ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


শারীরিক গঠন ফিট না থাকলে মন খারাপ হতেই পারে। নারীর ক্ষেত্রে এই মন খারাপের কারণ হতে পারে স্তন ঝুলে যাওয়া নিয়ে। অল্প বয়সেই অনেক নারীর স্তন ঝুলে যাওয়ার সমস্যায় পড়তে হয়। এর অনেকগুলো কারণও আছে। তবে কারণ ও সমাধান জানা থাকলে এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।দিন দিন আমার ব্রেস্ট ঝুলে যাচ্ছে, দেখতে খুবই বাজে লাগে! এখন আমি কী করব? প্রশ্নটি আমরা প্রায়ই রোগীদের কাছ থেকে শুনে থাকি। এতে আতঙ্কিত বা মন খারাপ করার কিছু নেই। অনেক কারণেই ব্রেস্টের আকারে পরিবর্তন আসতে পারে। তার মধ্যে কিছু মেইন কারণ হলো  বয়স, ওজনের পরিবর্তন, ধূমপান করা, পর্যাপ্ত সাপোর্ট ছাড়াই ভারী কাজ করা ইত্যাদি। অনেক সময় আবার জেনেটিক কারণেও এমন হতে পারে। তবে এমন অবস্থায় প্যানিক না করে কিছু নিয়ম মেনে চললে সহজে মিলবে এর সমাধান। অনেকের আবার বয়সের আগেই এমন সমস্যা দেখা দেয়! তাই আজকে আমরা জেনে নিব, ব্রেস্ট ঝুলে পড়ার কারণ ও সমাধান সম্পর্কে।

স্তন ঝুলে যাওয়ার প্রাকৃতিক কারণ

বেশিরভাগ নারীর স্তন তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে ঝুলতে শুরু করবে। বছরের পর বছর ধরে মাধ্যাকর্ষণ প্রভাব আপনার আবক্ষ নিচে টান যথেষ্ট. স্তন ঝুলে যাওয়ার অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:

* বার্ধক্য * মেনোপজ * গর্ভাবস্থা * বড় স্তনের আকার

ব্রেস্ট ঝুলে পড়ার সাধারণ কারণ

১) বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই ব্রেস্ট ঝুলে যায়: বয়স যত বাড়তে থাকে আমাদের ত্বকের যে আবরণ বা চামড়াও ধীরে ধীরে কুঁচকে যায়। আমাদের মুখের চামড়ার মত আমাদের ব্রেস্টের চামড়ার টান টান ভাবও দিন দিন মলিন হতে থাকে। এটি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

২) নিচু হয়ে বা বেশি ঝুঁকে কাজ করলে: বাসা বাড়ি বা অফিসে নানা কাজে অনেকেই অনেকক্ষণ ধরে একটানা ঝুঁকে থাকি বা নিচু হয়ে থাকি। এর ফলে ব্রেস্টের আকারের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। প্রথম প্রথম বোঝা না গেলেও কিছুদিন পরই পরিবর্তনটি লক্ষ্য করা যায়।

৩) প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক ব্রা ব্যবহার না করলে: ব্রা শব্দটা অনেকের কাছেই ট্যাবুর মতো। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক ব্রা পরি না বা সঠিক মাপ জানি না। কিন্তু এই ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা খুবই জরুরি। একদম শুরু থেকেই সঠিক মাপের এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক ব্রা নির্বাচন করলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন সমস্যা থেকে সহজেই প্রতিকার পাওয়া যায়। ব্রেস্ট ঝুলে যাওয়ার মতো সমস্যাও অনেক সময় সঠিক ব্রা সিলেক্ট না করার জন্য হয়ে থাকে। আর এর সাথে দরকার সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং পর্যাপ্ত ঘুম।

৪) ওয়ার্ক-আউটের সময় স্পোর্টস ব্রা ব্যবহার না করলে: ওয়ার্কআউটের সময় শরীরের ওপর প্রচুর প্রেসার পড়ে। ব্রেস্টের কোলাজেন ওয়ার্ক-আউটের সময় ভাঙতে থাকে। তাই এসময় ব্রেস্ট যদি প্রোপার সাপোর্ট না পায় সেক্ষেত্রে ব্রেস্ট ঝুলে পড়ে সহজেই। ওয়ার্কআউটের সময় চেষ্টা করতে হবে ঢিলাঢালা ব্রা না পরে স্পোর্টস ব্রা বা টাইট ফিটিং ব্রা পরার।

