E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

কেমন আছেন মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসা 'রেশমা'?

২০১৪ এপ্রিল ২৪ ১৭:২২:৩৩
কেমন আছেন মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসা 'রেশমা'?

স্টাফ রিপোর্টার : ধসে পড়ার রানা প্লাজার মৃত্যুকূপ থেকে ১৭ দিন পর ফিরে এসেছিলেন রেশমা, শিরোনাম হয়েছিলেন বিশ্ব গণমাধ্যমের। সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার জন্ম দেওয়া রেশমার কেটেছে একটি বছর।

পাঁচ তারকা হোটেলে কাজ পেয়েছিলেন নিজের তারকা খ্যাতির সুবাদে। এক বছর ধরে কাজ করছেন সেখানে। এক বছরের মাথায় পাল্টে গেছে তার জীবনযাত্রা। জীবিত উদ্ধার হওয়া ভাগ্যবানদের মধ্যে রেশমা অনেকটা বেশিই ভাগ্যবান। কাজ করছেন বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে। থাকছেন মনোরম পরিবেশে।

বিয়ে করে একবার প্রতারিত হয়েছিলেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর নতুন জীবন পাওয়া রেশমা ফের নতুন সংসার শুরু করেছেন। জীবনের শুরুতে অনটনে দিন পার করলেও এখন শান্তি আর স্বস্তির সময় পার করছেন ২০ বছর বয়সী রেশমা।

হোটেল ওয়েস্টিনে পাবলিক এরিয়া এ্যাম্বাসেডর হিসেবে গত বছরের জুন মাসের শেষের দিকে নিয়োগ দেয়া হয় তাকে। তখন তার বেতন নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৫ হাজার টাকা। শুরুতেই তাকে দশ মাসের অগ্রিম বেতন দেয়া হয়। বর্তমানে আগের চেয়ে বেশি বেতন পাচ্ছেন বলে ওয়েস্টিন সূত্রে জানা গেছে।

রেশমা উন্নত মানের খাবার ও পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। মর্যাদাও বেড়েছে তার। বর্তমানে তিনি ওয়েস্টিনের হাউজকিপিং বিভাগের আউটফিডের কাজ করছেন। ৬ মাসের ট্রেনিং শেষে গত জানুয়ারি মাসে তিনি কাজ শুরু করেন। এখন ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। দক্ষতার সঙ্গে কম্পিউটার চালান। তার কাজের ব্যাপারে সন্তুষ্ট ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ।

কাজের বাইরে অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ নেই রেশমার। হোটেলে কাজ করেন, থাকেন কর্মীদের ডরমিটরিতে। কাজে যোগ দেয়ার পর দু’একবার দিনাজপুরে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। সাভারে বোনের বাসায়ও গেছেন কয়েকবার। তবে এত দিন অনেকটা গণমাধ্যমের অগোচরেই ছিলেন তিনি। হোটেল কর্তৃপক্ষের কড়াকড়ির কারণে গণমাধ্যম সাক্ষাৎ পায়নি তার। কয়েকবার হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তার সাক্ষাৎ মেলেনি।

অতি সম্প্রতি রেশমার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য যোগাযোগ করা হয় হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। তবে এ বিষয়ে অনুমতি দেননি তারা। রানা প্লাজার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রেশমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে হোটেল কর্তৃপক্ষ জানায় তিনি ছুটিতে আছেন।

যদিও ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষের দাবি, রেশমার চলাফেরা নিয়ে কোন প্রকার নিষেধাজ্ঞা নেই। ছুটি কাটিয়ে সোমবার কাজে যোগ দেয়ার কথা থাকলেও মঙ্গলবার পর্যন্ত তিনি কাজে যোগ দেননি। দিনাজপুর থেকে ফিরে তিনি অবস্থান করছেন সাভারে বোনের বাসায়। সেখানেই মঙ্গলবার গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন। যদিও ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিরে আসার সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে কোন কথা বলতেই তিনি নারাজ। তার মতে সেই স্মৃতি আউড়ে তিনি আর দুঃখ বাড়াতে চান না। মঙ্গলবার রাতে বোনের বাসায় ঘরোয়া পরিবেশেিতিন এ কথা বলেন। অলৌকিকভাবে উদ্ধার হওয়ার ঘটনা ঘিরে থাকা প্রশ্ন ও বিতর্কের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, যারা বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ করে তাদের প্রতি কোনো রাগ নেই তার।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যারা এসব বলে, তারা তো না জেনে বলে। তারা তো ওখানে থাকেনি। থাকলে বুঝতো। কারও সঙ্গে ঝগড়া বা মারামারি করে তো আমি পারবো না। কেউ সামনে বললে বোঝানোর চেষ্টা করি।

তিনি বলেন, আমি আর সেই সময়ের কথা বলতে চাই না। তা ভুলে থাকতে চাই। ওয়েস্টিনে কি কাজ করেন জানতে চাইলে রেশমা জানান তিনি আউটফিট ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন।

তার কাজ সম্পর্কে বলেন, হোটেলের স্টাফদের ইউনিফরমের হিসাব রাখেন তিনি। ডিউটির শুরুতে ইউনিফরম বিতরণ করেন। আর কাজের শেষে হিসাব বুঝে নেন। সেখানে তাকে ৯ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওয়েস্টিনের চাকরি যখন নিয়েছি করতে তো হবেই। যতদিন পারি করবো ইনশাআল্লাহ। বর্তমানে গুলশানে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন রেশমা। সেখানে কোন আত্মীয়-স্বজনকে রাখেননি। ওয়েস্টিনের সহকর্মীদের সঙ্গে থাকছেন। পরিবারে শুধু মাকেই টাকা-পয়সা দেন তিনি। মাস তিনেক আগে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। স্বামী হানিফ সাভারে একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। সাভারে পরিবার নিয়ে থাকেন। সাভারে আরও পাঁচ থেকে ছয় দিন অবস্থান করবেন বলে রেশমা জানান। এখন নতুন সংসার নিয়ে ভাবছেন তিনি। স্বামী আলাদা থাকলেও তিনি চাইছেন স্বামীকে নিয়ে একত্রে থাকতে।

