E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

ফরিদপুরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের লাশ নিয়ে মিছিলে তার পাঁচ মাসের শিশু

২০২৫ জানুয়ারি ১১ ২৩:৫৫:১২
ফরিদপুরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের লাশ নিয়ে মিছিলে তার পাঁচ মাসের শিশু

বিশেষ প্রতিনিধি, ফরিদপুর : ফরিদপুরের কানাইপুরে যুবককে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যার ঘটনায় নিহতের লাশ নিয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

শনিবার (১১ জানুয়ারি) প্রায় ঘণ্টাব্যাপী ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের কানাইপুর বাজার এলাকায় বিক্ষোভ চলা কালীন এলাকাবাসীর সঙ্গে অংশ নিতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত বাবার লাশ নিয়ে মিছিলে পাঁচ মাসের শিশু জুনায়েদ খানকেও দেখা যায়।

এ সময় বিক্ষুব্ধরা ঘটনার জন্য দায়ী করে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শাহ মুহাম্মদ আলতাফ হোসেন ও তাঁর ভাই খায়রুজ্জামান খাজাসহ জড়িত সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান।

এর আগে গত শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) ওবায়দুর খানকে (২৮) তুলে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এ সময় তাকে বেধরক প্রহারের পাশাপাশি তাঁর দুই চোখে পেরেক ঢুকিয়ে খোঁচানো এবং পায়ের রগ কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। রাত ৯টার দিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান ওবায়দুর।

নিহত ওবায়দুর সদর উপজেলার কানাইপুর ইউনিয়নের ঝাউখোলা গ্রামের বিল্লাল খানের ছোটছেলে এবং কৃষি ও কাঠমিস্ত্রির কাজ করে জীবীকা নির্বাহ করতেন বলে জানিয়েছেন তার পরিবার। মৃত্যুকালে- জুনায়েদ খান নামের পাঁচ মাসের একটি পুত্রসন্তান ও সাবানা সত্তার সুইটি (২৪) নামে স্ত্রী রেখে গেছেন ওবায়দুর খান।

নিহতের ভাই রাজিব খান রাজু ও তাঁর স্বজনেরা জানান, ঘটনা দিন বেলা সাড়ে ৩টার দিকে কানাইপুর বিসিক শিল্পনগরীর মমতাজ ফিলিং স্টেশনে মোটরসাইকেলের তেল কিনতে যান ওবায়দুর। ওই সময় পেছন থেকে একটি সাদা প্রাইভেটকারে খায়রুজ্জামান খাজার নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জন সন্ত্রাসী মিলে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। পরে কানাইপুরের 'মিল গেট' খ্যাত স্থানে 'ফরিদপুর জুট ফাইবার্স মিল'-এর পেছনে খাজার বাড়ির পাশে নিয়ে ওবায়দুরকে অমানবিক নির্যাতন করে সন্ত্রাসীরা।

এ সময় তার দুই চোখে লোহার পেরেক দিয়ে খোঁচানো হয় এবং বাঁ পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। পরে স্থানীয়রা তাঁকে উদ্ধার করে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ।

রাত ৯টার দিকে ঢাকায় নেওয়ার পথে ভাঙ্গা-ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা এলাকায় তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটলে, সেখান থেকে জরুরিভাবে তাঁকে ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান স্বজনেরা। পরে পুনরায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

এদিকে, শনিবার বিকেলে নিহত ওবায়দুর খানের লাশ তাঁর নিজ এলাকা কানাইপুর পৌঁছলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে স্থানীয়রা। এ সময় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে মহাসড়কে শুয়ে পড়েন তারা। এ সময় সড়কের দুপাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে ফরিদপুর কোতয়ালি থানা-পুলিশের আশ্বাসে অবরোধ তুলে নেন স্থানীয়রা।

এ সময় স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত খাজা তার নামে এলাকায় 'খাজা বাহিনী' গড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের আমলে সাবেক মন্ত্রী আবদুর রহমানের নাম ভাঙিয়ে চলতেন তিনি। তৎকালীন সময়ে আবদুর রহমানের হস্তক্ষেপে একটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়েও খালাস পান বলেও দাবি করেন তারা।

পরে এলাকায় ফিরে পুনরায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন তিনি। ৫ আগস্টের পরে জেলা বিএনপির এক শীর্ষ নেতার সমর্থক পরিচয়ে পুনরায় বেসামাল ও একছত্র ত্রাসের রাজত্ব আরম্ভ করেন। এসময় তার দলে না ভিড়লে হুমকি-ধমকিসহ করা হয় নির্যাতন করতেন বলেও জানান তারা।

