E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

প্রধান শিক্ষক গোপাল গাইনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে বিল ও ভাউচার তৈরির অভিযোগ

২০২৪ জুলাই ১৭ ২০:৫০:২১
প্রধান শিক্ষক গোপাল গাইনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে বিল ও ভাউচার তৈরির অভিযোগ

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সরকারি কালিগঞ্জ পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গোপাল চন্দ্র গাইনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিল ও ভাউচার তৈরি করে সেবা খাতের আত্মসাতকৃত ৫ লক্ষাধিক টাকা বদহজমের অভিযোগ উঠেছে। অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করা হয়েছে।

সরকারি কালিগঞ্জ পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৩৩ সালে কালিগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ওই বিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় কালিগঞ্জ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ২০১৭ সালে সরকারিকরণের সময় ওই বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় সরকারি কালিগঞ্জ পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়। সরকারিকরণের পর থেকে বিদ্যালয়ে কোন পরিচালনা কমিটি নেই। কারিগরী শিক্ষা অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কর্মকর্তা (খুলনা) সব কিছু দেখভাল করে থাকেন। এ ছাড়ায় জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তদারকি করে থাকেন। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ৫৫৫ জন শিক্ষার্থী থাকলেও প্রায় আসে না ৮৩জন।

২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটের অতিরিক্ত চাহিদার বিপরীতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ বিদ্যালয়ে সেবা খাতের ২১ টি বিভাগে মোট ছয় লাখ নয় হাজার ১৮৩ টাকা গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর বরাদ্দ আসে। বরাদ্দকৃত খাত গুলো হলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বাবদ্দ বাবাদ পাঁচ হাজার, আপ্যায়ন ব্যয় ২ হাজার , বিদ্যুৎ বিল বাবদ পাঁচ হাজার, পানি পাঁচ হাজার, ইন্টারনেট বাবদ ২০ হাজার, ডাক বাবদ দুই হাজার, টেলিফোন বাবদ ১০ হাজার, বইপত্র সাময়িকী ২৫ হাজার, ভ্রমণ ব্যয় বাবদ ১৫ হাজার, অন্যান্য মনিহারি মুদ্রণ ও মনোহারি ১৫ হাজার, রাসায়নিক দ্রব্যাদি ৩৫ হাজার, ব্যবহার্য দ্রব্যাদি ৪০ হাজার, পোশাক কাঁচামাল সামগ্রী বাবদ ২০ হাজার, অনুষ্ঠান উৎসবাদি বিশেষ ব্যয় ২০ হাজার, কম্পিউটার মেরামত সংরক্ষণ ১০ হাজার, অন্যান্য যন্ত্রপাতিও সরঞ্জাম মেরামত ও সংযোজন ৩৫ হাজার, ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ পাঁচ হাজার, কম্পিউটার এবং আনুষাঙ্গিক খরচ বাবদ ১০ হাজার, গবেষণার সরঞ্জামাদি এক লক্ষ ২০ হাজার, অফিস সরঞ্জামাদি ১০ হাজার, শিক্ষা ও শিক্ষা উপকরণ খরচ বাবদ ৩৫ হাজার টাকা। স্ট্যাম্প, ভ্যাট ও আইটি বাদে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৫৫২ টাকা উত্তোলন করে বিদ্যালয়ের সেবা খাতের হিসাব নম্বরে না রেখে গত ৩০ জুন নিজের ব্যাংক হিসেবে রাখেন চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারি গোপাল চন্দ্র গাইন।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিপত্র অনুযায়ি বিদ্যালয়ে সেবা খাতসহ ২১টি খাত রয়েছে। ওইসব খাতে চাহিদা অনুযায়ি অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে। প্রতি খাতে এ থেকে ২৪ হাজার ৯৯৯ টাকা জিনিসপত্র কেনার জন্য প্রধান শিক্ষক নিজে অথবা কাউকে সঙ্গে নিতে পারেন। সে অনুযায়ি বিল ও ভাউচার সংগ্রহ করে তিনি উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে জমা দিতে পারবেন। তবে ২৫ হাজার টাকা বা ততোধিক অংকের টাকার জিনিসপত্র কেনার জন্য প্রধান শিক্ষককে বিজ্ঞপ্তি আহবান করতে হবে। সে অনুযায়ি জাম দিতে হবে কোটেশান। মালামাল ক্রয়ের জন্য শিক্ষকদের নিয়ে কমিটি গঠন ও কেনার পর মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে যাঁচাই করতে হবে। হিসাবরক্ষণ অফিসে জমা দেওয়া বিল ও ভাউচারের পিছনে স্মারক নাম্বার ছাড়াও কোন রেজিষ্টারের কত নং পাতা তা উল্লেখ করতে হবে। এজন্য হিসাবরক্ষণ অফিসার প্রি অডিট ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক কর্মকর্তার অফিস থেকে পোষ্ট অডিটের ব্যবস্থা থাকবে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য তাকে বছরে ১৮ হাজার টাকা দেওয়া হয়। তবে একজন শিক্ষক হিসেবে তাকে প্রয়োজনীয় ক্লাস নিতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি কালিগঞ্জ পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক জানান, চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি গোপাল চন্দ্র গাইন এ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর তিনি ১০ম শ্রেণীতে ক্লাস নেবেন এমনভাবে রুটিন করা হয়। তবে গত সাড়ে ছয় মাসে কোন ক্লাস না নিলেও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে ছয় মাস দায়িত্ব পালনের জন্য উত্তোলন করেছেন নয় হাজার টাকা। একইভাবে ইন্টারনেট বাবদ সেবা খাত থেকে ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হলেও সাধারণ খাত থেকেও ওই টাকা নিয়ে নিজের পকেটে রাখার অভিযোগ রয়েছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে।

