শেখ  ইমন, ঝিনাইদহ : ‘মাতৃবৎ পরদারেষু,পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ’। সরলার্থ হলো-পরস্ত্রীকে ‘মা’ মনে করতে হয় (যাতে পরস্ত্রীকে নিয়ে মনে কুচিন্তা না আসে) আর পরের দ্রব্য বা পরধনকে লোষ্ট্র (লোস্ট্র’ মানে মাটির ঢেলা) ভাবতে হয় (যাতে নিতে ইচ্ছা না হয়)।

চাণক্যের শ্লোকের পরস্ত্রী-সংক্রান্ত অংশ বাদ দিয়ে ‘পরের ধন’সংক্রান্ত অংশের আলোচনায় ঢুকলে অবধারিতভাবে ‘দখলদার’ নামক এক শ্রেণির পেশাজীবীর প্রসঙ্গ আসবে। এ পেশাজীবির কাজ পরের ধনকে নিজের মনে করে ব্যবহার করা। আর এভাবেই নিজের মনে করে ঝিনাইদহের শৈলকুপা, হরিণাকুণ্ডু ও সদর উপজেলায় জিকে সেচ প্রকল্পের প্রায় ৩’শ থেকে সাড়ে ৩’শ বিঘা জমি দখল করে নিয়েছেন দখলদাররা। এর মধ্যে পরিত্যক্ত অবস্থায়ও আছে কিছু জমি। এসব স্থানগুলোতে দখলদার রয়েছেন ৫’শ থেকে সাড়ে ৫’শ জন। বছরের পর বছর দেখভাল ও তদারকির অভাবে বে-দখল হয়ে যাচ্ছে শত শত বিঘা জমি ও স্থাপনা,হচ্ছে লুটপাটও।

শৈলকুপার গাড়াগঞ্জ এলাকায় গিয়ে দেখা যায় সেখানে অবস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের শাখা অফিসের স্থাপনাগুলো ছেয়ে গেছে বন-জঙ্গলে। খুলে পড়ছে ভবনের ইট। সেইসঙ্গে ধ্বসে পড়ছে দেয়াল। কোথাও আবার চুরি হচ্ছে জানালা দরজাসহ সেচ খালের লোহার গেট। এরইমধ্যে জিকে সেচ প্রকল্পের জমি-স্থাপনা দখলে মেতে উঠেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। গড়ে তুলেছেন দোকানপাট, ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনা। যেন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে ঝিনাইদহের গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের এসব জায়গা। তবে প্রকল্পের এমন দশায়ও কোনো মাথা ব্যথা নেই কর্তৃপক্ষের।

ঝিনাইদহসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চার জেলায় আমন চাষে পানির ঘাটতি মেটাতে চালু করা হয় দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প। চাষাবাদ বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রকল্পটি নেয়া হলেও অধিকাংশ জমি ও স্থাপনা এখন একপ্রকার বে-দখল। প্রকল্পের সুবিধাভোগী কৃষকরা বলছেন,বছরের পর বছর তদারকি না থাকায় অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে প্রকল্পের এসব জমি।

জানা যায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলায় সেচ খাল খনন করা হয়। যার প্রথম কাজ শুরু হয় ১৯৫৫-৫৬ অর্থবছরে। ১৯৫১ সালে প্রাথমিক জরিপের পর ১৯৫৪ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। তবে চালু হয় ১৯৬২-৬৩ সালে।

পাউবোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান,শুরুতে বছরের ১০ মাস (১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ অক্টোবর) দিনরাত ২৪ ঘণ্টা তিনটি পাম্পের মাধ্যমে পানি তোলা হতো। বাকি দুই মাস চলত রক্ষণাবেক্ষণ। ১৯৩ কিলোমিটার প্রধান খাল, ৪৬৭ কিলোমিটার শাখা খাল ও ৯৯৫ কিলোমিটার প্রশাখা খালের মাধ্যমে সেচ প্রকল্পের পানি কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার ১৩টি উপজেলায় সরবরাহ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় সেচযোগ্য এলাকা রয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ১০৭ হেক্টর।

গাড়াগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সম্রাট হোসেন বলেন, ‘জিকে সেচ প্রকল্পের শত শত বিঘা জমি ও স্থাপনা বছরের পর বছর বিলীন হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ নজর না দেয়া আর সংস্কার না করার কারণে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর এসব স্থাপনা দখল করে রেখেছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। এসব স্থাপনাগুলো দখলমুক্ত করে ভাড়া দিলে বা অন্য কোনো প্রকল্পে ব্যবহার করলে সরকার রাজস্ব পেত।’

একই এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘জিকের বিভিন্ন শাখা অফিসে শত শত বিঘা জমি পড়ে আছে। সেসব শাখা অফিসে বড় বড় গাছ রাতের আঁধারে লোকজন কেটে নিয়ে যায়। দেখভালের কেউ না থাকায় দিন দিন দখল হয়ে যাচ্ছে। দখলদাররা ঘর-বাড়ি তৈরি করছেন। আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা মাঝে মধ্যে আসতেন। কিন্তু এখন তারা আর আসেন না। জিকে সেচ খালেও এখন পানি ঠিকমতো দেয়া হয় না। যে কারণে সেচ খালের লোহার গেটগুলোও দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় কৃষক ও বাসিন্দাদের কথা বিবেচনা করে জিকের এসব স্থাপনা পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।’

এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-প্রধান সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুল মোত্তালিব বলেন, ‘লোকবল সংকটের কারণে আমাদের শাখা অফিস সহ স্থাপনাগুলো দেখভাল করতে পারছি না। কিছু কিছু স্থানে দখলদার উচ্ছেদ করেছি। নতুন করে প্রকল্প হাতে নিয়েছি। অনুমোদন হলেই এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।’

(এসআই/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪)