E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

রংপুরে ভাষা আন্দোলনের অজানা কথা

মূল বিরোধিতাকারী ছিলেন কারমাইকেলের অধ্যক্ষ শাহাব উদ্দিন

২০২১ ফেব্রুয়ারি ২০ ১৫:১৫:০৭
মূল বিরোধিতাকারী ছিলেন কারমাইকেলের অধ্যক্ষ শাহাব উদ্দিন

মানিক সরকার মানিক, রংপুর : রংপুরে ভাষা আন্দোলনের মূল বিরোধিতাকারী ছিলেন কারমাইকেল কলেজের তৎকালীণ অধ্যক্ষ শাহাব উদ্দিন। তিনি ছিলেন উর্দুভাষি এবং মাথায় ফেল্ট ক্যাপ পড়তেন। সার্বক্ষণিক মুখে টানতেন পাইপ। ভাল ইংরেজি বলতেন। তিনিই ছিলেন রংপুরে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম বিরোধিতাকারী। ছাত্রদের মিছিল সভা সমাবেশ করতে দিতেন না। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কীত কোথাও কোন পোষ্টার কিংবা দেয়াল লিখন দেখলেই পিয়নদের হুকুম দিয়ে ছিঁড়ে-মুছে ফেলাতেন। এমনকি ভাষা আন্দোলন করার অভিযোগে কলেজের দু’জন অধ্যাপককে গ্রেফতার করান তিনি এবং একজনের নামে জারি করান গ্রেফতারী পরোয়ানা। এ ছাড়াও তিনি কলেজের ক’জন ছাত্রকে কলেজ থেকে বহিস্কারের আদেশ দিয়ে নোটিশ দেন এবং কারও কারও জরিমানাও করেন। এ বিষয়টি তিনি পত্র দিয়ে জানিয়েও দিতেন ছাত্রদের অভিভাবকদের। রংপুরে মহান ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতাকারীর এসব তথ্য পাওয়া যায় বিশিষ্ট ভাষা সৈনিক, শিক্ষাবীদ ও আইনজীবী মরহুম অধ্যাপক নুরুল ইসলামের লেখা একটি নিবন্ধ থেকে।

জানা যায়, ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ছাত্র মিছিলের উপর গুলি বর্ষণের খবর রংপুরে সন্ধ্যার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাতেই এক মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। পুলিশের অবিরাম লাঠিচার্জে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। রংপুরের অনেক তরুণ ছাত্রই সেদিন মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি কারমাইকেল কলেজে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং পুনরায় এক বিরাট মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেছিল পুলিশ। কিন্তু শত বাঁধা উপেক্ষা করে মিছিলটি সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। তারপরে প্রতিদিনই কারমাইকেল কলেজে প্রতিবাদ সভা হতো, বেরুতো মিছিলও।

অপর ভাষা সৈনিক মরহুম শাহ তবিবর রহমান প্রধানের এক নিবন্ধ থেকে জানা যায় ভাষা আন্দোলনের আরও অজানা কাহিনী। শাহ তোফাজ্জল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলন কমিটির সদস্য। ’৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ‘কমিটি অব এ্যাকশন’ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকেসহ অনেককেই পাঠিয়ে দেয়া হয় রংপুর।

তিনিসহ সাবেক মন্ত্রী রংপুরের মরহুম মতিউর রহমান, অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান, ইয়াকুব আলী, মাহফুজ আলী, কাজী মুহাম্মদ এহিয়া, মণি কৃষ্ণ সেন, শংকর বসু, শাহ আব্দুল বারী, ধীরেন ভট্টাচার্য, জীতেন্দ্রনাথ দত্ত, ইদ্রিস লোহানী, অধ্যাপক মোতাহার হোসেন সুফী, শাহ আব্দুর রাজ্জাক, মীর আনিছুল হক পেয়ারা, কছিম উদ্দিন. আমজাদ হোসেন, আজমল হোসেন, আবুল হোসেন, ডাঃ মোজাহার উদ্দিন, ডাঃ আবতাব উদ্দীন তালুকদার, ভিখু চৌধুরী, শাহ আব্দুল বারী, এডভোকেট নুরুল হক, দবির উদ্দিন আহম্মদ, খয়রাত হোসেন, মোঃ নাজিম খন্দকার, মোহাম্মদ আফজাল, আজিজার রহমান, নাজমুল আলম চৌধুরী হেবিন, মতিয়ার রহমান, আজিজুল হক সেলিম, আব্দুস সোবহান, কৃষক নেতা দরাজ আলী মন্ডল, শাহ তবিবর রহমান প্রধান তখন রংপুরের আন্দোলন পুরোধা হিসাবে কাজ করতেন।

