E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

মুক্তিপণ নিয়ে রহস্য: চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে অপহরণের নাটক!

২০২৫ মার্চ ০৯ ১৮:০৬:১১
মুক্তিপণ নিয়ে রহস্য: চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে অপহরণের নাটক!

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটায় মো. শহিদুল আলম জুয়েল (৩২) নামে এক যুবককে অপহরণের ঘটনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, সাবেক ইউপি সদস্য ও ব্যবসায়ীসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাত ১৩-১৪ জনকে আসামি করে সিএমপি'র কর্ণফুলী থানায় একটি অপহরণ মামলা হয়েছে।

গত শুক্রবার কর্ণফুলী থানায় ভুক্তভোগী জুয়েল নিজেই বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিএমপি বন্দর জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ বদরুল আলম মোল্লা।

মামলায় অভিযুক্তরা হলেন কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের এম মঈন উদ্দিন (৪৬), মো. শাহেদুর রহমান প্রকাশ শাহেদ (৫০), মির্জা আজাদ (৪০), মো. আব্দুর রাজ্জাক (৪০), জাফর আহমদ (৫৮), মো. ইমরান পাটোয়ারী (২৯), আব্দুর শুকুর (৩৫) ও জহিরুল আলম (৪০)।

গত ৭ মার্চ দায়ের করা এজাহারে ভিকটিম জুয়েল জানান, তিনি একজন ব্যবসায়ী এবং অভিযুক্তরা দীর্ঘদিন ধরে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছিল। ৫ মার্চ রাত ১০টার দিকে ইছানগর জামে মসজিদে তারাবির নামাজ শেষে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাড়ি ফেরার পথে চরপাথরঘাটা (৮ নম্বর ওয়ার্ড) সাইক্লোন সেন্টারের কাছে পৌঁছালে, অজ্ঞাত ৯-১০ জন ব্যক্তি তিনটি সিএনজিযোগে এসে তাকে জানায় যে, তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে। এরপর তারা তাকে জোরপূর্বক সিএনজিতে তুলে থানায় নেওয়ার কথা বলে।

তবে থানায় না নিয়ে, অপহরণকারীরা তাকে শাহ আমানত সেতু হয়ে ফিশারি ঘাটের দিকে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে কালো রঙের একটি প্রাইভেট কারে তুলে লালদীঘির মাঠে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে মাস্ক পরিহিত ৯-১০ জন ব্যক্তি তাকে চারজনের কাছে হস্তান্তর করে, যারা তাকে সাদা প্রাইভেট কারে তুলে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাতে থাকে।

রাত সাড়ে ১টার দিকে গাড়িটি কাজীর দেউড়ী এলাকায় রয়েল হাট রেস্টুরেন্টের সামনে থামে। সেখানে মাস্ক পরিহিত ব্যক্তিরা জুয়েলকে গাড়ির মধ্যে রেখে দরজা লক করে ৩০ মিনিট পর নিজেদের প্রশাসনের লোক পরিচয় দিয়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। জুয়েল টাকা দিতে অপারগতা জানালে, তারা ৫ লাখ টাকা দাবি করে। একপর্যায়ে, অপহরণকারীরা জুয়েলের মোবাইল ফোন থেকে সাজ্জাদ নামের একজনের নম্বরে কল করে তার ছোট ভাই মুন্নার সঙ্গে কথা বলে এবং ৫ লাখ টাকা দাবি করে। পরে দর-কষাকষির পর ৩ লাখ টাকার শর্তে তাকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

কর্ণফুলী থানার ওসি ও অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তারা কাজীর দেউড়ী মোড়ে গাড়ি তল্লাশি করতে গেলে অপহরণকারীরা জুয়েলকে জানায়, 'টাকা লাগবে না, আমরা তোমাকে ছেড়ে দেবো, চিৎকার করো না।' এরপর তারা গাড়ি ঘুরিয়ে হল টোয়েন্টিফোরের সামনে নিয়ে যায় এবং রাত সাড়ে ৩টার দিকে জুয়েলকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়। যাওয়ার সময় তারা জানায়, এজাহারে উল্লেখিত আসামিরা তাদেরকে ভিকটিমকে এনে টাকা আদায় করতে বলেছে।

জুয়েল পরে একটি রিকশায় করে কোতোয়ালী থানায় গিয়ে ওসি কোতোয়ালী এবং সেখানে উপস্থিত কর্ণফুলী থানার ওসিকে ঘটনাটি জানান। এ বিষয়ে কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ শরীফ বলেন, 'অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়েছে এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'

এদিকে, মামলার এজাহার ও ভিকটিমের গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যের মধ্যে অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে। মামলায় উল্লেখিত ঘটনাপ্রবাহ ও সাক্ষাৎকারে পাওয়া তথ্যের মধ্যে বেশ কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে, যা মামলাটির গভীর তদন্তের প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়ে তুলেছে।

ভিকটিম প্রথমে দাবি করেন, তাকে চট্টগ্রাম মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু মামলায় এমন কোনো ছাত্র সংগঠনের সদস্যকে আসামি করা হয়নি। এ ছাড়া, এজাহারভুক্ত আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে তাকে হুমকি দিচ্ছিলেন বলে উল্লেখ করা হলেও, তিনি অতীতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেননি।

অভিযুক্তরা এলাকায় সুপরিচিত ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, যাদের বিরুদ্ধে অতীতে অপহরণের অভিযোগ ছিল না। তাহলে হঠাৎ তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কেন উঠল? এটি গভীর তদন্তের দাবি রাখে।

স্থানীয়দের ধারণা, ঘটনাটির পেছনে ইছানগরের একটি কোম্পানির জাহাজে জাটকা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনা থাকতে পারে। আবার অনেকের মতে, এটি একটি পরিকল্পিত নাটক। অভিযুক্তদের দাবি, ভিকটিম আওয়ামী পরিবারের সন্তান এবং হীন উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।

ভিকটিমের বক্তব্যে মুক্তিপণের পরিমাণ বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। প্রথমে ১০ লাখ টাকা চাওয়া হলেও পরে তা ৫ লাখে নেমে আসে এবং শেষে ৩ লাখ টাকা দাবি করা হয়। তবে মামলায় উল্লেখ নেই যে, মুক্তিপণের টাকা আদায় করা হয়েছে কিনা।

পুলিশের মোবাইল ট্র্যাকিং অনুযায়ী, ঘটনার রাতে ভিকটিমের অবস্থান খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালী ও লালখানবাজারে পাওয়া যায়। অথচ ভিকটিমের দাবি, তাকে ইছানগর থেকে সরাসরি সিএনজিতে লালদীঘি ও কাজীর দেউড়িতে নেওয়া হয়। তাহলে তার ফোন লোকেশন কেন খুলশী, লালখান বাজার ও পাঁচলাইশে দেখা গেল? এ নিয়ে তদন্তকারীরা আরও গভীরে যাচ্ছেন।

সচেতন মহল ও মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান মনে করেন, ভিকটিমের বর্ণনায় অসঙ্গতি থাকায় কাউকে হয়রানি না করে ঘটনার প্রকৃত রহস্য উন্মোচনে পেশাদার তদন্ত প্রয়োজন। পুলিশও জানিয়েছে, অপহরণের প্রকৃত কারণ, মুক্তিপণের দর-কষাকষি এবং অপহরণকারীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে আরও গভীর তদন্ত করা হবে।

(জেজে/এসপি/মার্চ ০৯, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

১০ মার্চ ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test