ডা. মুহাম্মদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস ২৪। শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর)। ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশসহ এশিয়ার ১২টি দেশে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস পালন করা হয়। জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধ ও নির্মূলের লক্ষ্যে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

জলাতঙ্ক রোগের কারণে পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ৬০ হাজার লোকের মৃত্যু হয়। এর প্রায় দুই হাজার জনেরই মৃত্যু ঘটে বাংলাদেশে। প্রতিবছর কুকুর-বিড়ালের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে জলাতঙ্কের ঝুঁকিতে পড়ে প্রায় তিন লাখ মানুষ। আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন, ভারতের পর বাংলাদেশে জলাতঙ্কজনিত রোগীর মৃত্যুসংখ্যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। কারণ বাংলাদেশে জলাতঙ্ক রোগের তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের কোনো সামগ্রিক ব্যবস্থা আজও গড়ে ওঠেনিজলাতঙ্কের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার প্রায় শতভাগ। অর্থাৎ রোগলক্ষণ একবার প্রকাশ পেলে রোগীকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব। জলাতঙ্ক সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাই জেনে রাখা জরুরি।

জলাতঙ্ক কি?

জলাতঙ্ক, যা হাইড্রোফোবিয়া নামেও পরিচিত, একটি তীব্র ভাইরাল সংক্রমণ যা প্রায় সবসময়ই মারাত্মক। এটি সংক্রামক রোগের বিভাগের অধীনে আসে এবং খামার বা বন্য প্রাণীদের দ্বারা সংক্রামিত হয়; সাধারণত মাংসাশী যেমন কুকুর, বিড়াল, শেয়াল, রেকুন। এটি বেশিরভাগ আফ্রিকা এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আইসল্যান্ড, তাইওয়ান, জাপান এবং সাইপ্রাসের মতো দ্বীপগুলিতে জলাতঙ্ক নেই। এটি জুনোটিক রোগের অধীনে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে (জুনোটিক মানে প্রাণীদের সাথে সম্পর্কিত)।

জলাতঙ্ক রোগের কারণ

মানুষের মধ্যে জলাতঙ্ক একটি উন্মত্ত প্রাণীর কামড়ের কারণে হয়। প্রাণীর লালার মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়ায়। খামারের প্রাণী যেমন কুকুর, গরু, ঘোড়া, ছাগল, খরগোশ এবং বন্য প্রাণী যেমন কাঁঠাল, বাদুড়, কোয়োটস, শিয়াল এবং হায়েনারা আক্রান্ত হলে জলাতঙ্ক ছড়াতে পারে।

ল্যাবরেটরিতে জলাতঙ্ক ভাইরাস পরিচালনা করা, বাদুড় থাকতে পারে এমন গুহা অন্বেষণ করা বা বন্য প্রাণীর উপস্থিতি যেখানে বন্য প্রাণী রয়েছে সেখানে শিবির স্থাপন করা সাধারণ পরিস্থিতিতে যেখানে একটি উন্মত্ত প্রাণীর কামড় হয়।

মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ নথিভুক্ত করা হয়নি। যদি একটি উন্মত্ত প্রাণী একজন ব্যক্তির উপর একটি খোলা ক্ষত চাটতে পারে, তাহলে ভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে। মাথা এবং ঘাড়ের ক্ষতগুলি আরও বিপজ্জনক কারণ সংক্রমণ দ্রুত মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারে।

জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ

জলাতঙ্কের উপসর্গ এবং লক্ষণগুলি রোগের শেষ পর্যায়ে দেখা যায় না, এই সময়ের মধ্যে ভাইরাসটি মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে এনসেফালাইটিস সৃষ্টি করে এবং এর পরেই মৃত্যু ঘটে।জলাতঙ্কের একটি ইনকিউবেশন পিরিয়ড থাকে, যার অর্থ হল উপসর্গ এবং লক্ষণগুলি প্রকাশের আগে কিছু দিন এটি ব্যক্তির শরীরে সুপ্ত থাকে। প্রাথমিক উপসর্গগুলি:-

১। কর্কশ কণ্ঠস্বর

২। খিটখিটে মেজাজ

৩। অন্যকে অকারণে কামড় বা আক্রমণের প্রবণতা

৪। খাবারে অরুচি

৫। অস্বাভাবিক কথাবার্তা

৬। উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো

৭। পানি পিপাসা পেলেও পানি দেখে আতঙ্কিত হওয়া

৮। আলো বাতাসের সংস্পর্শে এলে ভয় বেড়ে যাওয়া

৯। মানুষের চোখের আড়ালে, অন্ধকারে, একা থাকতে পছন্দ করেন।

১০। খিঁচুনি ও মুখে লালা বের হওয়া ইত্যাদি।

জলাতঙ্ক রোগ নির্ণয়

যদি আপনি একটি বিপথগামী কুকুর বা বন্য প্রাণী দ্বারা কামড়ায়, এটা বুদ্ধিমানের কাজ যে প্রাণীর জলাতঙ্ক আছে এবং ব্যক্তি তার জীবন বাঁচাতে অবিলম্বে টিকা দেওয়া উচিত. যদি প্রাণীটি একটি পোষা প্রাণী হয় এবং এটি মালিক বা পশু চিকিৎসকের কাছ থেকে যাচাই করা যেতে পারে যে প্রাণীটি র‍্যাবিড নয়, শুধুমাত্র এই ক্ষেত্রে ব্যক্তিটিকে টিকা দেওয়া হয়নি৷