তিনি জানান, আজ রানা প্লাজা ধসের দিনে নিহত ও নিখোঁজ সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন ফুল দিয়ে। পাঁচ বছর আগে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে রেশমার প্রথম বিয়ে হয়। তার দুই বছর পর রাজ্জাক তাকে তালাক দেন। জীবিকার তাগিদে তার আরেক বোনের সঙ্গে ঢাকায় আসেন তিনি। ঢাকায় এক ব্যাংক কর্মকর্তার বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেন। সেখান থেকে রেশমা সাভারে গার্মেন্টে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে কিছু দিন কাজ করার পরই ঘটে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি।

রেশমার গ্রামের বাড়ি ঘোড়াঘাট উপজেলার কশিগাড়ীর রানীগঞ্জে। রেশমারা ৩ বোন ২ ভাই। সব ভাইবোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা সবাই স্বাবলম্বী। রেশমা সবার ছোট। রেশমার এক বছর বয়সে তার পিতা আনছার আলী মারা যান। পরে রেশমার মা অন্যত্র বিয়ে করেন। সেখানেই আছেন তিনি। সরকার ও রেশমার দেয়া টাকায় পাকা দালান তুলেছেন। তবে আয়ের উৎস না থাকায় অভাব লেগেই আছে সংসারে।

এলাকাবাসী জানায়, রেশমার সৎ পিতা খেয়ালি প্রকৃতির। সে কারণেই রেশমা তাকে টাকা দেন না। মাকে মোবাইলফোন কিনে দিলে সৎ পিতা তা বিক্রি করে দেন। তাই রেশমার মায়ের কোন মোবাইলফোন নেই। মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন অন্যের ফোনে। রেশমার প্রতিবেশীরা জানান, আগে পার্শ্ববর্তী বাজারে ঝাড়ু দেয়ার কাজ করে সেই আয় থেকে সংসার চলতো রেশমার মায়ের। এখন আর সেটাও করা সম্ভব হচ্ছে না। মাসে মাত্র দুই হাজার টাকা পান মেয়ের কাছ থেকে। মেয়ে রেশমার অনেক টাকা আছে ভেবে তাকে কেউ আর কাজ দেয় না। আগে মানুষের সাহায্য সহযোগিতায় সংসার চললেও এখন সে সুযোগ নেই তার। রেশমার ভগ্নিপতি শহীদুল আলম খোকন থাকেন সাভারের রাজাসন বাজারে। সেখানে তিনি অটোরিকশা চালান। রেশমা তার পরিবারকে টাকা-পয়সা দিচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, রেশমা ছোট মানুষ। তাই সে পরিবারে টাকা না দিলেও কেউ চাপ দেয় না। রেশমার মা জোবেদা বেগম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, তিনি বাসায় ইট ভেঙে খোয়া তৈরি করেন। সেই খোয়া বিক্রির টাকায় সংসার চালাচ্ছেন। রেশমার সৎ পিতাও একই কাজ করেন।

গত বছরের ২৪শে এপ্রিল ৯তলা রানা প্লাজা ভবন ধসে পড়ার ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয়েছিল রেশমা আক্তারকে। ভবন ধসে পড়ার পর প্রথম কয়েক দিন সেখান থেকে আটকে পড়া শ্রমিকদের জীবিত উদ্ধার করা হয়। ঘটনার ১১০ ঘণ্টা পর ২৮শে এপ্রিল আর কাউকে জীবিত উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরানোর জন্য ভারি যন্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী কাজও চলে। ঘটনার ৪১৬ ঘণ্টার মাথায় পুরো ভবনের ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ যখন প্রায় শেষের দিকে। ভয়াবহ এ ট্র্যাজেডিতে লাশের সংখ্যা তখন এক হাজার ছাড়িয়েছে। বিশ্ব গণমাধ্যমে রানা প্লাজা নিয়ে নানা নেতিবাচক খবর আসছিল নিয়মিত। এমনই এক সময়ে অবিশ্বাস্য ও অলৌকিকভাবে ১০ই মে বিকালে উদ্ধার করা হয় রেশমাকে।

ভবন ধসের সহস্র প্রাণহানির খবর ছাপিয়ে গণমাধ্যমে স্থান করে নেয় রেশমা উদ্ধারের কাহিনী। বিশ্বের প্রভাবশালী দৈনিকগুলোতে স্থান পায় এ উদ্ধার অভিযানের চিত্র। তিন তলার দুই ফ্লোরের একটি ফাঁকা স্থান থেকে রেশমাকে উদ্ধারের সময় তার পরনে ছিল পরিপাটি পোশাক। এ নিয়ে উপস্থিত এক সাংবাদিক প্রশ্ন তুলে জন্ম দেন বিতর্কের। লন্ডনভিত্তিক পত্রিকা সানডে মিরর রেশমাকে উদ্ধারের ঘটনাকে ‘সাজানো নাটক’ বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যদিও এসব প্রশ্ন আর বিতর্ক উড়িয়ে দিয়ে উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছিলেন, অবিশ্বাস্য আর অলৌকিকভাবেই বেঁচে ছিলেন রেশমা।

(ওএস/এটি/এপ্রিল ২৪, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৩ জানুয়ারি ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test