২০২৫ জানুয়ারি ২৯ ১৮:৫০:৪৭

আঞ্চলিক প্রতিনধি, বরিশাল : নগরীর ১৭টি হাট ও বাজার, নয়টি ঘাট এবং দুইটি বাস টার্মিনাল দখলের পর এবার আইনজীবী সমিতি, চেম্বার অব কমার্স ও বিসিক শিল্পনগরীতে থাকা মালিকদের সংগঠনেও থাবা পড়েছে বিএনপি নেতাদের। গত ৫ আগস্টের পর পর্যায়ক্রমে এসব দখল করা হয়েছে।

এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে, বালুমহাল, ড্রেজিংয়ের ব্যবসা ও থ্রি-হুইলার স্ট্যান্ড থেকেও নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। নগরীতে থাকা সব সরকারি দপ্তরের টেন্ডারও এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন বিএনপির ঠিকাদাররা। ৫ আগস্টের পর শুরু হওয়া এসব দখল-চাঁদাবাজি এখনো চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দলের একজন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকসহ চারজন প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না কিছুই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু বরিশাল নগরীই নয়; জেলার দশটি উপজেলায় ডিস ব্যবসা থেকে শুরু করে সবকিছুই এখন বিএনপি নেতারা দখল করে নিয়েছেন। তবে মহানগর বিএনপির আহবায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক বলছেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে আমরা তিন জনকে শাস্তি দিয়েছি। এ রকম তথ্যপ্রমাণসহ অভিযোগ পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সূত্রমতে, ৫ আগস্টের পর নগরীর ব্রাউন কম্পাউন্ড এলাকায় জনব্যবহার্য একটি পুকুর ভরাট করে দখল চেষ্টার অভিযোগ ওঠে কেন্দ্রীয় বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি বিলকিস জাহান শিরিন এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের ওই পুকুরটির মালিকানা নিয়ে বিতর্কের মধ্যে চালানো হয় দখলের চেষ্টা। অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে শিরিনের দলীয় পদ-পদবি স্থগিত এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে বিএনপির হাইকমান্ড।

দখলে দুই বাস টার্মিনাল

নগরীর নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল দখলের অভিযোগ উঠেছে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক এমপি মজিবর রহমান সরোয়ারের ছোট ভাই মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে। বর্তমানে সেখানকার আয়-ব্যয় তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন। এছাড়া দুইটি পরিবহণ লাইন দখলের অভিযোগ রয়েছে মোশাররফের বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে মোশাররফ হোসেন বলেন, আমি মালিক সমিতির পুরোনো সদস্য। আওয়ামী মালিকদের চাঁপে ব্যবসা করতে না পেরে বাস বিক্রি করে চলে গিয়েছিলাম। ৫ আগস্টের পর আবার বাস ক্রয় করে সমিতির সদস্য হয়েছি। বর্তমানে একজন সাধারণ মালিক হিসেবে আছি। দখল বা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নই আসে না।

নথুল্লাবাদের পাশাপাশি নগরীর রূপাতলী বাস টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদারের বিরুদ্ধে। মালিক সমিতির সভাপতি হওয়ার পাশাপাশি বাস টার্মিনাল এবং সংলগ্ন এলাকার কোনো কিছুই এখন তার কথার বাহিরে চলে না। সেখানকার আয়ও তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ ব্যাপারে জিয়াউদ্দিন সিকদার বলেন, ১৬ বছর আগে মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। পরিবহণ ব্যবসা করি অন্তত ৩০ বছর ধরে। ৫ আগস্টের পর আগের নেতারা পালিয়ে যাওয়ার কারণে টার্মিনাল পরিচালনার প্রয়োজনে মালিকরা আমাকে নিয়ে আসেন। সমিতির ৯২ সদস্যর মধ্যে ৮৬ জনে ভোট দিয়ে আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করেছেন। এখানে দখলের কোন ঘটনা ঘটেনি।