কয়েকজন শিক্ষকের অভিযোগ, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সেবা খাতে মোট বরাদ্দের টাকা হতে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শাহিনুর রহমানের মাধ্যমে উপজেলার বিভিন্ন বাজার থেকে অগ্রিম অলিখিত বিল ভাউচার সংগ্রহ করেন গোপাল চন্দ্র গাইন। কোন মালামাল না কিনে ওইসব বিল ভাউচার নিজ হাতে লিখে বা সহকারি প্রধান শিক্ষক আসাফুর রহমানের মাধ্যমে লিখিয়ে নিয়ে সশরীরে উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিসে জমা দিয়েছেন গোপাল চন্দ্র গাইন। সে অনুযায়ি ওই ৫ লক্ষ ৫১ হাজার ৫৫২ টাকা টাকা আত্মসাতের লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের সেবা খাতের হিসাব নম্বরে না রেখে গত ৩০ জুন নিজ হিসাব নম্বরে সরাসরি জমা করেছেন। পহেলা জুলাই ও তার পরবর্তী সময়ে বিষয়টি জানতে পেরে সুবিধাবঞ্চিত (এ নিয়ে আগে থেকে সেবা খাতে সুবিধাভোগী) সহকারি শিক্ষক আব্দুল মোমিন, আব্দুল্লাহ ও সহকারি প্রধান শিক্ষক আসাফুর রহমান সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে দেন। এ নিয়ে সাংবাদিকরা টেলিফোন করতেই নড়েচড়ে বসেন প্রধান শিক্ষক।

তিনি গত ৯ জুলাই মঙ্গলবার দুপুরে সহকারি প্রধান শিক্ষক আসাফুর রহমান, সহকারি শিক্ষক মোমিন, আব্দুল্লাহসহ চারজনকে নিয়ে মাইক্রোযোগে সাতক্ষীরায় যান। সেখানে বিভিন্ন ধরণের বই ও ক্রীড়া সামগ্রীসহ মালামাল কিনে মোট ক্রয়কৃত মালের তালিকা প্রস্তুত করে নেন অফিস সহকারি খলিলুর রহমানের মাধমে। ১১ মার্চ তিনি ২১টি খাতের জন্য ২১ জন শিক্ষককে ক্রয় কমিটির প্রধান করে অপর দুইজন শিক্ষককে সহকারি হিসেবে নিযুক্ত করে ২১টি ক্রয় কমিটি গঠণ করেন। চতুর্থ শ্রেণীর কমংচারিদের বরাদ্দকৃত পোশাক বাবদ টাকা যথাসময়ে না দিয়ে দিয়েছেন গত ১৪ জুলাই। এরপরও বিপদ বুঝে গত ১৪ জুলাই প্রধান শিক্ষক ছুটে আসেন জেলা মাধ্যকি শিক্ষা অফিসারের কাছে। তিনি বিপদমুক্ত করণের আশীর্বাদ দেওয়ায় বর্তমানে ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন গোপাল চন্দ্র গাইন।

এছাড়া তাকে বিপদমুক্তিতে আশ্বস্ত করেছেন জনৈক ক্রাইম রিপোর্টার ইমন। যদিও শিক্ষা সচেতন শতাধিক অভিভাবক গত ১৪ জুলাই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে মার্চ পিটিশন করায় নতুন করে তদন্ত হলে প্রধান শিক্ষক নিজের শেষ রক্ষা করতে পারবেন না বলে মনে করেন সুশীল সমাজের নাগরিকবৃন্দ। তবে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি ছাড়াও সহকারি শিক্ষকদের প্রতি অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে। তার কথামত কাজ না করলে বার্ষিক মূল্যায়নপত্রে (এসিআর) প্রথম গ্রেড এর পরিবর্তে তৃতীয় গ্রেড দেওয়ার হুমকি দেওয়ায় কেউ তার অনিয়মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পান না।

এ ব্যাপারে কালিগঞ্জ উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের কর্মকর্তা মোঃ নাজিম উদ্দীন জানান, ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক গোপাল চন্দ্র গাইন কোন পিওনকে না পাঠিয়ে নিজেই সেবা খাতের বিল ভাউচার জমা দিয়েছেন। প্রি অডিট করতে যেয়ে তিনি যথেষ্ট সতর্ক থেকেছেন। তবে বরাদ্দকৃত টাকা সেবা খাতের মূল হিসাব নম্বরে জমা না দিয়ে নিজ হিসাব নম্বরে জমা দেওয়ায় পোষ্ট অডিটে তার দূর্ণতি ও অনিয়ম ধরা পড়বে।

এ ব্যাপারে সরকারি কালিগঞ্জ পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গোপাল চন্দ্র গাইন বিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার কথা নিশ্চিত করে বলেন, সাংবাদিকদের বলেন, সেবা খাতের সকল টাকার মালামাল গত ১১ জুলাই বিদ্যালয়ে মজুত রাখা হয়েছে। তদন্তে তিনি যথাযথভাবে ত্রুটিমুক্ত হবেন।

তবে সহকাারি প্রধান শিক্ষব আসিফুর রহমান, মোমিন ও আব্দুল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেন।

কারিগরি শিক্ষা বিভাগের খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক রুহুল আমিন বলেন, সাতক্ষীরার সরকারি কালিগঞ্জ পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গোপাল চন্দ্র গাইনের বিরুদ্ধে সেবা খাতে মালামাল ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

(আরকে/এএস/জুলাই ১৭, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

৩০ আগস্ট ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test