E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

‘অমঙ্গল’ আতঙ্কে মানুষশূন্য মঙ্গলপুর

২০২৪ নভেম্বর ০৬ ১৭:১২:৫৬
‘অমঙ্গল’ আতঙ্কে মানুষশূন্য মঙ্গলপুর

শেখ ইমন, ঝিনাইদহ : সরকারি নথিতে গ্রামটির অস্তিত্ব আছে। আছে ফসলি জমি, পুকুর, গাছগাছালি। শুধু নেই কোন কোলাহল। মানুষের বসতির চিহ্ন হয়ে টিকে আছে ঘরবাড়ির কিছু ধ্বংসাবশেষ। তবে একসময় গ্রামটি মেতে থাকত মানুষের কোলাহলে। ছিল হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান। উৎসব পালা-পার্বণ মাতিয়ে রাখত সারা বছর। সম্প্রীতির মেলবন্ধন ঘটানো সেই গ্রামে উৎসব তো দূরের কথা, এখন কোনো ঘরবাড়ির বালাই নেই। খাঁখাঁ করছে চারদিক। একসময়ের সমৃদ্ধ জনপদের চিহ্ন হিসেবে টিকে আছে পুরোনো আমলের ঘরবাড়ির ইটের টুকরা, উচুঁ ভিটা আর তিনটি পুকুর। মানুষশূন্য এই গ্রামের নাম মঙ্গলপুর। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নে এই গ্রামের অবস্থান। জনশ্রুতি আছে, বহু বছর আগে মঙ্গলপুর গ্রামের মানুষের মধ্যে ‘অমঙ্গল’ আতঙ্ক ভর করে। ভয়ে তখন গ্রাম ছেড়ে চলে যায় মানুষ।

কোটচাঁদপুর থেকে যশোরের চৌগাছা উপজেলার দিকে যাওয়া রাস্তা ধরে ৬ কিলোমিটার এগোলে হাতের বাঁয়ে মঙ্গলপুর গ্রাম। মূল রাস্তা থেকে একটি পার্শ্বসড়ক মঙ্গলপুরের ভেতর দিয়ে চলে গেছে অন্য পাশের ত্রিলোচনপুঁর গ্রামের দিকে। এক হাজার মিটারের এই পার্শ্বরাস্তাটি ইটের তৈরি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তৈরি করতে খরচ হয়েছে প্রায় ৫৯ লাখ টাকা। এর আগে কাঁচা সড়ক ছিল মঙ্গলপুরের ভেতর দিয়ে। এর দুই পাশজুড়ে একসময় ছিল মঙ্গলদের বসবাস।

কোটচাঁদপুর এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা বলেন, ‘অনেক বছর আগে মঙ্গলপুর গ্রামে মহামারি আকারে কলেরা রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেক মানুষ মারা যান। আতঙ্কে অন্যরা আশপাশের গ্রামে আশ্রয় নেন। কিছু পরিবার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে যায়।’

স্থানীয় বাবর আলি জানান, ‘মঙ্গলপুর গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। গ্রামটিতে হঠাৎ কলেরা মহামারি আকার ধারণ করে। এতে অনেক মানুষ মারা যায়। তিনি বলেন, ওই সময় একটা কথা ছড়িয়ে পড়ে, গ্রামের খাল-বিল, পুকুর-কুয়ার পানি নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে থাকলে সবাইকে মরতে হবে। ভয়ে দলে দলে গ্রাম ছাড়তে শুরু করে মানুষ। কয়েকটি পরিবার পাশের বলাবাড়িয়া ও চাকলা গ্রামে আশ্রয় নেন। পরে ওই গ্রামে আর ফিরে যাননি।

স্থানীয় ইসহাক আলী জানালেন, ‘মঙ্গলপুর বিরাট বড় গ্রাম ছিল। বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষের বসত ছিল সেখানে। গ্রামটিতে ঠাকুর সম্প্রদায়ের বেশ প্রভাব ছিল। হাওলা ঠাকুর, লেটো ঠাকুরের বংশধরেরা এখানে বসবাস করতেন। হঠাৎ গ্রামে অমঙ্গলের ঘটনা ঘটতে থাকে। এরপর একে একে সবাই গ্রাম ছেড়ে যান।’

মঙ্গলপুর থেকে মানুষজন উধাও হওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত দুটি কারণ জানা গেছে। একটি কলেরা, আরেকটি অমঙ্গলের ছায়া।

