E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ধারের টাকার এমপি থেকে হাজার কোটির মালিক

২০২৪ অক্টোবর ২৫ ২২:৩৬:৫১
ধারের টাকার এমপি থেকে হাজার কোটির মালিক

একে আজাদ, রাজবাড়ী : ধারের টাকায় হয়েছিলেন এমপি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সাবেক রেলপথ মন্ত্রী ও রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. জিল্লুল হাকিমকে। রাজবাড়ী-২ আসন থেকে পাঁচবার এমপি নির্বাচিত হন।

এ সময় নিজে ও স্ত্রী-সন্তান মিলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, টেন্ডার বাণিজ্য, বালু উত্তোলন, জমি দখল, বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যায় ইন্ধনের অভিযোগও আছে। তার বাড়ির কেয়ারটেকারও কোটিপতি হয়ে গেছেন।

জিল্লুল হাকিমের দুঃশাসন থেকে বিএনপি-জামায়াতই নয়, দলীয় নেতাকর্মীরাও রেহাই পাননি। তার এসব অপকর্মের জন্য ছেলে আশিক মাহমুদ মিতুল হাকিম গড়ে তোলেন হাতুড়ি বাহিনী। শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর গা ঢাকা দিয়েছেন জিল্লুল হাকিম ও তার স্ত্রী-সন্তান। ইতোমধ্যে দুদকের আবদেনে তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।

জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে মাত্র ৫০ হাজার টাকা ঋণখেলাপির কারণে জিল্লুল হাকিমের মনোনয়ন বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়। তখন আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে প্রথমবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হন। এরপর থেকে তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।

জিল্লুল হাকিমের সম্পদের পাহাড় :
জিল্লুল হাকিমের ৫০ কোটি টাকা মূল্যের রাজধানীর উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ৮/এ নম্বর রোডে ১০ কাঠা জমির ওপর সাততলা ভবন, এ বাড়ির সামনে পাঁচ কাঠার একটি প্লট, রাজধানীর বনানী সুপার মার্কেটের পেছনে অর্চার্ড হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, সিঙ্গাপুরে ১৪ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট ও জাপানে বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও জেলা পরিষদের ১৩ শতাংশ জমি দখল ও সংখ্যালঘুদের ২০ শতাংশ জমি নামমাত্র মূল্যে রেজিস্ট্রি করে পাংশা পৌর শহরের স্টেশন বাজারের সামনে চারতলা মার্কেট নির্মাণ করেছেন।

পাংশার পারনারায়ণপুর মসজিদের পাশে ২০ বিঘা জমিতে বাগান বাড়ি এবং নারায়ণপুরে নিজের বাড়ির সামনে ১২ শতাংশ জমি ক্রয় করে তিনতলা ভবন নির্মাণ করছেন। রাজবাড়ী শহরের বড়পুল এলাকায় বসুন্ধরা সিনেমা হলের ৪২ শতাংশ জমি স্ত্রী সাহিদা হাকিমের নামে এবং কালুখালী উপজেলা পরিষদের পাশে ৬ বিঘা জমি নিজের নামে ক্রয় করেন। বালিয়াকান্দি সদর ইউনিয়নের চামটা, দেওকোল মৌজায় ১২টি পরিবারের ১০৭ বিঘা জমি নামমাত্র মূল্যে রেজিস্ট্রি করে নেন। পাশেই তালতলা এলাকায় প্রায় ৬০ বিঘা জমি সংখ্যালঘু গোবিন্দ পরিবারের ওপর নির্যাতন করে আওয়ামী লীগ নেতা বারেক বিশ্বাসের নামে নিলেও পরে তার নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তার ব্যবহারের জন্য রয়েছে বিলাসবহুল টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার, প্রাডো ভি-৮, পাজেরো ভি-৬সহ ৬টি গাড়ি। এ ছাড়াও রাজবাড়ী সদর, বালিয়াকান্দি, কালুখালী, পাংশা, রাজধানী ঢাকা ও বিদেশে নামে-বেনামে সম্পদ রয়েছে।

