একে আজাদ, রাজবাড়ী : রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায় হঠাৎ করেই বেড়েছে তামাকের আবাদ। বেশি মুনাফা আর কোম্পানির প্রলোভনে তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছে কৃষক। তবে তামাক আবাদের সঙ্গে জড়িত কৃষকরা শ্বাস কষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কৃষি বিভাগ বলছে, যে কৃষক তামাক চাষে জড়িত তাদের অন্য ফসল আবাদের প্রণোদনা বন্ধ করা হয়েছে।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ও দৌলতদিয়া ইউনিয়নের চরাঞ্চল ঘুরে দেখা যায় প্রতিটি বাড়িতেই তামাক পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক। বাড়ির নারী-পুরুষ ও শিশুরাও তামাক পাতা শুকাতে ব্যস্ত। কিছু বাড়িতে তামাক পাতা শুকানোর জন্য আলাদা ঘর তৈরি করা হয়ছে। আবার কিছু বাড়িতে উঠান, ঘরের বারান্দায় শুকানো হচ্ছে তামাক পাতা। এসব এলাকায় গ্রামীণ সড়কের দুই পাশ দিয়েও তামাক পাতা শুকাতে দেয়া হয়েছে। এলাকাজুড়েই তামাক পাতা পরিচর্যায় ব্যস্ত সবাই।

চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই বছর এ এলাকায় তামাকের আবাদ খুব বেশি হচ্ছে। কারণ হিসেবে চাষিরা বলছে, চরাঞ্চলে মুড়ি পেঁয়াজ, রসুন ও সবজির আবাদ বেশি হত। কয়েক বছর ধরে পেঁয়াজ রসুন আবাদে চাষিদের অনেক লোকসান হয়েছে। কিন্তু তামাক আবাদে কোন লোকসান নেই। বিক্রির কোন ঝামেলা নেই। বিভিন্ন টোবাকো কোম্পানি নির্ধারিত দামে কিনে নেয় তামাক পাতা। প্রতিবছর কিছুটা হলেও বৃদ্ধি হয় তামাকের। এছাড়া বীজ ও সার দেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে চাষের জন্য কিছু টাকাও দেয়। এজন্য কৃষক তামাক চাষে এমন আগ্রহী হচ্ছে।

এছাড়া রসুন ও মুড়ি পেঁয়াজের জমিতে সাথী ফসল হিসেবে তামাক আবাদ করা যায়। তামাক উঠায়ে আবার পাট চাষ হয়। এ বছর যারা মিষ্টি কুমড়ার আবাদ করেছিল তারা অনেক লস করেছে। ক্ষেত থেকে শেষের দিকে প্রতিকেজি মিষ্টি কুমড়া পাঁচ থেকে ১০ টাকা দরে বিক্রি করতে হয়েছে। এই চাষিরা আগামীতে আর কুমড়া চাষ করবে না। তারাও তামাক আবাদ শুরু করবে।

চাষিরা আরও জানান, তামাক চাষে কিছু সমস্যা হয়। যখন কাচা পাতা ছিড়তে হয় তখন হাতে গ্লাভস আর মুখে মাস্ক না থাকলে বমি আসে। হাত তিতা হয়ে থাকে সাবানে যায় না। খাবার খেতে কষ্ট হয়। এখানকার মানুষ গ্লাভস ও মাস্ক ব্যবহার করে না। আর তামাক পাতা শুকিয়ে গেলে বাড়িতে তামাকের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। কাঁশি ও শ্বাস কষ্ট হয়। কেউ পাঁচ বছর তামাক আবাদ করলে সে সুস্থ থাকবে না।

গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের নজিউদ্দিন মাতুব্বর পাড়ার তামাক চাষি রাজীব শেখ বলেন, আমি দুই বছর ধরে তামাকের আবাদ করছি। তার আগে এসব জমিতে পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন সবজির চাষ করতাম। তখন আমি কখনো লাভ করতে পারিনি। কারণ পেঁয়াজ যখন বিক্রি করবো তখন দাম নেই। রসুনের দাম থাকে না। একটা চিন্তা থাকতো সব সময়। কিন্তু তামাক পাতা বিক্রি নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই। গত বছর প্রতি কেজির দাম ছিল ১৫০ টাকা। এবার ১৭৫ টাকা। এখানে দাম বৃদ্ধি ছাড়া কমে না। আর একসঙ্গে বিক্রি করায় আমার অনেক টাকা হয়। একটা কাজ করতে পারি। তবে শরীরে অনেক সমস্যা হয়। কাঁশি হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে। আর শুকনা পাতার কাছে বয়স্ক মানুষ যেতেই পারে না। তারপরও লাভের আশায় করতে হয়।

আরেক তামাক চাষি আজগর আলী বলেন, তামাক চাষে শুনি অনেক সমস্যা। নিজেরও কম বেশি সমস্যা হয়। তারপর তামাক চাষ করি একটু লাভের আশায়। একসাথে তামাক বিক্রি করে যে টাকা পায় সেটা দিয়ে সংসারের অনেক কাজ হয়। আমার চার বিঘা জমিতে তামাক আছে। এরপাশাপাশি ২০ শতক জমিতে মিষ্টি কুমড়ার আবাদ করেছিলাম। কিন্তু আমি ব্যবসায়ীর কাছে সব শেষে বিক্রি করছি ৮ টাকা কেজি দরে। অন্য ফসলে আবাদে আমার লাভের কোন নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু তামাক আমি যে দিন বিক্রি করবো সেদিনই ১৭৫ টাকা কেজি দাম দিবে আমাকে।

উজানচর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. রাসেল শেখ বলেন, দুই বছরের মধ্যে আমাদের এই ইউনিয়নে তামাকে ছেঁয়ে গেছে। সবাই কম বেশি তামাক আবাদ করে। তামাক পাতা যখন শুকায় তখন সেখান দিয়ে যাওয়া কষ্ট হয়। আমার ধারণা এই তামাক আবাদের পর থেকে এলাকায় কাঁশি ও শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে।

রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, গোয়ালন্দ উপজেলার চরাঞ্চলে তামাকের আবাদ বেড়েছে সেটা আমরা জানি। এজন্য আমরা এলাকায় কৃষকদের বলেছি, তামাক আবাদ করলে সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা আমরা দেব না। এছাড়া অন্য কোন ফসলের প্রণোদনা দেব না। তামাক শুধু কৃষকের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করে না। তামাক আবাদ করলে জমির উর্বরতা নষ্ট হয়। তামাক চাষে ব্যবহৃত হয় পটাসিয়াম ক্লোরাইড নামের সার। এই সার জমির মাটির ফসল উৎপাদেরর কার্যকারিতা একদম নষ্ট করে দেয়। আমরা সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ীদের বলেছি এই পটাসিয়াম ক্লোরাইড সার বিক্রি করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, তামাক চাষ বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে ট্যোবাকো কোম্পানির বিভিন্ন প্রলোভন। কৃষকদের প্রলোভন দিয়ে তারা তামাকের আবাদ করাচ্ছে। তবে আমরা চাষিদের নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছি তামাকের দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতিকর দিক।

রাজবাড়ী জেলায় এবছর অর্ধশত হেক্টর জমিতে তামাকের আবাদ হয়েছে। যার অধিকাংশই গোয়ালন্দ উপজেলার চরাঞ্চলে হয়েছে।

(একে/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৪)