মঙ্গলপুরের পশ্চিম পাশের গ্রামের নাম বাগডাঙ্গা। সেই গ্রামে বসবাস করা সিরাজুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘মঙ্গলপুরে মঙ্গল নামে এক হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। সে কারণেই গ্রামের এমন নাম। ওই গ্রামের মঙ্গলরা ছিলেন খুব রক্ষণশীল। মঙ্গল নারীদের চেহারাও কেউ দেখতে পেতেন না। সব সময় তারা থাকতেন ঘরের ভেতর। তবে একদিন ঘটে অঘটন। মুসলিম এক যুবক পুকুরে গোসলরত এক মঙ্গল নারীকে দেখে ফেলন। সে ঘটনা মঙ্গল সমাজে ব্যাপক আলোচিত হয়। এরপর রাতারাতি এলাকা ছেড়ে অজানা গন্তব্যে চলে যায় মঙ্গল পরিবারগুলো।

সিরাজুল ইসলামের ভাষায়, এরপর একে একে অমঙ্গলের ঘটনা ঘটতে থাকে মঙ্গলপুর গ্রামে। কিছুকালের মধ্যেই গ্রামটি হয়ে পড়ে জনমানবশূন্য।

পুরো গ্রামটি এখন বিস্তৃত মাঠ। মসুর ডাল,মটরশুঁটি আর নানা সবজির চাষ হয় এখানে। আছে ভুট্টা, কলা ও আখের ক্ষেত। সড়কটিতে তেমন যানবাহন নেই। বেশ কিছুটা হাঁটার পর রাস্তার দুই পাশে দুটি পুকুর চোখে পড়ে। পুকুরপাড়ে গেলে পুরোনো আমলের বাসনকোসনের ভাঙা টুকরা দেখা যায়। এগুলো দেখে আন্দাজ করা যায়,পুকুর দুটি বেশ পুরোনো।

গ্রামটির ভেতরে ক্ষেতে সার দেওয়া আব্দুল হালিম খান বলেন, ‘বহুদিন আগে মানুষের বসতি ছিল মঙ্গলপুর গ্রামে। বাপ-দাদার কাছে শুনেছেন তাদের গল্প। মঙ্গলদের প্রধান মঙ্গল পাঠানের বাড়িটি ছিল একটি পুকুরের পাশে। তার অধীনে বহু মানুষ গ্রামে বসবাস করতেন। তবে তারা কেন চলে গেছেন সেটা কেউ জানেন না। ওই আমলের একটা দরগাহ এ গ্রামে আছে।’

গ্রামটিতে ঢোকা সড়কটি পাশে আবাদি জমি পেরোলেই চোখে পড়ে একটি পুকুর। এই পুকুরটি মঙ্গলপুরের তিনটি পুকুরের একটি। এর পাশেই দরগাহর অবস্থান। দরগাহ বলতে শুধু ইট-বালু আর সিমেন্টর মিনার। তাতে লেখা, ইয়া আল্লাহ, দরবার শরীফ মিনার। পাশে চাঁদের আকৃতি আঁকা। নির্মাণের সময়কাল উল্লেখ রয়েছে ১৯৭৬ সাল। তা দেখে বোঝা যায়, দরগাহর মিনারটি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের। তার আগেই গ্রামটি জনমানবশূন্য হয়েছে। দরগাহর আশপাশে নিস্তব্ধ পরিবেশ। চারদিক গাছপালায় ঢাকা।

স্থানীয়দের দাবি, এখানে বিভিন্ন মানুষ এসে মানত করেন। যারা যে আশায় মানত করেন, তা পূরণ হয়। মঙ্গলদের সময়ে এ দরগাহ না থাকার বিষয়টি এর নির্মাণের তারিখ থেকেই স্পষ্ট। তবে স্থানীয়দের অনেকেই বলছেন, দরগা আছে অনেক পুরোনো আমল থেকে।

উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মঙ্গলপুর নামে গ্রাম আছে। তবে সেখানে কোনো ভোটার নেই।

গ্রামটিতে ইতোমধ্যে সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে সাতটি ভূমিহীন পরিবারের জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে তারা বসবাস করছেন। পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক।

কোঁটচাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উছেন মে বলেন, ‘গ্রামটিতে মানুষ না থাকলেও চাষাবাদ হয় বলে শুনেছি। কলেরা মহামারি আকার ধারণ করায় অনেক মানুষ মারা যায় পরে সবাই গ্রামটি ছেড়ে চলে যায় বলেও স্থানীয়রা জানিয়েছে।’

(এসআই/এসপি/নভেম্বর ০৬, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

০৭ নভেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test