একজন ব্যক্তিকে কামড়ানোর পরে প্রাণীটিকে সুরক্ষিত করা বা ক্যাপচার করা অত্যন্ত সহায়ক কারণ প্রাণীটির জলাতঙ্ক আছে কিনা তা নির্ধারণ করতে স্থানীয় সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা যেতে পারে।

আপনার ডাক্তার আপনাকে পশুর আচরণ বর্ণনা করতে বলবেন (এটি বন্ধুত্বপূর্ণ বা রাগান্বিত ছিল) কারণ বন্য প্রাণী মানুষের পক্ষে বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা কম। তিনি বা তিনি এটিও নিশ্চিত করবেন যে আপনি কীভাবে কামড় পেয়েছেন এবং প্রাণীটির কী হয়েছিল – এটি কি পালিয়ে গেছে বা এটি ধরা পড়েছে? যদি প্রাণীটিকে ধরা হয় তবে এটি জলাতঙ্কের লক্ষণগুলির জন্য পরীক্ষা করা যেতে পারে এবং যদি এটি সুস্থ পাওয়া যায় তবে শিকারটিকে টিকা দেওয়ার শটগুলি থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।

পরিবারের কারও জলাতংক হলে

তার চিকিৎসার সময় সেবাযত্নকারীকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে আক্রান্ত রোগীর প্লেটের অবশিষ্ট খাবার খাওয়া যাবে না। রোগীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র সাবধানতার সঙ্গে ধুতে হবে। তবে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখা দরকার, হাতে কাটাছেঁড়া থাকলে রোগীর চিকিৎসায় সেবাদানকারীকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। কারণ কাটা অংশ দিয়ে শরীরে জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে।

জলাতঙ্কের তদন্ত

ইমিউনোফ্লোরেসেন্স নামক একটি পদ্ধতিতে ত্বকের একটি ছোট টিস্যু ব্যবহার করে রেবিস অ্যান্টিজেন সনাক্ত করা যায়। সংক্রামিত রোগীর লালা থেকে ভাইরাসটি আলাদা করা যেতে পারে।

আক্রান্ত হলে করণীয়

১. কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, বেজি, বানরসহ যেকোনো বন্য প্রাণী কামড়ালে প্রথমেই কাপড় কাচার ক্ষারযুক্ত সাবান (র‌্যাবিস ভাইরাসের সেলকে গলিয়ে ফেলে ক্ষার) দিয়ে প্রবহমান পানিতে কমপক্ষে ১৫/২০ মিনিট ক্ষতস্থান ধুতে হবে। এতে ৭০-৮০ শতাংশ জীবাণু মারা যায়।

২. যেকোনো আয়োডিন/অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে কামড়ানো বা আঁচড় দেওয়ার ‘জিরো আওয়ার’-এর মধ্যে, অর্থাৎ যত দ্রুত সম্ভব টিকা দিয়ে ঝুঁকিমুক্ত থাকতে হবে।

৩. কামড় যদি গভীর হয় বা রক্ত বের হয়, তবে ক্ষতস্থানে র‌্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিনসহ (আরআইজি) অ্যান্টির‌্যাবিস ভ্যাকসিন যত দ্রুত সম্ভব দিতে হবে। বেশি রক্তপাত হলে তা বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে।

৪. আক্রান্ত ব্যক্তির ভীতি দূর করতে হবে। জলাতঙ্কে আক্রান্ত পশুটি মেরে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।

৫. সাধারণত কামড়ানোর ৯ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা দেয়। তাই লক্ষণ প্রকাশের আগেই চিকিৎসা।

যা করা যাবে না

১.ক্ষতস্থানে কোনো সেলাইন, বরফ, চিনি, লবণ ইত্যাদি ক্ষারক পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না।

২. বাটিপড়া, পানপড়া, চিনিপড়া, মিছরিপড়া, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি জলাতঙ্কের হাত থেকে কাউকে বাঁচাতে পারে না।

৩. ক্ষতস্থান কখনোই অন্য কিছু দিয়ে কাটা, চোষন করা বা ব্যান্ডেজ করা যাবে না। এতে বরং ইনফেকশন হতে পারে।

৪. ক্ষতস্থানে বরফ, ইলেকট্রিক শক দেওয়া যাবে না। হাত-পা বাঁধাও যাবে না।

পরিশেষে বলতে চাই, জলাতঙ্ক মস্তিষ্কের এমন একটি গুরুতর অসুখ, যেটা প্রতিরোধের জন্য কোন ধরণের অবহেলা করা যাবে না। গর্ভবতী, স্তন্য দানকারী মা, নবজাতক শিশু, অতিবয়স্ক ব্যক্তিও টিকা নিতে পারবেন। কোন রকম সন্দেহ, প্রশ্ন থাকলেও অসুখের ভয়াবহতা বিবেচনা করে টিকা নিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাই আমাদের একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ক্ষতস্থানটিতে যেন আমরা ব্যান্ডেজ বা সেলাই না করি। যেহেতু এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই, সেহেতু তাবিজ-কবচ, পানি-থালা-কলা পড়া ইত্যাদি করে মূল্যবান সময় কোনোভাবেই নষ্ট করা ঠিক হবে না। জলাতঙ্কের বিরুদ্ধে আধুনিক প্রতিরোধমূলক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করে বিশ্বের অনেক দেশই আজ এ রোগের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে।

লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।