আবীর আহাদ


কালসাপকে হাজারো দুধ-কলা খাওয়ালেও সে পোষ মানে না। সুযোগ পেলে সে ছোবল মারবেই। এটা তার স্বভাব। তার ছোবল মানে নির্ঘাত মৃত্যু। তাই কালসাপকে মেরে ফলতে হয়, এমনকি তার বালবাচ্চা থাকলে, তাদেরকেও। কারণ তারাও বড়ো হয়ে ঐ কালসাপই হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের কালসাপ ছিলো রাজাকার আলবদর আলশামস ও তথাকথিত শান্তি কমিটি,যারা ছিলো পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এদেশীয় সহযোগী- বাংলাদেশের কালসাপ, যারা হানাদার বাহিনীর সহযোগী হয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলো, যারা ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা ও তিন লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানি করেছিলো, কোটি কোটি ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের হোলি খেলেছিলো। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে তারাও আত্মসমর্পণ করে। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তাদের সবাইকে যুদ্ধবন্দির মর্যাদা দেয়া। পরবর্তীতে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার চুক্তির ফলশ্রুতিতে বন্দি হানাদারদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বিশেষ করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এদেশীয় রাজাকার-দালালদের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বঙ্গবন্ধু সরকার তাদের বিচার অব্যাহত রাখেন। ফলে সুযোগ পেয়েও বহির্বিশ্ব ও দেশীয় রাজনৈতিক চাপসহ নানাবিধ কারণে সেসব কাল সাপদের আমরা উৎপাটিত করতে পারিনি। উপরন্তু বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক তিরোধানের পর জেনারেল জিয়া দালাল আইন ও বিচার ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দিয়ে রাজাকার-দালালদের ছেড়ে দেন।

সেই রাজাকার আলবদর আলশামস ও তথাকথিত শান্তি কমিটির সদস্য ও তাদের উত্তরাধিকাররাই পরবর্তীকালে জিয়া এরশাদ খালেদা হয়ে হাসিনা সরকারের কাঁধে সওয়ার হয়েছে। তারাই ঐসব সুবিধাবাদী ও অর্থলিপ্সু সরকারের লোকদের যোগসাজশে রাষ্ট্রের ভেতর দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি হিশেবে সরবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আর এসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও আর্থিক লাভালাভের স্বার্থে সেসব সরকারগুলো প্রচ্ছন্নভাবে তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতাসহ আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, অতীতের অন্যান্য সরকারের চেয়ে সদ্য ক্ষমতাচ্যুৎ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অভয়ারণ্য চরম দৃশ্যমান।

আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া সংগঠন। এ সংগঠনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়ছে। এ সংগঠনের চলার পাথেয় হিশেবে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কিন্তু তারা সেই আদর্শ ও চেতনাকে পদদলিত করে ক্ষমতা ও আর্থিক লাভালাভের স্বার্থে আদর্শবাদী আওয়ামী লীগার ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিয়ে অর্থশালী রাজাকার তো বটেই- মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াত বিএনপি ফ্রিডমপার্টি হেফাজতসহ সমাজের অপরাধীচক্রকে জামাই আদরে দলে ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দেশটাকে লুটেপুটে চেটেচুটে খাওয়ার অভয়িত সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিলো।

সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সমাজের কীট বলে বহুল সমালোচিত, মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত পবিত্র দেশের মাটিতে কোথাকার কোন দরবেশ এসালম লোটাস নজরুল সম্রাট খান কাজী বদি মামুন ফালু বাচ্চু মিঠু ভূঁইয়া শামিম, পাপিয়া, পাপলু, শাহেদ, আরিফ, সাবরিনাসহ যে মাফিয়াডনরা অবাধে লুটপাটযজ্ঞ চালিয়ে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে- কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, দেশে-বিদেশে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বিনাশ করছে- মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের রক্তের সাথে, চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, তাদের মূলত: এই দেশে থাকারই অধিকার নেই ; অথচ বিভিন্ন সময় দুর্নীতি ও লুটপাটের সমর্থক সরকার তাদের জাতিদ্রোহ অনৈতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তেমন কোনোই ব্যবস্থা নেয়নি। করোনা সনদ কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা আরিফ-সাবরিনাকে গ্রেফতার করা হলেও মূলহোতা ও বহু লোমহর্ষক অপরাধের সাথে জড়িত রাঘবরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে অবস্থান করেছে। পুলিশ, র্যাব ও সবকটি গোয়েন্দা বাহিনী নাকি ক্রিমিনালদের খুঁজে পায়নি! এ অবস্থায় জনমনে নানান গুজব ও গুঞ্জন উঠেছে, নিশ্চয়ই তারা পাওয়ারফুল কারো সেল্টারে রয়েছে যেখানে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দারা পর্যন্ত যেতে পারেনি।