এ সময় নিহতের বাবা বিল্লাল খান বলেন, ‘আমরা নায়াব আপার (চৌধুরী নায়াব ইউসুফ–বিএনপির কেন্দ্রীয় মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক) লোক। আর খাজা ইছা ভাইয়ের (জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেছ আলী ইছা) ও তাবরীজ (ফরিদপুর মহানগর যুবদলের বহিস্কৃত নেতা ও সদর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান) ভাইয়ের নাম ভাঙিয়ে চলে তাদের লোক বলে দাবি করে আসছে। ৫ আগস্টের পর থেকে কানাইপুরকে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিনত করেছে খাজা বাহিনী বলে দাবী করেন তিনি। সাবেক এক চেয়ারম্যানের বাড়ী ঘর লুটপাট করা, কানাইপুর বাজারের ও স্ট্যান্ডগুলোতে চাঁদাবাজি করে আসছিলো উল্লেখ করে তিনি দাবী করেন, 'খাজা আগে চলতেন আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে, এখন চলে বিএনপি'র নাম ভাঙিয়ে'। তিনি আরো জানান, 'আমার ছেলেকে যেভাবে নৃশংস ও বর্বরোচিতভাবে হত্যা করেছে খাজা বাহিনী, তা কোন মানুষের কাজ হতে পারে না। আমি এই হত্যার বিচার চাই'। ওর (খাজা) ফাঁসি না হলে কানাইপুরে আরও মানুষ মরবে, কেউ শান্তিতে বসবাস করতে পারবেনা বলেও জানান নিহিতের পিতা। এ সময় তিনি মোবাইলে খায়রুজ্জামান খাজার ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘ও (খাজা) আর আলতাফ চেয়ারম্যান অর্ডার দিয়েই আমার ছেলেকে মারছে।’

ঘটনাস্থলে উপস্থিত কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদ উজ্জামান এর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লাশ দাফন শেষে পরিবারকে থানায় আসতে বলা হয়েছে, গতকালই থানায় গিয়ে একটি অভিযোগ প্রস্তুত করে রেখেছে নিহতের পরিবার, রাতেই পরিবারের সদস্যদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে হত্যা মামলা হিসেবে রুজু করা হবে'। এছাড়া ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আটক করতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে বলেও জানান কোতয়ালি থানার ওসি আসাদ।

যদিও এই হত্যার সাথে খাজার বড় ভাই ও কানাইপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আলতাফ হুসাইন জড়িত আছেন কিনা, সেটি নিয়েও এলাকাবাসীর মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

এসব বিষয়ে কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আলতাফ হুসাইন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে এই প্রতিবেদককে জানান, 'আমার এলাকায় এমন একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড অবশ্যই নিন্দনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত। আমি এই জঘন্য হত্যার ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং এই সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করছি'। তিনি আরো জানান, 'একটি মহল এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে আমাকে রাজনৈতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা করে যাচ্ছেন'। আলতাফ চেয়ারম্যান এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত নন জানিয়ে বলেন, 'আমি কখনোই হত্যার রাজনীতি করি না, এটির সাথে আমি জড়িতও নই। প্রতিপক্ষকে তাঁর প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার আশা করেন শাহ মোহাম্মদ আলতাফ হুসাইন। এছাড়া অধিকাংশ কানাইপুরবাসীও সেটাই চায় বলেও দাবি করেন তিনি।

'কারো ব্যক্তিগত অন্যায়ের দায় আমি নিবো না' জানিয়ে চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আলতাফ হুসাইন আরও জানান, 'আমি গণমানুষের জন্য কাজ করি, গণমানুষের ভালো মন্দ নিরপেক্ষভাবে দেখি বা দেখার চেষ্টা করি, এলাকার শত্রু-মিত্র, পক্ষ-প্রতিপক্ষ সবারই আমি জনপ্রতিনিধি। কেউ আমার নিজের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি, আর হবেও না কোনদিন'। এই হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে যেনো আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কোন দাগ না লাগে, আমাকে যেনো ফাঁসানো না হয়, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে ভুক্তভোগীর পরিবার যেনো সঠিক বিচারটি পান, আর কেউ যেনো এই হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক হাতিয়ার না বানাতে পারেন প্রভৃতি বিষয়ে এলাকার সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি'। এছাড়া, উপরোক্ত বিষয়গুলোতে বিশেষ করে কানাইপুরের স্থানীয় জনগণ, ফরিদপুরের স্থানীয় প্রশাসন ও ফরিদপুরে কর্মরত সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ ভুমিকা আশা করেন কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আলতাফ হুসাইন।

এদিকে, শনিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার নিহত ওবায়দুরের গ্রামের বাড়ী ঝাওখোলায় তাঁর নামাজে জানাজা শেষে তাঁকে দাফন করা হয়েছে। ওবায়দুরের নামাজে জানাজায় স্থানীয় এলাকাবাসীর পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ বিপুল সংখ্যক জনগণকে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। এসময় উপস্থিত নেতৃবৃন্দ ও এলাকাবাসী এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও বিচার দাবি করেন। এর আগে বিকেল পাঁচটার দিকে ওবায়দুরের লাশ ঝাউখোলায় পৌঁছালে সেখানে তার পরিবার ও প্রতিবেশীদের আর্তনাদে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

শনিবার সন্ধ্যার পর এই রিপোর্ট লেখার আগ পর্যন্ত একটি হত্যা মামলা দায়ের করতে কোতয়ালি থানায় বসে কাগজপত্র প্রস্তুত করছিলেন সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ওবায়দুর খানের পরিবার।

(আরআর/এএস/জানুয়ারি ১১, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

১৪ জানুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test