আবীর আহাদ


দেশে দেশে ক্ষমতাভোগী শাসকরা দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। চলতে থাকে একেঅপরের স্বার্থোদ্ধারের যোগসাজস। আমলারা শাসনযন্ত্রের চারদিকে বাঁধার শক্ত দেয়াল দাঁড় করিয়ে দেয়। ফলে আমলাতন্ত্রের শক্ত দেয়াল পেরিয়ে শাসকদের কাছে দেশ ও জনগণের চাহিদা, অভাব ও অভিযোগের খবরাখবর সঠিকভাবে পৌঁছে না। এখানেই শাসকদের চরম ব্যর্থতা যে, তাঁরা  আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না; উপরন্তু প্রকৃতিগত তাদের কাছেই শাসকরা বন্দী হয়ে পড়ে। এর মূলে রয়েছে শাসকদের প্রধানত: দু'টি দুর্বলতা। এক. শাসকরা নিজেরাই দুর্নীতিবাজ, দুই. রাষ্ট্র পরিচালনায় তারা অদক্ষ। ফলশ্রুতিতে প্রকৃতিগত কারণেই তাঁরা আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আমলারাও এ-সুযোগটাই ষোলো আনা লুফে নেয়। ফলে দেশের আর্থসামাজিক তথা তথাকথিত উন্নয়নের নামে শুরু হয় শাসকশ্রেণী ও আমলাতন্ত্রসহ দেশের বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর ফ্রিস্টাইল লুণ্ঠনযজ্ঞ।

দেশে দেশে রাজনীতিনির্ভর শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি অযোগ্যতা ও অদক্ষতার কারণে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাই যথোপযুক্ত ব্যক্তি যথাযথ স্থানে ঠাঁই পায় না। অর্থাত্ শাসকগোষ্ঠী তাদের লুণ্ঠনমিশ্রিত শাসন প্রবহমান রাখার লক্ষ্যে তাদেরই সমর্থিত ও মনঃপূত ব্যক্তিদের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসায়। তাইতো দেখা যায়, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে অবস্থান করছে শাসকগোষ্ঠীর আস্থাভাজন এমনসব ব্যক্তি যারা হয় চরম দুর্নীতিবাজ অথবা অপদার্থ, যাদের মধ্যে মেধা সততা কর্মনিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের লেশমাত্র নেই! অপরদিকে অতি যত্নের সাথে প্রশাসনের সৎ মেধাবী, ত্যাগী, অভিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক মানুষদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়! কারণ এদের দিয়ে দুর্নীতিবাজ লুটেরা শাসকদের অসৎকর্ম সম্পাদন করা সম্ভব নয়। ফলে সমাজের এসব মানুষগুলো মনের দুঃখে নীরবে জীবনযাপন করেন, কেউ কেউ সুযোগ পেলে বিদেশে পাড়ি জমান।

দেশে দেশে এভাবেই শাসকগোষ্ঠী তাদের লুণ্ঠনকর্ম চালিয়ে দেশের মানুষকে শোষণ করে আসছে। সমাজের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনের সাধ-আহ্লাদ, আশা-স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যয়। সাধারণ মানুষ চরম হতাশা ও নৈরাশ্যের মধ্যে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হয়। সমাজে নৈমিত্তিকতার অধ:পতন ঘটে। আত্মিক পারিবারিক সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক তথা সব সম্পর্ক নির্ধারণ হয় আর্থিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে। ত্যাগ সততা ও মেধার মূল্য থাকে না। শাসক ও দলীয় আনুগত্য, স্তাবকতা ও লুণ্ঠনের ভাগাভাগির ওপর নির্ভর করে ব্যক্তির দলীয় ও প্রশাসনিক অবস্থান। ফলে নিরীহ মানুষের অধিকার এখনে স্থান পায় না। যদিও দেশ ও সাধারণ মানুষের কল্যাণের নামে চোখ ধাঁধানো বিশাল বিশাল পুল-ব্রিজ, রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, রিভার টানেল, সুউচ্চ ইমারত, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র আমদানি প্রভৃতি দিয়ে দেখানো হয় যে, এর মধ্য দিয়ে অনেক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে, তার মধ্যে যতোটা না দেশের উন্নয়ন ঘটছে, তারচে' হাজার গুণ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ঘটছে দুর্নীতিবাজ শাসক, আমলাতন্ত্র ও বণিকগোষ্ঠীর। তারা নানান উন্নয়ন প্রকল্প ও কেনাকাটার মধ্য দিয়ে সাগরচুরি ঘটিয়ে থাকে। যেমন ১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ও কেনাকাটার ব্যয়মূল্য দেখানো হয় ১০/২০ হাজার কোটি টাকা! এভাবে বাড়তি মূল্য শাসকগোষ্ঠী তাদের বশংবদদের নিয়ে আত্মসাত করে থাকে। অপরদিকে সাধারণ মানুষ নানান চোখ ধাঁধানো দৃশ্য দেখে আর আঙুল চুষে !

দেশে দেশে এটাই শেষ কথা নয়। অতীতে বহুদেশের শোষিত ও প্রতারিত জনগণ তিলে তিলে পলে পলে একদিন ঠিকই জেগে ওঠে। অবশেষে সেসব দেশের জনগণের জাগরণের সুযোগ নিয়ে দেশী-বিদেশি শক্তির চরম কোনো হস্তক্ষেপে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক শক্তি বা সামরিক বাহিনীর দ্বারা তছনছ হয়ে যায় শাসক-শাসকগোষ্ঠীর পেয়ারে সিংহাসন! অনেক ক্ষেত্রে প্রচুর রক্তপাত ও জীবননাশের ঘটনাও ঘটে। এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বহু দেশে এসবের জ্বলন্ত উদাহরণ রয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রক্তাক্ত জুলাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এক জ্রলন্ত উদাহরণ হিশেবে আমাদের চোখের সামনে এখোনো জ্বলজ্বল করছে।

দেশে দেশে যে সমাজে ব্যাপক মানুষের নিরাপত্তা থাকে না, সে-সমাজের ক্ষুদ্র শোষকগোষ্ঠীও নিরাপদ নয়।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।