সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে আয়োজিত জশনে জুলুস মিছিলকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। জশনে জুলুসের মিছিল থেকে মসজিদে হামলা ও ভাঙচুরের সময় বাধা দিতে গিয়ে মো. মীর আরিফ মিলন (৫২) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়। নিহত মো. মীর আরিফ মিলন (৫২) উপজেলার ছয়সূতী গ্রামের মৃত মীর জাবু মিয়ার ছেলে। তিনি স্থানীয় ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও উপজেলা বিএনপির সদস্য ছিলেন। ১৬ সেপ্টেম্বর সোমবার সকাল ১১টার দিকে উপজেলা ছয়সূতী ইউনিয়নের ছয়সূতী বাসস্ট্যান্ড কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে এ হামলার ঘটনাটি ঘটে।

মসজিদে হামলার পর বিক্ষুব্ধ জনতা স্থানীয় প্রতাপনাথ বাজার সংলগ্ন সৈয়দ আবু মোহাম্মদ মঞ্জুরুল হামিদ (রহ.) এর ছয়সূতি গাউছিয়া দরবার শরিফের আস্তানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে মাজারভক্ত মো. রইছ মিয়া ও মো. সেলিম মিয়াকে মারধর করে। এসময় তারা প্রতাপনাথ বাজারের বেশ কয়েকটি দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করে এবং দোকানদার মো. রিয়াজ উদ্দিন, বাবু মিয়া, রুপবানু ও কাঞ্চন মিয়াকে মারধর করে। এছাড়া তারা মাজারপন্থী বেশ কয়েকজনের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করে। হামলায় উভয় পক্ষের অন্তত ১৫ জন আহত হয়।

নিহতের ভাই আলফাজ মিয়া ও ছোট বোন আছমা আক্তার বলেন, সোমবার সকাল ১১টার দিকে ছয়সূতী বাসস্ট্যান্ড কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে হামলা ফিরাতে গিয়ে হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হয় তাদের ভাই মিলন। পরে স্থানীয়রা তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে বাজিতপুর জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তারা এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কয়েক বছর যাবৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও ইমাম উলামা পরিষদ পৃথক পৃথক ভাবে ছয়সূতী ইউনিয়নে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করে আসছে। মাজারপন্থী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত সংগঠনের সদস্যরা জশনে জুলুস কর্মসূচী পালন করে। মাজার বিরোধী অপর পক্ষ সিরাদুন্নবী (সা.) নামে পৃথক কর্মসূচী পালন করে।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পক্ষ থেকে আগামী বুধবার ছয়সূতি গাউছিয়া দরবার শরিফে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়। ওয়াজ মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা মুফতি গিয়াস উদ্দিন আত্ব-তাহেরীর। তার আগমনের কথা শুনে ক্ষুব্ধ উপজেলা ইমাম ওলামা পরিষদের নেতারা। তাহেরীর আগমন ঠেকাতে তারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাবিহা ফাতেমাতুজ-জোহরার কাছে একটি লিখিত আবেদন করেন। বিষয়টি সুরাহার জন্য কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সারোয়ার জাহান’কে দায়িত্ব দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। ওসি গত রোববার আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নেতাদের সঙ্গে সভা করে ওয়াজ মাহফিল স্থগিত করান।

এ অবস্থায় ইমাম ওলামা পরিষদ সোমবার সকাল ১০টায় ছয়সূতি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সিরাদুন্নবী (সা.) কর্মসূচী ঘোষণা করেন। একই সময় জশনে জুলুশের মিছিল বের করার ঘোষণা দেয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত। ওসির মধ্যস্থতায় ইমাম ওলামা পরিষদের সকাল ১০টার কর্মসূচী স্থগিত করে কর্মসূচীর পরবর্তী সময় নির্ধারণ করে দেন ওইদিন বিকেলে।

পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী সকাল ১০টার দিকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পক্ষ থেকে সৈয়দ আবু মোহাম্মদ মঞ্জুরুল হামিদ (রহ.) এর ছয়সূতী গাউছিয়া দরবার শরীফ থেকে ঈদে মিল্লাদুন্নবীর জশনে জুলুসের মিছিল বের করে মাধবদী হয়ে ছয়সূতী বাসস্ট্যান্ডের দিকে আসার পথে পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের বাধা দেয়। এসময় জশনে জুলুস মিছিল থেকে কিছু লোক পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বাধা অতিক্রম করে ছয়সূতী বাসস্ট্যান্ড কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে এসে মসজিদে অবস্থানরত মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ও মসজিদ ভাঙচুর করে।

এসময় বাসস্ট্যান্ডের ব্যবসায়ীরাসহ স্থানীয় মুসল্লি, মসজিদ মাদ্রাসার আলেম-ওলামা ও ছয়সূতী ইউনিয়ন বিএনপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. মীর আরিফ মিলন হামলাকারীদের বাধা নিষেধ দেয়। বাধা দিতে গেলে হামলাকারীরা মো. মীর আরিফ মিলনের উপর হামলা করে তাকে মারধোর করে। এসময় ইটপাটকেলের আঘাতে ছয়সূতী খাদেমুল ইসলাম হোসাইনিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার ছাত্র ছয়সূতী বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. হানিফ মিয়ার ছেলে রেদোয়ান ও নিজগাঁও মসজিদের মুয়াজ্জিন চক্ষু প্রতিবন্ধী (অন্ধ) মো. শাহিন আহত হয়। আহতদের মধ্যে মো. মীর আরিফ মিলনকে উদ্ধার করে বাজিতপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তবর‌্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত দুই ছাত্রকে উদ্ধার করে কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করা হয়।

ঘটনার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত এলাকায় অসংখ্য সেনাবাহিনীর সদস্য ও পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
ঘটনার পর বিকাল দুইটার দিকে ছয়সূতী খাদেমুল ইসলাম হোসাইনিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা চত্বরে উপজেলা ইমাম উলামা পরিষদের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জামিয়া নূরুল উলুম কুলিয়ারচর মাদ্রাসার প্রধান মোহাদ্দেস মুফতি মাওলানা নাসির উদ্দিন রহমানী লিখিত বক্তব্য পাঠ করে বলেন, ইমাম উলামা পরিষদ কুলিয়ারচর প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরেও সীরাত সম্মেলন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। অপর দিকে ভ- বেদাতির জশনে জুলুসের নামে আমাদের অনুষ্ঠান মসজিদ সংলগ্ন রাস্তায় মিছিল করতে চায়। এমতাবস্থায় ইউএনও ও কুলিয়ারচর থানার ওসি সাহেব আমাদেরকে নিশ্চিত করেন যে, কোন অবস্থাতে জশনে জুলুস নিয়ে আমাদের মসজিদ সংলগ্ন রাস্তায় আসতে দিবে না। সেই সাথে তাদেরকে বিকল্প রোড ম্যাপ দেওয়া হয় এবং আমাদের সকালের কর্মসূচী স্থগিত করার নির্দেশ দেন। আমরা ওসি সাহেবের কথায় সম্মেলন স্থগিত করি। কিন্তু উগ্রপন্তী বেদাতিরা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ওরা মসজিদের সামনে এসে মসজিদকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে আমাদের মসজিদে ব্যাপক ভাঙচুর করে।

ইটপাটকেলের আঘাতে আমাদের মাদ্রাসার দুইজন ছাত্র আহত হয়। তাদেরকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছ। বাধা দিতে গেলে মসজিদের মুসল্লী আমাদের মিলন ভাইকে নির্মমভাবে মারধোর করে হত্যা করে তারা। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এর সাথে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি। এসময় তারা মঙ্গলবার সকাল ১০টায় ছয়সূতী বাসস্ট্যান্ডে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল করার ঘোষণা দেন এবং কুখ্যাত ভণ্ড বিদাতী বক্তা গিয়াস উদ্দীন আত্ব-তাহেরীকে ছয়সূতীর মাটিতে তথা কিশোরগঞ্জ জেলায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন।

