকার কয়েকজন যুবক নদীতে তাদের সঙ্গে কাজ করলেও এখন আর করেন না বলে তার দাবি। তাদের মাধ্যমেই শ্রমিকদের মারধর করে থাকেন। মারধরের ভয়ে নৌ মালিক ও শ্রমিকরা তার সঙ্গে আঁতাত করে বিকাশে টাকা পৌছে দেন। নৌ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ফাঁড়ি পুলিশদের ম্যানেজ করেই এ চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রন করে এবং রাতের বেলা ডাকাতি করেন। রনি ২০২২ সালে নগদ প্রায় ১৩ লাখ টাকা, ল্যাপটপ ও ১৩ টি মোবাইল সিমসহ গ্রেপ্তার হয়। তার বিরুদ্ধে সোনারগাঁ থানায় ডাকাতি, মারামারিসহ দেশের বিভিন্ন থায়ায় ১০ টি চাঁদাবাজি ও ডাকাতির মামলা রয়েছে।

সরেজমিনে মেঘনা নদীর নলচর এলাকায় গিয়ে নৌযানকে থামাতে বললেই রনি ভাইয়ের বডি বলে দাবি করেন। রনির বডি বলার কারণ জানতে চাইলে তারা জানান, বিকাশের মাধ্যমে প্রতিটি বডির জন্য তাকে ২ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা দিতে হয়। এই টাকা দিলেই নির্বিঘ্নে হামলা ও মারধর ছাড়াই তারা চলাচল করতে পারেন। এসময় বৈদ্যেরবাজার নৌ ফাঁড়ির ইনচার্জ মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে ২টি ট্রলারকে নদীতে টহল দিতে দেখা যায়।

এই বিষয়ে অভিযুক্ত রনি হাসান মোবাইলে জানান, তিনি বর্তমানে বন্দর উপজেলার তিনগাঁও এলাকায় থাকেন। চাঁদাবাজির বিষয়টি সত্য নয়। টাকাসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলাম সত্য। তবে একটি মহল আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

বৈদ্যেরবাজার নৌ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, নৌযান শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে টহল দেওয়া হচ্ছে।

তবে পুলিশের চাঁদা আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, এটি সত্য নয়। শ্রমিকরা পুলিশের বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তি দিয়েছে বলে জানালে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। এছাড়াও বিকাশে চাঁদাবাজির বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।

নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের নৌ পুলিশ সুপার মো.আলমগীর হোসেন বলেন, বিকাশের মাধ্যমে চাঁদাবাজির বিষয়টি আমার জানা নেই। পুলিশ চাঁদাবাজের পক্ষে অবস্থান নেয়ার বিষয়টি সত্য নয়। তাছাড়া নৌ ফাঁড়ি পুলিশের বিষয়ে চাঁদা আদায়ের প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(এসবি/এসপি/মার্চ ১২, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

১২ মার্চ ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test