মরহুম শাহ তবিবর রহমানের এক নিবন্ধ থেকে জানা যায়, রংপুরে তখন মাইক পাওয়া যেত না। দোকান ছিল মাত্র দুটো। যে কারণে চোঙ্গা ফুকতেন তিনি। এজন্য সবাই তাকে ‘চোঙ্গা ম্যান’ কিংবা ‘চোঙ্গা তবি’ বলেই ডাকতেন। হাতের লেখা ভাল থাকার কারণে পোষ্টারও লিখতেন তিনি। তখন দলবদ্ধ হয়ে আড্ডা এবং পোষ্টার লিখতেন বর্তমান জি.এল.রায় রোডস্থ খ্রীষ্টানদের কবরস্থানে। এ তথ্যও জেনে যায় তৎকালীণ পুলিশ এবং এজন্য প্রায়ই সেখানে হানা দিত তারা। এছাড়া রংপুরের ভাষা সৈনিকরা নিয়মিত উঠা বসা করতেন নগরীর বর্তমান পায়রা চত্বরের পাশে বর্তমান লুক টেইলার্স ও সাবেক পাকিস্তান বুক হাউসে। সেটি ছিল আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হোসেনের অফিস। তৎকালীণ আওয়ামী লীগ সভাপতি ভাষা সৈনিক ডা. মোজাহার উদ্দিনের সিটি ফার্মেসীতে। পরবর্তীতে যেটি নুশিন লাইব্রেরী বলে পরিচিতি পায়। বর্তমানে সেটিও এখন নেই।

ভাষা সংগঠক জননেতা মোহাম্মদ আফজাল জানান, সে সময় তারা মিছিল সভা সমাবেশ করেই ক্লান্ত দেহে ফিরে যেতেন নুরপুরে হেবিন চৌধুরীর বাসায়। সেখানে হেবিন চৌধুরীর মাকে তারা মা বলে ডাকতেন। তিনি ভাষা সৈনিকদের নিজ হাতে চা বানিয়ে খাওয়াতেন। হেবিন চৌধুরীর দু’বোন ডলি এবং ডজি তারাও নিয়মিত মিছিলে যেতেন এবং ডজি নিয়মিত স্লোগান দিতেন।

রংপুরে ভাষা আন্দোলনে আরও যারা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তারা হলেন, লে. কর্ণেল জাহিদুল হক চৌধুরী, শামসুল হুদা (আবু), নজরুল ইসলাম এ্যাডভোকেট, সিদ্দিক হোসেন, ডা. রোকেয়া আলমগীর রুবি, কমরেড বিণয় সেন, মজিবর রহমান মতি মিয়া, ডা, শোভান খান, ডা. দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক (মন্টু ডাক্তার), মকবুল হোসেন, কানু ঘোষ, আফান উল্লাহ, মোসলেম আলী খান, ইব্রাহিম খান সুরুজ, ডা. কবির খান বখতিয়ারি, এ্যাডভোকেট গাজী রহমান, কামরান শাহ আব্দুল আউয়াল, অধ্যাপক রেজা শাহ তৌফিকুর রহমান, এ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম, তোজাম্মেল আলী, এ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী আশরাফ হোসেন বড়দা, তনসিম উদ্দিন আহমেদ মনু পানার উদ্দিনসহ নাম না জানা আরও অনেকেই। তবে তাঁদের অনেকেই আজ প্রয়াত ।

(এম/এসপি/ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৮ নভেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test