এ ছাড়া জিল্লুল হাকিম ছেলের মিতুল ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে শতাধিক যুবকের কাছ থেকে জাপান পাঠানোর নামে প্রায় ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এর মধ্যে ১০ জনকে জাপান পাঠালেও বাকিদের টাকা ফেরৎ দেননি।

পদ্মা ও গড়াই থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন :
পদ্মার ভাঙনে যখন মানুষ বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছিল, তখন পাংশার চর আফড়া, কালুখালীর গৌতমপুর, হরিণবাড়ীবাড়িয়া এলাকার অর্ধশতাধিক স্পটে এমপিপুত্র আশিক ও তার ক্যাডার তোফাজ্জেল, ফজলু মেম্বার, মারুফসহ বেশ কয়েকজন বালু উত্তোলন করেন। কালুখালীর চর পাতুরিয়া গড়াই নদীর বালুমহাল সাওরাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম আলী ও মৃগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম.এ মতিনের নেতৃত্বে উত্তোলন করে বিক্রি করা হয়। এসব স্থান থেকে প্রতিদিন ১৫-২০ লাখ টাকার বালু বিক্রি করে এমপির স্ত্রী-সন্তান বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য :
পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালী উপজেলায় শতাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম প্রহরী পদে নিয়োগের মাধ্যমে প্রায় ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে জিল্লুল হাকিম ও তার স্ত্রী সাহিদা হাকিমের বিরুদ্ধে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সভাপতি ও নিয়োগ কমিটির লোকজনকে আটকে রেখে নিয়োগ সম্পন্ন করেন। জিল্লুল দম্পতি বালিয়াকান্দি সরকারি কলেজ, মীর মশাররফ হোসেন কলেজ, জাহানারা বেগম কলেজ, নারুয়া লিয়াকত আলী কলেজ, বালিয়াকান্দি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সভাপতি হয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

কমিশন বাণিজ্য :
৩টি উপজেলার সাব রেজিস্ট্রি অফিসে তার মনোনীত লোক দিয়ে কমিটি, সরকারি হাসপাতাল ও এলজিইডির টেন্ডার, হাট-বাজার থেকে খেয়াঘাট ও জলমহাল ইজারা সবই জিল্লুল হাকিমের কথায় হতো। এলজিইডির কাজ নিতে হলে আগেই জিল্লুল হাকিমকে ১৫% কমিশন দেওয়া লাগত। এ ছাড়াও টিআর, কাবিখা, কাবিটা, বিশেষ বরাদ্দ, ইজিপিপি প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা কাজ না করেই হাতিয়ে নিয়েছেন। কালুখালীতে একদিনে প্রায় চার শতাধিক ওয়াজ মাহফিল ও নামযজ্ঞানুষ্ঠানের নামে চারশ টন চাল হাতিয়ে নেন। কাগুজে অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তার সবই পকেটস্থ করেছেন তিনি।

দলীয় নেতকর্মীদের হত্যায় ইন্ধন :
জিল্লুল হাকিমের বিরুদ্ধে ইউপি, পৌরসভা, উপজেলা ও জেলা পরিষদসহ বিভিন্ন নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করার অভিযোগ রয়েছে। রাজবাড়ী জেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি ও পাংশা উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নাদের মুন্সীসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৭ জন নেতাকর্মী খুনের ঘটনায় ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এবং তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদের উপর নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। রাতের আঁধারে তাকে মেরে ১২ জায়গা ভেঙে দেয়া হয়েছে সে এখন পঙ্গুত্ব নিয়ে জীবন যাপন করছে।

বাড়ির কেয়ারটেকারও কোটিপতি :
জিল্লুল হাকিমের বাসার কেয়ারটেকার ছিলেন মিজানুর রহমান মজনু। সেখান থেকে জেলা পরিষদের সদস্য ও মদাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হন। এ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়েছেন কোটি কেটি টাকা। গড়ে তুলেছেন কোটি টাকা ব্যয়ে কালুখালীর চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ডে চারতলা বিলাসবহুল ভবন, গ্রামে বিল্ডিং, প্রায় ২০ বিঘা জমিসহ নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

(একে/এএস/অক্টোবর ২৫, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

২৬ অক্টোবর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test