৫) স্মোকিং বা ধূমপান করার অভ্যাস থাকলে:যখন স্মোক করি তখন আমাদের সেলে থাকা ইলাস্টিনে এর প্রভাব পড়ে এবং এই ইলাস্টিন আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করে। এ থেকে ব্রেস্ট ঝুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৬) ব্রেস্ট এর সাইজ তুলনামূলক ভাবে বেশি বড় হলে: অনেকেরই ব্রেস্ট এর সাইজ অনেক বেশি বড় এবং ভারী হয়ে থাকে। যাদের শারীরিক গঠন এমন হয় তাদের ব্রেস্ট অন্যদের তুলনায় আগে আগে ঝুলে পরার প্রবণতা থাকে।

৭) গর্ভধারণের পরবর্তীকালীন সময়ের প্রভাবে: গর্ভধারণের সময় মেয়েদের ব্রেস্টের সাইজ অনেকটাই বড় হয়ে যায়। আবার কিছুদিন পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এই পরিবর্তনের ফলেই অনেক সময় মেয়েদের ব্রেস্টের আকার পরিবর্তন হয়ে ঝুলে পড়ে।

৮) শরীরের ওজন বেড়ে গেলে: একটি নির্দিষ্ট শেইপে ব্রেস্ট থাকাকালীন হঠাৎ করে শারীরিক গঠনের পরিবর্তন হলে অনেক সময় ব্রেস্ট ঝুলে যেতে পারে।

৯) জেনেটিকাল কারণে: সবার শারীরিক গঠনই আমাদের বাবা-মায়ের জিনের ওপর নির্ভর করে। যদি ফ্যামিলিতে এমন অনেকেরই হয়ে থাকে তবে আপনিও অনেক সময় সেখান থেকে এটি বংশগতভাবে পেতে পারেন।

স্তন ঝুলে যাওয়ার লক্ষনসমুহ

নারী স্তন অস্থিবন্ধনীতে অবলম্বন করেথাকে; যদি ঐসকল অস্থিবন্ধনী প্রসারিত হয়, পেশীকলার শক্তি হ্রাস পাবার কারনে স্তনের প্রাকৃতিক অবস্থান সাধারনত নিচে নেমে আসে। স্তনবোঁটার স্থানচ্যুতি (স্তনের একদম নিচের দিকেচলে আসা) এবং স্তনের দুই পাশে চামড়া কুচকে যাওয়া থেকেও স্তন ঝুল সহজে অনুমান করা যায়।

স্তন সমস্যা থেকে প্রতিকার পাওয়ার নিয়ম :অনেকেই এমন হলে আতঙ্কিত হয়ে লজ্জায় পড়ে যাই। আবার অনেকে নিজের শারীরিক গঠন নিয়ে ডিমোটিভেটেড ফিল করে। সমস্যা যেমন রয়েছে তেমনি সমস্যার সমাধানও রয়েছে। চলুন জেনে নেই ঘরোয়া সমাধান

(১) ডিমের কুসুম এবং শসার প্যাক : একটি ডিমের কুসুম এবং ৩ টেবিল চামচ শসার রস মিশিয়ে একটি প্যাক বানিয়ে নিতে হবে। এই প্যাকটি গোসলের আধা ঘন্টা আগে স্তনের চারপাশে ভালোভাবে লাগিয়ে রাখুন। ৩০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। এক সপ্তাহ প্রতিদিন এই প্যাকটি ব্যবহার করলে আপনি নিজেই পার্থক্য বুঝতে পারবেন।

(২) সঠিক খাবার: স্তনের সঠিক শেইপ ফিরে পাবার জন্য আপনার প্রতিদিনের খাবারের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ব্রেস্ট টাইট করার জন্য পর্যাপ্ত প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। তাই আপনার প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় দুধ, ডিম এবং ডাল অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করবেন। এছাড়াও খনিজ ভিটামিন এবং ক্যালসিয়ামের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ দরকার যা আপনি বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, গাজর, পটল এবং ব্রকলি জাতীয় খাবার থেকে পেতে পারেন। প্রতিদিন এই খাবারগুলো খেলে ঝুলে যাওয়া স্তনের সঠিক শেইপ ফিরে পাবেন।

