E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

টার্মিনাল পার্কিং ‘ফি’র নামে মহাসড়কে চাঁদাবাজি!

২০২৪ নভেম্বর ০৮ ১৭:৪৪:৫৮
টার্মিনাল পার্কিং ‘ফি’র নামে মহাসড়কে চাঁদাবাজি!

একে আজাদ, রাজবাড়ী : জরাজীর্ণ টার্মিনালে থামে না বাস। অথচ পার্কিং ফির নামে মহাসড়কে আদায় করা হচ্ছে চাঁদা। রাজবাড়ীতে ঢাকাগামী দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস থেকে এমন বেপরোয়া চাঁদা আদায় করছে বাস মালিকদের সংগঠন জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ। এতে ক্ষুব্ধ পরিবহন শ্রমিকরা। মহাসড়কে টার্মিনাল ফির টাকা নেয়াকে চাঁদাবাজি বলছে টার্মিনালের মালিক খোদ পৌর কর্তৃপক্ষ। আর এ চাঁদাবাজি বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস পুলিশের।

জানা গেছে, রাজবাড়ী পৌরসভার মালিকানাধীন শহরের শ্রীপুরে অবস্থিত কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালটি নানা অব্যবস্থাপনার কারণে নির্মাণের ৩২ বছরে চালু করতে পারেনি পৌর কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় টার্মিনাল ভবনের কক্ষগুলোর দরজা জানালা ভেঙে গেছে। খসে পড়েছে পলেস্তারা, চারপাশে জঙ্গল আর ময়লার ভাগাড়। জরাজীর্ণ বাস টার্মিনালটি পৌরসভার কাছ থেকে ইজারা নিয়েছেন জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক লিটন।

টার্মিনালে থামে না কোন বাস; অথচ পার্কিং ফির নামে টার্মিনাল থেকে তিন কিলোমিটার দূরে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের মুরগির ফার্ম এলাকায় দূরপাল্লার বাস থেকে আদায় করা হচ্ছে চাঁদা।

পরিবহন শ্রমিকদের অভিযোগ, টার্মিনাল পার্কিং ফির ৫০ টাকার স্লিপ ধরিয়ে বাসপ্রতি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা নিচ্ছে জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের লোকজন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ২ জানুয়ারি রাজবাড়ী জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের দ্বিবার্ষিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে পঞ্চমবারের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইরাদত আলী। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন রাবেয়া পরিবহনের স্বত্বাধিকারী আব্দুর রাজ্জাক লিটন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে কাজী ইরাদত আলী আত্মগোপনে থাকায় বর্তমানে গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পরিমল কুমার সাহা। ৫ আগস্টের আগে কাজী ইরাদত আলীর নেতৃত্বে চলতো পরিবহন থেকে চাঁদাবাজি। ঢাকাগামী পরিবহনগুলো থেকে প্রতি ট্রিপে ২৮০ টাকা করে চাঁদা নেয়া হতো। সরকার পতনের পর চাঁদা আদায় কিছুদিন বন্ধ ছিল। তবে ৩ সেপ্টেম্বর থেকে আবারও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পরিমল কুমার সাহা ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক লিটনসহ গ্রুপের প্রভাবশালী নেতাদের নেতৃত্বে শুরু হয় পরিবহন থেকে চাঁদাবাজি।

