আঞ্চলিক প্রতিনিধি(বরিশাল):মধ্যযুগের অমর কাব্যগ্রন্থ “মনসা মঙ্গঁল” কাব্যর রচয়িতা ও বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি বিজয় গুপ্ত’র প্রতিষ্ঠিত “মনসাকুণ্ড” নামে খ্যাত বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ৫’শ ২২বছর বছরের প্রতিষ্ঠিত মনসা মন্দিরে দেবী মনসার বাৎসরিক পূঁজা মহাআড়ম্বড়ের মধ্য দিয়ে বুধবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবছর বাংলা শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে বিষ হরি বা মনসা দেবীর পূঁজা ভারতীয় উপমহাদেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

“ধর্ম যার যার উৎসব সবার”-এ বাক্যকে ধারণ করে বিজয় গুপ্ত’র প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাৎসরিক পূজায় দেশ-বিদেশের হাজার হাজার ভক্ত ও পূন্যার্থীর পূষ্পার্ঘ্য নিয়ে মন্দিরে সমবেত হয়েছিলেন।

মনসা মঙ্গল কাব্য ও জনশ্রুতি মতে, ৫শ ২২বছর আগে মধ্য যুগে সুলতান হোসেন শাহ'র রাজত্বকালে ইংরেজী ১৪৯৪ সনে কবি বিজয় গুপ্ত দেবী মনসা বা বিষ হরি (বিষ হরণকারী) দেবী কর্র্তৃক স্বপ্নে) দেখে নিজ বাড়ির সু-বিশাল দীঘি থেকে পূঁজার একটি ঘট পেয়ে গৈলা গ্রামের নিজ বাড়িতে দেবী মনসার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে দেবী মনসার আদেশে দিঘীর ঘাটের পাশ্ববর্তি একটি বকুল গাছের নীচে বসে স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েই “মনসা মঙ্গল” কাব্য রচনা করেন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক সুলতান হোসেন শাহ্র রাজত্বকালে ওই বছর বিজয় গুপ্ত মনসা মঙ্গঁল রচনা করে রাজ দরবারে “মহা কবি”র খেতাবে অধিষ্টিত হন।

জনশ্রুতি রয়েছে, দেবী পদ্মা বা মনসা বিজয় গুপ্তের কাব্য রচনায় সন্তুস্ট হয়ে আশির্বাদ হিসেবে বিজয় গুপ্তকে স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে বলেছিলেন “তুই নাম চাস, না কাজ চাস?” উত্তরে বিজয় গুপ্ত বলেছিলেন “আমি নাম চাই”। যে কারনে তার নাম বিশ্বেব্যাপি ছড়িয়ে পড়লেও তিনি দেহত্যাগ করেছেন উত্তরাধিকার বিহীন। বিজয় গুপ্তর জন্ম তারিখ গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে নির্ণয় করা হলেও মৃত্যু কাল সম্পর্কে সঠিক কোন দিন তারিখ গবেষকরা বলতে পারেন নি। তবে গবেষকদের ধারণা মতে, সম্ভবত ৭০ বছর বয়সে ১৫২০ খ্রিষ্টাব্দে কাশীধামে বিজয় গুপ্ত দেহত্যাগ করেন।

বিজয় গুপ্তই সর্বপ্রথম তার রচিত মনসা মঙ্গল কাব্যে ইংরেজী দিন, তারিখ ও সনের লিপিবদ্ধ করেন। এর আগেও একাধিক পন্ডিত ও কবিরা মনসা মঙ্গল রচনা করেছিলেন। যার অন্যতম ছিলেন ময়মনসিংহ’র কানা হরি দত্ত। কিন্তু তাদের তুলনায় বিজয়গুপ্তর কাব্য নিরস হলেও নৃপতি তিলক’র (সুলতান হোসেন শাহ) গুন কীর্তন ও ইংরেজী দিন, তারিখ ও সনের লিপিবদ্ধ করার কারণে তিনিই হয়ে ওঠেন মনসা মঙ্গল কাব্য রচয়িতাদের অন্যতম। “মহা কবি” খেতাব পাওয়ার পর সমগ্র ভারতবর্ষে মহা ধুমধামে মনসা দেবীর পূঁজার প্রচলন ঘটে। মহাকবি বিজয় গুপ্তের পিতার নাম সনাতন গুপ্ত ও মাতার নাম রুক্সিনী দেবী।

গৈলা কবি বিজয় গুপ্তের স্মৃতি রক্ষা মনসা মন্দির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কমিটির সদস্যরা জানান, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনারা বিজয় গুপ্তের মন্দির থেকে মনসা দেবীর বিগ্রহ চুরি করে নেয়ার পর ২০০৮ সালে সনাতন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দেশ বিদেশের ভক্তবৃন্দদের আর্থিক অনুদানে প্রায় ১টন ওজনের পিতলের তৈরি মনসা দেবীর প্রতিমা পূণ স্থাপন করা হয়।
নিরাপত্তা ও শৃংখলার জন্য মন্দির ও পূঁজা কমিটির নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি থানা পুলিশও ব্যাপক ভুমিকা পালন করেছে।

বর্তমানে মনসা মন্দিরটি ধর্মীয় উপাসনালয়ের পাশাপাশি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও ব্যপক পরিচিতি লাভ করেছে। বরিশাল জেলা প্রশাসন জেলার দর্শনীয় স্থানের তালিকার শীর্ষে রেখেছে ঐতিহাসিক বিজয় গুপ্তের মনসা মন্দিরের নাম। দেশ-বিদেশের পুণ্যার্থী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের পর্যটনের উল্লে¬খযোগ্য স্থান হিসেবে রয়েছে এ মন্দিরের স্বীকৃতি।



(টিবি/এস/আগস্ট১৭,২০১৬)