এ সময় উপজেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা কুলিয়ারচর ইমাম উলামা পরিষদের সদস্যদের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করে লংমার্চ টু ছয়সূতী ঘোষণা করেন।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, বাজিতপুর উপজেলা ইমাম উলামা পরিষদের সভাপতি সায়কুল হাদিস আব্দুল আহাদ সাবের, বেতিয়ারকান্দি মাদ্রাসার ভাইস-প্রিন্সিপাল মুফতি ওবায়দুল্লাহ আনোয়ার, উপজেলা ইমাম উলামা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোহাদ্দেস মাওলানা আসাদুল্লাহ, ছয়সূতী খাদেমুল ইসলাম হোসাইনিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হাফেজ মো. হানিফ, উপজেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সদস্য আব্দুল হাসিব, ফয়সাল আহমেদ রাজিব, ফয়সাল আহমেদ তুহিন, ফাহিম, মাজেদুল ইসলাম সিফাত, আহমেদ সিফাত ও তন্ময় প্রমূখ।

সংবাদ পেয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বিপিএম (সেবা), মেজর নূর ইমতিয়াজ মাহমুদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডমিন) মো. মোস্তাক সরকার, কুলিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাবিহা ফাতেমাতুজ-জোহরা, ভৈরব সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মো. দেলোয়ার হোসেন খান ও কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সারোয়ার জাহান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাবিহা ফাতেমাতুজ-জোহরা ও কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সারোয়ার জাহান বলেন, এ ঘটনা সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অপরদিকে কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সূতী বাসস্ট্যান্ডে তাওহিদী জনতার উপর হামলা ও হত্যাকা-ের বিচারের দাবিতে পার্শ্ববর্তী উপজেলা ভৈরবে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সোমবার বাদ আছর ইমাম উলামা পরিষদ ভৈরব এর উদ্যোগে দুর্জয় মোড় নুরানী মসজিদের সামনে এ প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

ভৈরব বাজার জামে মসজিদের খতিব হাফেজ জামাল উদ্দিনের সভাপতিত্বে এবং মাওলানা সাইফুল ইসলাম এর পরিচালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, ইমাম উলামা পরিষদ ভৈরবের সভাপতি মাওলানা মো. আল আমিন, শাহী মসজিদের খতিব মুফতি উমর ফারুক, কমলপুর মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মাওলানা হাফিজুল্লাহ কাসেমী, ইমাম উলামা পরিষদ ভৈরবের সাধারণ সম্পাদক ও নুরানী মসজিদের খতিব মাওলানা এনায়েতুল্লাহ ভৈরবী, মুফতি রাফি উদ্দিন, মাওলানা উসমান গণী, ডা. মাওলানা আনাস মাহমুদ, মুফতি মাসুদ হামিদী, মুফতি শাকের হুসাইন রাহমানী, মুফতি আরিফুল ইসলাম ও মাওলানা জুনায়েদ আহমেদ প্রমুখ।

এসময় বক্তারা বলেন, জশনে জলুসের নামে একদল ভণ্ড বিদায়াতী সন্ত্রাসী ছয়সূতি মসজিদ মাদ্রাসায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে মসজিদ ভাঙচুর করে। মসজিদে অবস্থানরত মুসল্লী ও মাদ্রাসার ছাত্রদের উপর সশস্ত্র হামলা চালায়। এতে একজন মুসল্লী নিহত এবং কয়েকজন গুরুতর আহত হয়।
ইমাম উলামা পরিষদ ভৈরব এর নেতৃবৃন্দ এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার পূর্বক দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবী জানান।

(এসএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৪)