অতীতে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, কেনাকাটা, ব্যাঙ্ক ও শেয়ারবাজারসহ নানান সাগরসম চুরি-ডাকাতি সংঘটিত হলেও সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনোই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। যদিও বা কোনো সময় কোনো কেলেঙ্কারির হোতা পাকড়াও হলেই একটা কথা তারস্বরে চিৎকার করে বলা হয় যে, ও বেটা বিএনপি করতো! সত্য বটে বিএনপি করতো, তবে জেনেশুনে তাকে আওয়ামী লীগে ঠাঁই দেয়া হয়েছিলো কেনো- এ প্রশ্নের জবাব নেই! মূলত: আওয়ামী লীগের উর্দ্ধমহলের ক্লিয়ারেন্স ও বিপুল অর্থ নিয়েই অন্য দলের ক্রিমিনালদের আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জায়গায় পদপদবী দেয়া হয়েছে।

করোনা সনদ কেলেঙ্কারির হোতা জাত ক্রিমিনাল শাহেদ কী করে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সাথে ছবি তুলেছে, গণভবনে যেয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে তুলে তুলেছে? কী করে, কোন যাদুমন্ত্রের গুণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতা, মিডিয়া জগতের স্বনামধন্য সম্পাদক-সাংবাদিকসহ রাষ্ট্রের হাইপ্রোফাইল আমলাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে বিশাল বিশাল প্রতারণা করে এলো- পুলিশের খাতায় ঘৃণ্য প্রতারক ও অপরাধী বলে চিহ্নিত এমন একজন ক্রিমিনাল সবার নাকের ডগার ওপর দিয়ে সগর্বে বিচরণ কী করে এলো, তা হিসেবে মেলেনি। তবে কি সবাইকে সে পয়সা বিলিয়ে বশ করে রেখেছিলো, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।

আওয়ামী সরকারের আরেকটা সেক্টর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। জামুকা নামক জাদুকাঠি অতীতে বিএনপি-জামায়াতের তৈরিকৃত হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষার পাশাপাশি বহুকাল ধরে অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে যাকে তাকে বীর মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে একদিকে রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাট করিয়েছে , অপরদিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অপবাদ দিয়ে স্বাধীনতার সূর্য সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক মর্যাদা ভুলুন্ঠিতসহ মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনাকে বিনষ্ট করেছে!