পরিবহন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজবাড়ীর ওপর দিয়ে ঢাকাগামী হানিফ, গোল্ডেন লাইন, রাবেয়া, জামান, সৌহার্দ্য, সপ্তবর্ণা, এফকে সুপার ডিলাক্স, রাজধানী এক্সপ্রেস, শ্যামলী, তুহিন, সরকার, এসবি সুপার ডিলাক্স, দিগন্ত, রোজিনা, লালন শাহ, বিআরটিসি, এমএম পরিবহনসহ কয়েকটি দূরপাল্লার যাত্রীবাহী পরিবহন যাতায়াত করে। এর মধ্যে রাবেয়া, জামান, সৌহার্দ্য, সপ্তবর্ণা, সরকার ও এমএম পরিবহনের মালিক রাজবাড়ী জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। অন্য দূরপাল্লার পরিবহনগুলো কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও ঢাকা বাস মালিক সমিতির অন্তর্ভুক্ত। রোজিনা ও দিগন্ত পরিবহনের মালিক ঢাকার গাবতলী সমিতির হওয়ায় তাদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়া হয় না। গোল্ডেন লাইন, হানিফ ও শ্যামলী পরিবহনের মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের কাছ থেকেও চাঁদা নেয়া হয়না। রাজবাড়ী জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত পরিবহনগুলোর জন্যও চাঁদা মওকুফ।

তবে কুষ্টিয়ার লালন শাহ, রাজধানী এক্সপ্রেস, এসবি সুপার ডিলাক্স ও এফকে সুপার ডিলাক্স পরিবহনসহ বাইরের আরও কিছু পরিবহন থেকে চাঁদা নেয়া হয়।

এসব পরিবহন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন কুষ্টিয়া থেকে ঢাকাগামী লালন শাহ পরিবহনের ৬ টি ট্রিপ রাজবাড়ীর ওপর দিয়ে চলাচল করে। এ পরিবহন থেকে প্রতি ট্রিপে ২০০ টাকা করে প্রতিদিন মোট ১ হাজার ২০০ টাকা চাঁদা নেয়া হয়। এসবি সুপার ডিলাক্সের ট্রিপ চলে ১৪ টি। এ পরিবহন থেকে প্রতি ট্রিপে ১৫০ টাকা করে মোট ২ হাজার ১০০ টাকা চাঁদা নেয়া হয়। এছাড়া রাজধানী এক্সপ্রেসের ৩ টি ট্রিপ থেকে ১৫০ টাকা করে ৪৫০ টাকা ও এফকে সুপার ডিলাক্সের ৪ টি ট্রিপ থেকে ১৫০ টাকা করে ৬০০ টাকা চাঁদা নেয়া হয়। শুধুমাত্র এ ৪ টি পরিবহন থেকেই প্রতিদিন চাঁদা নেয়া হয় ৪ হাজার ৩৫০ টাকা। যা মাসিক হিসেব করলে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা। বাইরের অন্য পরিবহনগুলো যোগ করে মহাসড়ক থেকে রাজবাড়ী জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের প্রতিমাসে তোলা চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত দেড় লাখ টাকা।

কুষ্টিয়া থেকে ঢাকাগামী লালনশাহ পরিবহনের হেলপার রতন বলেন, ‘অন্যান্য পরিবহন থেকে ১৫০ টাকা নিলেও লালন শাহ থেকে ২০০ টাকা করে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। আর আমাদের স্লিপ দিচ্ছে ৫০ টাকার। ১৫০ টাকা দিতে চাইলে সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের লোকজন আমাদের গাড়ি আটকে রাখার হুমকি দেয়।’

একই পরিবহনের সুপারভাইজার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘টার্মিনাল ফির নামে মহাসড়ক থেকে এভাবে চাঁদা নেয়ার কোন নিয়ম নেই। রাজবাড়ী জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের লোকজন আমাদের কাছ থেকে জোর করে প্রতি ট্রিপে ২০০ টাকা করে চাঁদা নিচ্ছে। আমরা এর প্রতিকার চাই।’

রাজধানী এক্সপ্রেসের চালক মো. হুসাইন বলেন, ‘আমাদের গাড়ি থেকে প্রতি ট্রিপে ১৫০ টাকা করে চাঁদা নেয় রাজবাড়ী জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের লোকজন। চাঁদা না দিলে তারা গাড়ি আটকে মালিককে ফোন দিয়ে আজেবাজে কথা বলে।’

এসবি সুপার ডিলাক্স ও এফকে সুপার ডিলাক্স কর্তৃপক্ষ জানায়, বাধ্য হয়েই তাদের ট্রিপ প্রতি ১৫০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে।

