E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care

For Advertisement

Mobile Version

কোটা আন্দোলনে নিহত স্বামী আলী হোসেন 

তিন কন্যা ও স্বামীর ৬ লাখ টাকার ঋণের বোঝা নিয়ে অঝোরে কাঁদছেন খাইরুন্নেচ্ছা

২০২৪ আগস্ট ১৮ ১৮:২৩:০৮
তিন কন্যা ও স্বামীর ৬ লাখ টাকার ঋণের বোঝা নিয়ে অঝোরে কাঁদছেন খাইরুন্নেচ্ছা

সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মা, কেন্দুয়া : কোটা আন্দোলনে গুলিতে নিহত হন পান দোকানদার আলী হোসেন। তার বয়স অনুমান ৪০ বছর। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার ১৪ নং মোজাফরপুর ইউনিয়নের মোজাফরপুর (পশ্চিমপাড়া) গ্রামে তার বাড়ি। তার পিতার নাম মৃত আসন আলী। আলী হোসেন জীবিকার তাগিদে ও ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য স্ত্রী খাইরুন্নেচ্ছাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান কাজের সন্ধানে। পেশা হিসেবে বেছে নেন পান-সিগারেটের দোকান। রাস্তার পাশে বসে উত্তরা আজমপুর এলাকায় প্রতিদিন সকাল থেকে সারাদিন পান-সিগারেট বিক্রি করতেন। স্ত্রী খাইরুন্নেচ্ছা অন্যের বাসায় করতেন ঝিয়ের কাজ। কোটা আন্দোলন শুরু হলেও জীবনের ঝুকি নিয়েই পান-সিগারেটের দোকান চালিয়ে যাচ্ছিলেন আলী হোসেন। কিন্তু কপাল মন্দ। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার গুলিতে তার বুক ঝাঝরা হয়ে যায়। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে গিয়ে তার মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। 

গতকাল শনিবার মোজাফরপুর (পশ্চিমপাড়া) গ্রামে সরেজমিন গিয়ে কথা হয় নিহত আলী হোসেনের স্ত্রী খাইরুন্নেচ্ছার সাথে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে খাইরুন্নেচ্ছা জানান, ঘটনার দিন সকালে তার স্বামী আলী হোসেনকে নিয়ে পান্তাভাত খেয়ে বাসা যার যার কাজে চলে যান। বেলা ২ টার দিকে বাসায় ফেরেন খাইরুন্নেচ্ছা। স্বামীকে নিয়ে আজমপুর মুন্সি বাজার এলাকায় মাসে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ওইদিন একসাথে দুপুরের খাবার খাবেন এই অপেক্ষায় বসে আছেন তিনি। কিন্তু বেলা আড়াইটা পর্যন্ত তার স্বামী বাসায় না ফেরায় তিনি চিন্তায় পরে যান। পরে মোবাইল ফোনে স্বজনদেরকে বাসায় না ফেরার বিষয়টি জানালে চারদিক থেকে স্বজনরা খুঁজাখুঁজিতে বের হন। অবশেষে সন্ধ্যার পরে তার মরদেহ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে পাওয়া যায়। সেখান থেকে এ্যাম্বুলেন্স যোগে মরদেহ নিয়ে বাড়িতে পৌছান রাত অনুমান ৪ টার দিকে। পরদিন সকালে নামাজের জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

খাইরুন্নেচ্ছা জীবনের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তিন কন্যা সন্তান রেখে তার স্বামী আলী হোসেন কোটা আন্দোলনে গুলিতে নিহত হয়েছেন। গুলিতে তার বুক ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল। তার বড় কন্যা সাদিয়ার বয়স ১৪ বছর। সে মোজাফরপুর মহিলা মাদ্রাসায় পড়ে। মধ্যম মেয়ে মাহিবার বয়স ৬ বছর। সে প্রাইমারী স্কুলে পড়ে। ছোট মেয়ে সাইবার বয়স ৩ বছর। এই তিন কন্যাকে তার শাশুড়ীর কাছে রেখেই তিনি স্বামী আলী হোসেনকে নিয়ে রাজধানী ঢাকায় ছুটে গিয়েছিলেন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে।

খাইরুন্নেচ্ছা আরও জানান, তার স্বামী আলী হোসেন চিকিৎসাসহ অভাবের তাড়নায় গ্রাম্য মহাজনদের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে তিন লাখ টাকার জন্য প্রতিমাসে সুদের লাভ হিসেবে ৩০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। আলী হোসেনের ছোট ভাই আবু বক্কর বলেন ভাই যার কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা নিয়েছিলেন তিনি লাভের টাকা অর্ধেক কমিয়ে প্রতিমাসে ১৫ হাজার টাকা দিতে বলেছেন। এই ৬ লাখ টাকা এখন কিভাবে পরিশোধ করবেন, কিভাবে দেবেন প্রতিমাসে লাভের টাকা, তা নিয়ে দিনরাত শুধু কাঁদছেন আর কাঁদছেন।

খাইরুন্নেচ্ছা বলেন, আমার সব শেষ অইয়্যা গেছে। আমি কি কইরা ৬ লাখ টাকার ঋণ দিব? তিন মেয়েরে নিয়া কিভাবে চলবো? আমি সরকারের কাছে আমার ঋণের টাকা পরিশোধ করে তিন মেয়েকে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে জীবন চলার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতেছি। সরকার আমারে সহযোগিতা না করলে এই ঋণের যন্ত্রনায় আমি মরে যাব।

তিনি বলেন, ইতিমধ্যে মোজাফরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: জাকির আলম ভূঞা জানাযার দিন এসে নগদ দশ হাজার টাকা, বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম হিলালী ৬ হাজার টাকা এবং উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মৌলানা হারুন-অর -রশিদ মেয়ের হাতে দিয়ে গেছেন ১ হাজার টাকা। তাছাড়া এলাকার আলেম সমাজ দিয়েগেছেন ১১ হাজার টাকা। তবে সরকারী ভাবে এখনো কোন টাকা পয়সা পাননি তিনি। সরকারী কোন কর্মকর্তাও থাকে দেখতে যাননি। তবে ইউএনও অফিস থেকে ফোন করে তার মেয়েদের লেখাপড়া বিনা খরচে করানোর জন্য বলে দিয়েছেন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার কথাও বলেছেন।

এ ব্যাপারে রোববার দুপুরে কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদারের সাথে তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি ব্যস্ততার কারণে যেতে পারেনি, তবে আলী হোসেনের মেয়েদের লেখাপড়া বিনা পয়সায় ব্যবস্থা করার জন্য বলে দিয়েছি। তাছাড়া খুব তাড়াতাড়ি আলী হোসেনের স্ত্রীকে একটি বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করে দেবো। সে জন্য ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। কাল-পরশুর মধ্যেই আর্থিক ভাবে সহযোগিতাও করা হবে। তবে কি পরিমান সহযোগিতা করা হবে তা তিনি এখনো বলতে পারেননি।

ইউএনও ইমদাদুল হক তালুকদার আরও বলেন, আলী হোসেনের স্ত্রী ঢাকায় কারো বাসায় ঝিয়ের কাজ করতেন। এখন যদি মনে করেন এলাকায় থাকবেন, সেক্ষেত্রে আমরা তাকে সেলাই প্রশিক্ষণ ও সেলাই মেশিন দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব। এছাড়াও যদি আরও কোন সরকারী সহযোগিতার সুযোগ থাকে সেটি তিনি পাবেন।

(এসবি/এসপি/আগস্ট ১৮, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

১৫ জানুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test