চৌধুরী আবদুল হান্নান


বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার তার ২ বছরের কর্মকালীন সময়ে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। ব্যাংকে যতগুলো বড় ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, জালজালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে সেগুলোর সবগুলোতেই তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তা রয়েছে।

ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, রাষ্ট্রীয় কোষাগার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অকার্যকর ও ব্যর্থ সংস্থায় পরিণত করে গেছেন তিনি। শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত থাকায় পূর্ব থেকেই সংস্থাটি ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছিল আর তালুকদার সাহেব কফিনে শেষ পেরেকটি মারলেন।

ফলে অর্থলোভী ক্ষমতাবানরা নির্বিঘ্নে বড় বড় জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেলো। সবচেয়ে বিপজ্জনক যে, এভাবে ব্যাংক থেকে অবলীলায় বের করে নেওয়া অর্থের অনেকটাই বিদেশে পাচার করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ আছে। অর্থ পাচারের সহযোগিতার দায় গভর্নর এড়াতে পারেন না। অর্থনীতির মূল সমস্যা অর্থ পাচার আর প্রতিবছর দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো।

একটি অর্থ পাচার মামলার শুনানিতে আদালতের পর্যবেক্ষণ পত্রিকায় লক্ষ্য করেছিলাম, সেখানে বলা হয়েছিল- “বিদেশে অর্থ পাচারকারীরা দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু। হত্যার চেয়ে অর্থ পাচার বেশি গুরুতর, কারণ মানুষ হত্যা করলে একটি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর অর্থ পাচার করলে পুরো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

ব্যাংক খাতের খলনায়ক ইচ্ছাকৃত বা স্বাভাবজাত ঋণখেলাপিদের প্রচলিত দশ শতাংশের পরিবর্তে মাত্র আড়াই থেক চার শতাংশ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দিয়েছেন তিনি। বার বার কোম্পানি আইন পরিবর্তন করে ক্ষমতাবানদের ব্যাংকের স্বার্থ পরিপন্থী সুযোগ দিয়েছেন। তিনি দুষ্টচক্রের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন।

বিভিন্ন জালিয়াতি জেনেও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া, স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়া এবং উপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার কারণে গভর্নরের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন বিক্ষোভ করেছিলেন কর্মকর্তারা।

একই কারণে মাত্র কয়েকমাস পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন।

রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের (ছাগলকাণ্ড খ্যাত) মতো একদন ধুরন্ধর দুর্বৃত্তকে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক বানিয়ে গভর্নর প্রমান করেছেন তিনি ব্যাংক খাতে দাপিয়ে বেড়ানো দুর্বৃত্তের সহায়ক।

তার কর্মকালীন সময়ে তিনি যত কাজ করেছেন, তার অধিকাংশই বিশেষ গোষ্ঠীকে তুষ্ট করার জন্য, মূলত ঋণখেলাপিদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার জন্য। অবস্থাটা এমন হয়েছিল যে, যত বড় খেলাপি সে তত বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বকীয়তা হারিয়ে হয়ে পড়েছিল দুষ্টচক্রের আখড়া।

স্বীকৃত যে, বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতা হারিয়েছে, বাহির শক্তির চাপে তাদের কাজ করতে হয়। এমন অজুহাতে, ন্যুনতম প্রতিবাদ না করে সকল অপরাধমূলক কাজের সাথে নিজে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার চলার পথে পথে অপরাধের চিহ্ন রেখে গেছেন।

এক পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশ না করতে দেওয়ার ঘটনা তার কর্মকাণ্ড আরও প্রশ্নের মুখে পড়ে।

যারা বিবেক বিসর্জন দিয়ে লোভনীয় পদ আঁকড়ে রাখতে প্রভাবশালীদের অনৈতিক আবদার মেনে নিয়ে ন্যায়-নীতি পরিত্যাগ করেন, তারা মেরুদণ্ডহীন, পরগাছার মতো, তাদের সারা জীবনের শিক্ষা মূল্যহীন।

ব্যাংক ও আর্থিক খাত থেকে অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচারসহ সকল অপরাধমূলক কাজে সহযোগিতা করে তিনি কতটা সুবিধা নিয়েছেন তা এখনই তদন্ত করে বের করতে হবে। কারণ অপরাধ করে পার পেয়ে গেলে খারাপ নজির সৃষ্টি হয়, তাতে অপরাধ উৎসাহিত হয়।

সরকার পতনের পর তিনি পালিয়ে গেলেন, এখনও প্রকাশ্যে আসেননি। তার অগস্ত্য যাত্রার পূর্বে জবাবদিহিতা ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে তাকে দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে।

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই-২৪ আন্দোলনে নির্বিচার মানুষ হত্যার বিচার শুরু করেছে। একই সাথে অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারকারী এবং তাদের দোসরদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের দিকে তাকিয়ে আছি।

লেখক : আবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।