গত ২ নভেম্বর সময় টিভির এ প্রতিবেদক যাত্রী হিসেবে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকাগামী লালন শাহ পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বাসটি রাজবাড়ী শহরের মুরগির ফার্ম এলাকায় পৌঁছায়। সেখানে মহাসড়কের ওপর এক ব্যক্তি বাসটি থামানোর সংকেত দেন। গাড়ির গতি কমার পর বাসের সুপারভাইজার ওই ব্যক্তির হাতে ২০০ টাকা দেন। ওই ব্যক্তি সুপারভাইজারকে নীল রঙের একটি স্লিপ ধরিয়ে দেন। এসময় এ প্রতিবেদককে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করতে দেখে উত্তেজিত হয়ে তেড়ে আসেন ওই ব্যক্তি। তবে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি দ্রুত বাস থেকে লাফ দিয়ে নেমে সটকে পড়ার চেষ্টা করেন। এ প্রতিবেদক তার পেছন পেছন গিয়ে কিসের টাকা নিচ্ছেন জিজ্ঞেস করাতেই তিনি ভোঁ দৌড় দিয়ে পালিয়ে যান।

এসময় স্থানীয়রা জানান, ওই ব্যক্তির নাম বাপ্পা। তিনি রাজবাড়ী জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের কর্মচারী। তিনিসহ কয়েকজন কর্মচারী পরিবহন থেকে প্রতিদিন এভাবে চাঁদার টাকা তোলেন।

সুপারভাইজারকে দেয়া নীল রঙের স্লিপে লেখা দেখা যায়, ‘রাজবাড়ী পৌরসভা ও সরকার কর্তৃক অনুমোদিত রাজবাড়ী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল পার্কিং ফি আদায়ের রশিদ’ টার্মিনাল ফি ৫০ টাকা। ইজারাদার আবদুর রাজ্জাক লিটন (সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক)।

পৌর কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন ও সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের ভাষ্য, মহাসড়কে টার্মিনাল ফির টাকা নেয়াকে চাঁদাবাজি হিসাবে দেখছে টার্মিনালের মালিক খোদ পৌর কর্তৃপক্ষ।

রাজবাড়ী পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তায়েব আলী বলেন, ‘আমরা ইজারা দিয়েছি টার্মিনাল। এখানে ইজারার টাকা টার্মিনালের ভিতর থেকে উঠবে। অন্য কোথাও থেকে এই টাকা উঠানোর সুযোগ নেই। কোন ব্যক্তি বা কেউ যদি এই টাকা টার্মিনাল ব্যতীত অন্য কোন স্থান থেকে উঠায়, তাহলে সেটা চাঁদাবাজি হিসেবে গণ্য হবে। এটা আমরা সমর্থন করি না। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি।’

এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা।

এ প্রসঙ্গে হাইওয়ে পুলিশ মাদারীপুর রিজিয়নের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহিনুর আলম খান বলেন, ‘পৌরসভার টার্মিনালের পার্কিং ফির টাকা তারা তাদের এখতিয়ারসম্পন্ন স্থান থেকে নেবে। মহাসড়কে এসে চাঁদাবাজি করার কোন সুযোগ নেই। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখবো এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

তবে জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের দাবি এখতিয়ারবহির্ভূত কোন কিছু করছেন না তারা। গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক লিটন বলেন, ‘গ্রুপের সিদ্ধান্ত মেতাবেক সাধারণ সম্পাদকের নামে পৌরসভার কাছ থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা দিয়ে বাস টার্মিনালটি এক বছরের জন্য ইজারা নেয়া হয়েছে। টার্মিনালের পার্কিং ফি বাবদ বাস থেকে ৫০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। এখানে অন্যায় বা অবৈধভাবে চাঁদা তোলা হচ্ছে না।’

টার্মিনাল ফির টাকা টার্মিনাল থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মহাসড়কের ওপর তোলা হচ্ছে কেন? এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেননি জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক লিটন।

(একে/এসপি/নভেম্বর ০৮, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test