ওপরে যাদের কথা বলা হলো, এর বাইরেও শত শত ক্রিমিনালের যোগসাজশে সরকারের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরাও দুর্নীতি ও লুটপাটের সঙ্গী হয়েছে। দিনে দিনে সে-দুর্নীতি ও লুটপাট সাগরচুরি রূপ ধারণ করেছে। এসব ক্রিমিনালরা প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে বিদেশ সফরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, অবাধে বঙ্গভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গণভবন, মন্ত্রী-এমপি-সচিব-জেনারেলদের কার্যালয় ও বাসভবনে যাওয়া সুযোগ পেয়েছে,, বিভিন্ন পোজের ছবি তুলে যা পরবর্তীতে তারা এসব যোগাযোগ ও ছবি হরেক রকম প্রতারণার কাজে লাগায়। অথচ দু:খজনক সত্য এই যে, যাদের বদৌলতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, সচিব, জেনারেলসহ আরো আরো অনেককিছু- সেই মুক্তিযোদ্ধারা এসব জায়গায় যেতে পারেনি, যাওয়ার অনুমতি মেলনি, তাদের কোনো কথা শোনা হয়নি বা আমলে নেয়া হয়নি।! ঐসব ক্রিমিনালরা সরকারি ব্যাঙ্ক শেয়ারবাজার প্রকল্প ও কেনাকাটায় সাগরচুরির মাধ্যমে শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করলেও রাষ্ট্রের তহবিলে টান পড়েনি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি! কারণ সেখানে ভাগাভাগির ব্যাপার ছিলো। অথচ যাদের বদৌলতে রাষ্ট্র, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধার কথা উঠলে রাষ্ট্রীয় তহবিলে টান পড়েছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবস বা অন্য কোনো অকেশনে বঙ্গভবন ও গণভবনে অন্যান্যের সাথে শত শত ক্রিমিনালরা আমন্ত্রিত হয়ে আড্ডা জমালেও, মুক্তিযোদ্ধারা আমন্ত্রণ পায়নি। তবে গণভবনের পাশে অবস্থানরত ২/৪ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে হুইলচেয়ারি আমন্ত্রিত হতে দেখা যায়। সরকারের নাকের ডগার কাছ দিয়ে কিছু কিছু ক্রিমিনাল আস্ত বিমান উড়িয়ে বিদেশে পালিয়ে গেলেও সরকার নাকি কিছুই জানে না। কোন কোন লুটেরা- মাফিয়া দেশের অর্থ লুটপাট করে বিদেশী ব্যাঙ্কে পাচার করে, কারা আমেরিকা কানাডা লণ্ডন দুবাই সিঙ্গাপুর মালায়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিশাল বিশাল বিনিয়োগসহ সেসব দেশে প্রাসাদোপম সেকেণ্ড হোম বানিয়ে রাজার হালে জীবন যাপন করছে, তা প্রকাশ পেলেও সরকার ও দুদক কিছুই জানে না! সবকিছু দেখেশুনেবুঝে মনে হয় যেনো রাষ্ট্রটিই দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা, সুযোগ ও নিরাপত্তা দিয়ে আসছে!

বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- ফেসবুক বর্তমানে বিশাল সংবাদ মাধ্যম হিশেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের চাইতে ফেসবুক অনেক জনপ্রিয়। পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের খবর সংক্রান্ত পাঠক-শ্রোতার সংখ্যার চেয়ে ফেসবুকের পাঠকসংখ্যা অনেক বেশি। প্রতিদিন ফেসবুকে বিভিন্ন দুর্নীতি অনিয়ম ও লুটপাটের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথাও প্রধানমন্ত্রী জানতেন কিনা সন্দেহ। কারণ তাঁর গণমাধ্যম সংক্রান্ত পিএস, ডিপিএসসহ আর যারা যারা ছিলেন, তারা এসব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর করাতে কোনোই যোগ্যতা রাখেন বলে মনে হয়নি। কারণ তাদের অনেকেই দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের কাছ থেকে নিয়মিত কমিশন পেয়ে থাকতো বলে অভিযোগ ছিলো।

আবারো বলি, সবকিছু দেখেশুনেবুঝে মনে হয় যেনো রাষ্ট্রটি দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা, সুযোগ ও নিরাপত্তা দিয়ে এসেছে! আওয়ামী সরকারের মন্ত্রিসভা, সংসদ সদস্য, আমলাতন্ত্র ও অন্যান্য স্তরের কর্মকর্তাদের চরম ব্যর্থতাসহ দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়া নামক কাল সাপদের দেশবিনাশী কার্যকলাপ দেখেও শেখ হাসিনার ছিলেন একেবারেই নিশ্চুপ। এসব কাল সাপ ইতোমধ্যে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাদের কার্যকলাপে বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটি ধ্বংসের শেষ সীমানায় অবস্থান করছে। সুতরাং জাতীয় স্বার্থে সমাজদেহ থেকে এসব কালসাপধের উৎপাটিত করতেই হবে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।