(৩) সাঁতার কাটা: প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মিনিট সাঁতার কাটুন। এতে আপনার স্তনের পেশি শক্ত হবে এবং সঠিক শেইপ ফিরে আসবে। তাই স্তনের সঠিক শেইপ ফিরে পেতে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মিনিট সাঁতার কাটুন।

(৪) বরফ ঘষা বা আইস রাব: এটি করতে আপনার অস্বস্থি লাগতে পারে কিন্তু এটি খুবই কার্যকরী একটি প্রক্রিয়া। কয়েক কিউব বরফ নিন এবং আপনার স্তনের চারপাশে প্রায় ১-২ মিনিটের জন্য বৃত্তাকার গতিতে ম্যাসাজ করুন। এটি আপনার স্তনের পেশী শক্ত করতে এবং এর আশেপাশের সেলুলাইটের সাথে লড়াই করতে সহায়তা করবে। প্রতিদিন নিয়ম করে কেবলমাত্র ১-২ মিনিট এই প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করলে আপনার ঝুলে যাওয়া স্তনের সঠিক শেইপ ফিরে পাবেন।

(৫) ম্যাসাজ করা: প্রতিদিনের ম্যাসাজে আপনার স্তনের পেশীগুলোকে শক্ত করবে। অলিভ ওয়েল কিংবা অ্যালোভেরা জেল দিয়ে প্রতিদিন ৫-৬ মিনিট আপনার স্তনের আশেপাশে ম্যাসাজ করুন। এটি আপনার রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে সাহায্য করবে এবং আপনার ঝুলে যাওয়া স্তন ফিরে পাবে সঠিক শেইপ।

(৬) প্রচুর পানি পান: স্তনের সঠিক শেইপ ফিরে পেতে প্রতিদিন প্রচুর পানি পান করতে হবে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৪ লিটার পানি পান করুন। শরীরে যখন জলের অভাব দেখা দেয় তখন ত্বকে বয়সের ছাপ পড়ে যায়। ত্বকের চামড়া ঝুলে যায় এবং কুঁচকানো দেখায়। পানির অভাবে সবথেকে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় ত্বক এবং স্তন। তাই স্তনের সঠিক শেইপ ফিরে পেতে প্রচুর পানি পান করুন।

(৭) ব্রা সিলেকশন: দীর্ঘক্ষণ ব্রা পড়ে থাকলে স্তনের শেইপ নষ্ট হয়ে যায়। তাই দীর্ঘক্ষণ ব্রা পড়ে থাকবেন না। আবার ব্রা পড়া একেবারেই ত্যাগ করা যাবেনা। দীর্ঘক্ষণ ব্রা পড়া যেমন ক্ষতিকর আবার একেবারে না পড়াও ক্ষতির কারণ। ব্রা সিলেকশনে একটু সচেতন হোন।

(৮) ধূমপান ত্যাগ করুন: ধূমপানের ফলে স্তন ঝুলে যায় এইটা হয়তো আমাদের অনেকেরই জানা নেই। মেয়েরা ধূমপান করলে ত্বকেরও ক্ষতি হয়। তাই ধূমপান ত্যাগ করতে হবে।

(৯) এক্সারসাইজ করুন: কিছু এক্সারসাইজ আছে যা প্রতিদিন করলে আপনার ঝুলে পড়া স্তন সঠিক শেইপ ফিরে পাবে। সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকরী হলো পুশ-আপ। এছাড়াও চেস্ট প্রেস, ডাম্বল ফ্লাইস, টি-প্লাঙ্কস, এলবো স্কুইজ ইত্যাদির সাহায্যেও ঝুলে পড়া স্তন সঠিক শেইপ ফিরে পাবে। প্রতিদিন নিয়ম করে ১০-১২ বার এই এক্সারসাইজগুলো করলেই হবে।

অল্প কিছু নিয়ম মেনে চললেই আপনি ফিরে পেতে পারেন আপনার স্তনের সঠিক শেইপ। তাই এই নিয়মগুলো মেনে চলুন সুস্থ এবং সুন্দর থাকুন।

হোমিও প্রতিকার

রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয় এই জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক কে ডা.হানেমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসারে নারীদের ব্রেস্টের সমস্যা সহ যে কোন জটিল কঠিন রোগের চিকিৎসা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ভিওিক লক্ষণ সমষ্টি নির্ভর ও ধাতুগত ভাবে চিকিৎসা দিলে আল্লাহর রহমতে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। চিকিৎসা বিজ্ঞানে চিরন্তন সত্য বলে কিছুই নেই। কেননা একসময় আমরা শুনতাম যক্ষা হলে রক্ষা নেই , বর্তমানে শুনতে পাই যক্ষা ভাল হয়। এ সবকিছু বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ফসল। ব্রেস্টের নানান সমস্যার চিকিৎসা হোমিওপ্যাথিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি। সামগ্রিক উপসর্গের ভিত্তিতে ওষুধ নির্বাচনের মাধ্যমে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করা হয়। এটিই একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে রোগীর কষ্টের সমস্ত চিহ্ন এবং উপসর্গগুলি দূর করে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যের অবস্থা পুনরুদ্ধার করা যায়। আবার ইদানিং অনেক নামদারি হোমিও চিকিৎসক বের হইছে,তাঁরা ব্রেস্টের সমস্যার রোগীদেরকে অপচিকিৎসা দিয়ে চিকিৎসা দিয়ে থাকে তাদের কে ডা.হানেমান শংকর জাতের হোমিওপ্যাথ বলে থাকেন,রোগীদের কে মনে রাখতে হবে, ব্রেস্ট ঝুলে যাওয়া কোন সাধারণ রোগ না, তাই সঠিক চিকিৎসা পাইতে হইলে অভিজ্ঞ চিকিৎকের পরামর্শ নিন।

পরিশেষে বলতে চাই, বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই শরীরের গঠনে নানা রকম পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। স্কিন এবং হেয়ার কেয়ারের ব্যপারের যতটা সচেতন তার মতোই যদি ব্রেস্টের কেয়ারের ব্যাপারেও একটু খেয়াল রাখি, তাহলে সহজেই এমন সমস্যার সমাধান মিলবে। আর নারীর স্তন বিভিন্ন ফ্যাটি টিস্যু এবং গ্রন্থি দিয়ে গঠিত যা দুধ তৈরি করে। সেসব টিস্যু এবং গ্রন্থিগুলো চামড়া দিয়ে ঢাকা, যেগুলো প্রাকৃতিকভাবেই নমনীয়। এছাড়া ইলাস্টিন নামে একটি প্রোটিনের উপস্থিতিও একটি কারণ। কিন্তু এই নমনীয়তা যদি চামড়ার উপর চাপ ফেলে তাহলে স্তন ঝুলে যায়। আর স্তনের টিস্যুগুলো চামড়ার মতই ভিটামিন সি ও বি নিয়ে থাকে। স্তনের নমনীয় টিস্যুগুলোকে সহায়তা করতে ভিটামিন সি ও বি খুবই দরকারি। যদি প্রতিদিন ভিটামিন সি গ্রহণ কম হয়ে থাকে তাহলে সেদিকে মনোযোগ দিন।
তাই স্তন ঝুলবে কি ঝুলবে না সেটা নির্ভর করে স্তনের টিস্যু ও ফ্যাটের উপর। স্তন ঝুলার সম্ভাবনা খুব কম যদি আপনার স্তনে ঘন টিস্যু থাকে। সহজে বললে বলতে হয় ছোট স্তনও ঝুলে যায়। তাই পরিমিত ও ভারসাম্যপূর্ণ আহার এবং শরীরচর্চা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সুস্থতার সাথে সাথে স্তনের ভারসাম্যও রক্ষা করতে পারে। দ্রুত কোন ফল না চেয়ে পরিকল্পনা মাফিক ও সুশৃঙ্খল কাজের মাধ্যমেই আপনার স্তনকে ঝুলে পড়া থেকে দীর্ঘদিন রক্ষা করতে পারেন।

লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক।