E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

পদ্মায় বিলুপ্ত ৫ প্রজাতির মাছ, বেড়েছে জেলেদের দুর্দশা

২০২৫ জানুয়ারি ১২ ১৯:১৬:৪৮
পদ্মায় বিলুপ্ত ৫ প্রজাতির মাছ, বেড়েছে জেলেদের দুর্দশা

একে আজাদ, রাজবাড়ী : পদ্মা নদীতে ৪০ বছর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন নারায়ণ হালদার। আগে জালের টানেই উঠে আসত ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ। বাজারে বিক্রি করে খুশিমনে বাড়ি ফিরতেন। কয়েক বছর ধরে জালে তেমন মাছ উঠছে না। পরিবার নিয়ে অর্থকষ্টে চলছে তাঁর জীবন। 

রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের চর নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা নারায়ণ হালদার (৫৬)। দেশি প্রজাতির মাছ কমে যাওয়ায় তাঁর মতো অন্য জেলেদের দুর্দশা যেমন বেড়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষ মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটি এখন যেন অসংগতিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে অন্তত তিন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্তির পথে রয়েছে আরও পাঁচ প্রজাতির মাছ।

মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষকে সচেতন হতে এবং মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

রাজবাড়ী জেলা পদ্মা নদীবেষ্টিত। চন্দনা, গড়াই, হড়াই, কুমার, চত্রা নদী ছাড়াও অসংখ্য খাল-বিল রয়েছে। এসব নদী, খাল-বিলে পাওয়া যেত মাগুর, শিং, পাবদা, পুঁটি, মলা, ঢেলা, চেলা, শোল, বোয়াল, আইড়, ভেদা, ফলি, কাগচি, চিংড়ি, গজার, চেং, টাকি, চিতল, পোয়া, বালিয়া, গুতুম, পুতুল বা রানী, চাপিলা, বৈচা, চাঁদা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, তিতপুঁটি, চিতল, ডানকিনা, খয়রা, রিঠা, পিয়ালি, খৈলশা, ছোট ট্যাংরা, বড় ট্যাংরা, কালিবাউশ, বাঘাইর, ভাঙরা, বাতাসি, বড় বাইন, তারা বাইন, শালবাইন, বাইন, খরকুটি, পটকা, বেলেসহ নাম না জানা অনেক প্রজাতির দেশি মাছ। এসব মাছের স্বাদও ছিল অতুলনীয়। সময়ের আবর্তনে দেশি প্রজাতির এসব মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন আর বাজারে গেলে মেলে না মনের মতো মাছ।

রাজবাড়ী সদর উপজেলার উড়াকান্দা এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব জামাল সরদার ছোটখাটো ব্যবসা করেন। মাছ তাঁর খুব প্রিয়। জানালেন, আগে বাজারে গিয়ে ব্যাগ ভরে মাছ কিনতেন। মাছ দিয়ে মনের মতো করে ঝোল, তরকারি, পাতুরিসহ কত তরকারি খেয়েছেন। এখন আর বাজারে মনের মতো মাছ পাওয়া যায় না। মাছ কিনতে বাজার ঘুরতে ঘুরতে জীবন শেষ। রুই, কাতলা, নৌসি, বাটা মাছ সচরাচর মেলে। অন্য মাছ মাঝেমধ্যে পাওয়া যায়। তবে দাম খুব বেশি। স্বাদও তেমন নেই। ট্যাংরা মাছ পাওয়া গেলেও ৮০০ টাকা কেজি। এত টাকা দামের মাছ খাওয়ার সাধ্য ক’জনের আছে।

রাজবাড়ী বাজারের মাছ বিক্রেতা নিরঞ্জন সরকার জানান, তিনি ৪৬ বছর ধরে মাছের ব্যবসা করেন। আগে প্রচুর মাছ কিনতেন। সহজে সেসব বিক্রিও হয়ে যেত। এখন মাছ পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। যা পান ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা কঠিন। দাম বেশি দেখে অনেকেই চলে যান। আর অনেক প্রজাতির মাছ এখন আর দেখা যায় না। ট্যাংরা, পুঁটি, বাইন, শিং, চিংড়ি ইত্যাদি মাছ পাওয়া যায়। তিনি জানালেন, নদীর পানি এখন কোল দিয়ে ভেতরে না ঢোকায় খালে-বিলে পানিও জমে না। তাই মাছ পাওয়া যায় কম।

সদর উপজেলার চর নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা কান্ত হালদার (৪৬) জানান, ২০ বছর বয়স থেকে তিনি নদীতে মাছ ধরেন। আগে মাছ ধরে আড়তে বিক্রি করতেন। যা পেতেন তা দিয়ে সংসার ভালোভাবে চলে যেত। এখন নদীতে জাল ফেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও মাছ পান না। যেটুকু পান তা হাটে-বাজারে বসে বিক্রি করেন। মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার আর চলে না। বিভিন্ন সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে তাদের চলতে হয়।

রাজবাড়ী জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য মতে, জেলায় নদী, বিল, প্লাবনভূমি, পুকুর, বরোপিট, বাঁওড় রয়েছে মোট ৩৬ হাজার ৮৩৯ হেক্টর। এসবের পানিতে ২৭ হাজার ২০০ টন মাছ উৎপাদন হয় প্রতিবছর।

রাজবাড়ী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদার তথ্য মতে, রাজবাড়ী জেলায় ৫৯ প্রজাতির মাছ ছিল। তিনটি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেগুলো হলো– ভেদা, ভেলা ও কাউনে। এ ছাড়া গুলসা, পুতুল, মলাসহ পাঁচ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে রয়েছে। দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাওয়ার কারণ ও করণীয় সম্পর্কে নাজমুল হুদা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তীব্র খরা যেমন সমস্যা, তেমনি কৃষিতে উপর্যুপরি মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে। এতে জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। নদীগুলোও ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে। খাল-বিল, জলাশয় থাকছে না। নির্বিচারে পুকুর ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নানা রকমের প্রেক্ষাপটের কারণেই এসব হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে অভয়াশ্রম তৈরি করতে হবে। যেখানে নদীর প্রাচুর্য বেশি। নদীর খারিতি কোল বা যে সমস্ত বিলে সুযোগ রয়েছে, সেসব বিলে অভয়াশ্রম করতে হবে। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ইতোমধ্যে জেলা মৎস্য অফিসের উদ্যোগে প্রতিটি উপজেলায় অভয়াশ্রম করা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে প্রচার চালানো হচ্ছে।

(একে/এসপি/জানুয়ারি ১২, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

২১ মার্চ ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test