রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : ফরিদপুর কানাইপুরের করিমপুরে অবস্থিত এ.এইচ জুট এণ্ড গুডস ইন্ডাস্ট্রিস নামের একটি জুট মিল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে সপ্তাহ তিনেক আগে। কিন্তু বকেয়া বেতনের দাবিতে ওই কারখানায় কর্মরত প্রায় সাড়ে তিনশত শ্রমিক ও ত্রিশের অধিক স্টাফ অফিসার তাঁদের পাওনা আদায়ের দাবিতে একত্রিত হয়ে, জুট মিলটির প্রধান ফটকের ভিতরে ঢুকে বিক্ষোভ করে থাকেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বিকাল থেকে শুরু হওয়া ওই বিক্ষোভের ফল নেতিবাচক দিকে যাওয়ার আগ মুহুর্তে প্রায় মধ্যরাতে সমাধান করে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে ফরিদপুর জেলা পুলিশ। পরে সেনা বাহিনীর একটি টহল টিম গিয়ে ওই ফটকে অবস্থান নিলে বিক্ষোভকারীরা আস্তে আস্তে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিক বিক্ষোভের খবর পেয়েই ফরিদপুর কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আাসাদ উজ্জামান এর নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিক্ষোভ থামানোর চেষ্টা করেন। অনেক চেষ্টা করেও যখন শ্রমিকদের বিক্ষোভ থামাতে হিমসিম খাচ্ছিলো পুলিশ, এবং পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছিলো ঠিক তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হোন ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এণ্ড অপস) শৈলেন চাকমা।

এসময় কিছু রিজার্ভ পুলিশ ফরিদপুরের কানাইপুর বাস স্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থান নেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলেন চাকমা ও কোতয়ালি থানার ওসি আসাদ উভয় পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনার বসেন। এসময় সাধারণ শ্রমিকেরা মিলের ভিতরেই অবস্থান করছিলেন। দীর্ঘ আলোচনার পর রাত সাড়ে দশটার দিকে উভয় পক্ষ একমত হোন। ওই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় যারা ওই মিলের প্রান্তিক শ্রমিক বিশেষ করে যারা ডেইলি বেতনে ওই মিলে চাকরি করতেন, তাদের দুই সপ্তাহের বকেয়া বেতনের মধ্যে অন্তত এক সপ্তাহের বেতন পরিশোধ করতে হবে রাতেই, বাকী টাকা আগামী সোমবারে পরিশোধ করতে হবে। উপস্থিত বিক্ষোভরত শ্রমিক ও স্টাফ অফিসারগণ সবাই তা মেনে নেন।

এদিকে, শ্রমিকরা এটি মেনে নিলেও মিলটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, হঠাৎ করে বেকার হয়ে যাওয়া অনেক শ্রমিককের নিরব কান্নায় ভারি হয়ে উঠে ওখানকার পরিবেশ। এমন একজনের সাথে কথা হয় উত্তরাধিকার ৭১ নিউজের সাথে। তাঁর নাম নাজমা বেগম, বয়স ৪২ বছর। তাঁরা এক পরিবারের ৮ জন সদস্য এই মিলে কাজ করতেন। যারা সবাই এখন বেকার।

নাজমা কান্না জড়িত কন্ঠে উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, 'স্যার তিন সপ্তাহ যাবত আমাদের বেতন দেয় না, দুই সপ্তাহের বেতন বকেয়া এখনো। আমার পরিবারের ৮ জন সদস্য, এখানে চাকরি করি। অনেক টাকার দেনা, সমিতির কিস্তি। এমন অবস্থায় আমাদের মিলটাও বন্ধ হয়ে গেলো। আমরা এখন কি করবো! কই যাবো, কি খাবো! চিন্তায় রাইতে ঘুম হয় না স্যার'।

নাজমা'র কণ্ঠ জড়িয়ে কথাগুলো আটকিয়ে যাচ্ছিলো। এসময় তাঁর সাথে থাকা পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে ওরনা দিয়ে চোখ মুখতে দেখা যায়। ওই অবস্থায় ছবি তুলতে চাইলে তারা অনুমতি না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেন এবং পিছন দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলেন'।