নয়টি ঘাট ও দুইটি বাজার

অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার দুইটি লঞ্চঘাটসহ বরিশালে থাকা বিআইডব্লিউটিএ’র নয়টি ঘাটের প্রায় সবকটি এখন পরিচালনা করছেন বিএনপি নেতারা। যদিও কাগজে-কলমে এসব ঘাটের ইজারাদার পলাতক আওয়ামী লীগের লোকজন। এরমধ্যে চাঁনমারী ও কেডিসি ঘাটের নতুন করে ইজারা পেয়েছেন ১২নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি নেতারা। এই দুই ঘাটের সাবেক ইজারাদার মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে ওই দুইটি ঘাটের টোল আদায় বন্ধ করে দিয়েছে বিএনপির লোকজনে। অথচ নিলাম ডাকে ঘাট পাওয়ার পর প্রায় ৩০ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে টোল আদায় করছিলাম। পরে গাফিলতি দেখিয়ে ইজারা বাতিল করে বিআইডব্লিউটিএ। এ ব্যাপারে কোন কথা বলতে রাজি হয়নি বিআইডব্লিউটিএ’র কোনো কর্মকর্তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর একতলা লঞ্চঘাটের ইজারাদার ছিলেন আওয়ামী লীগের আবুয়াল হোসেন অরুন। এটি পরিচালনা করছেন বিএনপি নেতা হারুন-অর রশিদ ও তার সহযোগিরা। একইভাবে অন্য ঘাটগুলোতেও সরাসরি বিএনপির নেতাকর্মী কিংবা তাদের লোকজনের মাধ্যমে চলছে টোল আদায়। এ বিষয়ে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার বলেন, হারুন-অর রশিদ বিএনপি থেকে আজীবনের জন্য বহিস্কৃত। এছাড়া পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘাট কে কীভাবে চালাচ্ছে তার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ ব্যাপারে কেউ অভিযোগ দায়ের করলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বিসিসি’র ১৫ বাজার

নগরীর ১৭টি হাট-বাজার রয়েছে বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি)। ইজারার মেয়াদ শেষ হওয়ায় বাংলাবাজার ও নতুন বাজার থেকে সরাসরি টোল আদায় করছে নগরভবন। বাকি ১৫টি বাজারের ইজারাদার ছিলো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বর্তমানে এসব বাজারের টোল আদায় করছেন সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর বিএনপি নেতারা। এরমধ্যে সাতটি বাজারের আদায় করা টোল পলাতক আওয়ামী ইজারাদার ও বিএনপির লোকজন ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। বাকি আটটি বাজার থেকে ওঠা টাকার পুরোটাই যাচ্ছে বিএনপির লোকদের পকেটে। নগরীর বৃহত্তম পুরান বাজারের ইজারাদার নাসির গাজী বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপির লোকজনের সাথে সমঝোতা করে চলা ছাড়া তো কোন উপায় নেই। ইজারা পাওয়ার সাথে সাথে আমাদের কাছ থেকে পুরো বছরের টাকা নিয়ে নিয়েছে সিটি করপোরেশন। এখন ওরা (বিএনপির লোকজন) দয়া করে যা দেয় সেটাই লাভ। কাশিপুর বাজারের ইজারাদার কবির আহম্মেদ বলেন, আমারক্ষেত্রে পুরো টাকাই উঠিয়ে নিচ্ছে বিএনপির লোকজন। তবে বাজারের টোল দখলের এসব অভিযোগ স্বীকার করেননি বিএনপির কেউ। এমনকি কোন বক্তব্য দিতেও রাজি হননি বিএনপির নেতৃবৃন্দরা।

চেম্বার অব কমার্স

পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সদস্যপদ নবায়ন, সাধারণ সভায় নির্বাচনী তফশিল ঘোষণা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হওয়ার কথা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের কমিটি। এসব কিছু না করেই সভাপতি হয়ে চেম্বার দখলের অভিযোগ উঠেছে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবায়েদুল হক চাঁনের বিরুদ্ধে। স্থানীয় একটি পত্রিকায় মতবিনিময় সভার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পরে কাগজে-কলমে সভা, তফশিল আর ভোট দেখিয়ে তিনি এই দখলবাজি করেছেন বলে জেলা প্রশাসনসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন চেম্বারের ৭৪ জন সদস্য। কমিটি বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগের দাবিও করা হয়েছে ওই আবেদনে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে এবায়েদুল হক চাঁন বলেন, সবকিছুই নিয়মবিধি মেনেই হয়েছে। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।

আইনজীবী সমিতি

আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত কমিটি ছিল আওয়ামী সমর্থিত আইনজীবীদের নিয়ে। ওই কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩৩ দিন আগে হঠাৎ করেই সমিতি কার্যালয় দখল করে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করেন সর্বশেষ নির্বাচনে পরাজিত বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা। একবছর আগে জোর করে ফলাফল ছিনিয়ে নিয়ে তাদের পরাজিত করা হয়েছিল বলে দাবি তাদের। সাধারণ আইনজীবীদের সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নেতৃত্বের বদল হয়েছে জানিয়ে নিজেকে সভাপতি ঘোষণা করেন বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট সাদিকুর রহমান লিংকন। নির্বাচিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খান মোর্শেদ বলেন, এটা ভয় দেখিয়ে জোর-জবরদস্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। বর্তমানে সমিতিতে নির্বাচনের আয়োজন হলেও বিএনপি ও জামায়াতপন্থি আইনজীবী ছাড়া অন্য সবাই তা বর্জন করেছেন।

বিসিক শিল্পনগরী

বিসিক শিল্পনগরীর মালিক সমিতিও এখন বিএনপির দখলে। আগের কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটির সভাপতি হয়েছেন বিএনপিতে কোনো পদ-পদবি না থাকা সরোয়ার অনুসারী আলমগীর হোসেন আলম। কোনোধরনের সভা কিংবা নির্বাচন ছাড়াই ১১ সদস্যর ওই কমিটি গঠণ হয়েছে বলে দাবি সাবেক কমিটির নেতাদের। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আলমগীর হোসেন আলম বলেন, বিসিকের সব মালিক মিলে সভা করে নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি করেছে। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।

এসবের বাহিরেও বরিশাল নগরীসহ জেলার দশটি উপজেলার নগদ আয়ের প্রায় সব সেক্টরই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে স্ব-স্ব এলাকার বিএনপির নেতাকর্মীরা। ঠিকাদারীসহ বালুমহাল, ড্রেজিং আর সাধারণ গণপরিবহনের নেতৃত্বও এখন বিএনপি নেতাদের হাতে। জেলা প্রশাসন থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের ইজারা নেয়া বানারীপাড়া, উজিরপুর ও বাবুগঞ্জ উপজেলার সন্ধ্যা এবং সুগন্ধা নদীর বালুমহালও দখল করে নিয়েছে ওইসব এলাকার বিএনপির নেতারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলজিইডি, গণপূর্ত, নগরভবন, শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগ এবং সড়ক ও জনপথ দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, যেটা আগে আওয়ামী লীগ করতো এখন বিএনপি সেটাই করছে। তারা আরও বলেন, অফিস চলাকালীন সময় প্রায় সব দপ্তরে বিএনপি নেতাদের ভিড় লেগেই থাকে। তাদের কারণে সাধারণ জনগনের কোন কাজকর্ম ঠিকভাবে করা যাচ্ছেনা।

সার্বিক বিষয়ে মহানগর বিএনপির আহবায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক বলেন, কয়েকটি ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে যে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের যেসব নেতাকর্মীর ব্যবসা-বাণিজ্য ছিনিয়ে নিয়েছিল সেগুলো আবার তারা ফেরত নিয়েছে। তবে যেভাবে বলা হচ্ছে তেমন কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী, দখলদার-চাঁদাবাজের ঠাঁই নেই। প্রমাণসহ অভিযোগ পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

(টিবি/এসপি/জানুয়ারি ২৯, ২০২৫)