এ.এইচ জুট মিলের শ্রমিক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ বিষয়ে ওই মিলের সহকারি জেনারেল ম্যানেজার (এজিএম) আজম আলী মোল্লা জানান, 'শ্রমিকদের বকেয়া বেতন নিয়ে ঝামেলা হতো না। ৫ আগস্টের পর মিলটিতে লেনদেনের কিছু জটিলতার কারণে এমনটি হয়েছে। এখন সমাধান হয়েছে। আশা করছি, সোমবারের মধ্যে সব স্টাফের বকেয়া বেতন পরিশোধ করতে পারবো'। এক প্রশ্নের জবাবে আজম আরো জানান, 'কবে এই মিল পুনরায় চালু হবে, সেটি অনিশ্চিত।’

এদিকে, ওই জুট মিলের শ্রমিকদের শান্ত করে, যৌক্তিক সমাধান দেওয়ার পর ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এণ্ড অপস) শৈলেন চাকমা উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, 'ফরিদপুরের পুলিশ সুপারের নির্দেশে এখানে প্রথমে কোতয়ালি থানার ওসিসহ একটি টিম আসে এবং রাত ৮ টার দিকে আমি এসে সবার সাথে কথা বলেছি। এখানকার শ্রমিক বিক্ষোভ থামানো হয়েছে, পরিস্থিতি সম্পুর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে। উভয় পক্ষের মধ্যে আর কোন প্রকার সমস্যা নেই। কিছু বকেয়া পরিশোধের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

শৈলেন আরো জানান, 'সোমবার নাগাদ বিষয়টি পুরোপুরি সমাধান হয়ে যাবে আশা করছি। সমাধান না হওয়া পর্যন্ত উভয় পক্ষের সাথে পুলিশের যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে।’

এদিকে, মিলটি'র শ্রমিক অসন্তোষ ও বিক্ষোভের বিষয়টির সুন্দর ও শান্তিপুর্ণ সমাধান করায় ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলেন চাকমা ও ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ওসি আসাদ উজ্জামানসহ ওইখানে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মিলের এক স্টাফ অফিসার জানান, 'স্যার আমাদের কথাও একটু বইলেন, আমরা ৩০ থেকে ৩৫ জন স্টাফ অফিসারের ৫০ দিনের বেতন বকেয়া আছে। এদিকে আমাদের মিলটিও বন্ধ হয়ে গেলো। আমরা বকেয়া বেতন না পেলে মিলের গেটের সামনের খাবার হোটেল ও চায়ের দোকানদের বকেয়া বিলও আমরা পরিশোধ করে যেতে পারবো না'।

উক্ত বিষয়ে, ফরিদপুর কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি) আসাদ উজ্জামান জানান, 'আমরা স্টাফদের বকেয়া বিষয়েও হিসেব নিয়েছি এবং ওইভাবেই যাতে পেমেন্ট করা হয়, সেই ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছি এবং লোক ঠিক করে দিয়েছি। সুতরাং, এখানে আর কোন জটিলতা নাই। সোমবারের মধ্যে এই সমস্যা'র সমাধান নিশ্চিত করতে আমরা সবার সাথে যোগাযোগ রাখবো'।

উল্লেখ্য, এএইচ জুট মিলের আসল মালিক আবুল হোসেন নামের স্থানী এক ব্যবসায়ী হলেও, মিলটি আনিস আহমেদ বেলায়েত নামের এক ব্যবসায়ী ভাড়ায় চালাতেন।

এদিকে, শ্রমিক বিক্ষোভ চলাকালীন আবুল হোসেন ও আনিস আহমেদ বেলালের সাথে একাধিক মাধ্যমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাঁদের কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি মিলটির এজিএম আজম আলী মোল্লার ব্যক্তিগত ফোন দিয়ে একাধিকবার ফোন করলেও তারা দু'জনের কেউ ফোন ধরেননি।

(আরআর/এসপি/সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪)