ডা. মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বর্তমান সময়ে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে নামিদামি পত্রপত্রিকা কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে যে বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে সেটি হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছেন। নিত্যপণ্যের বাজারে এখনও মিলছে না স্বস্তি। এক পণ্যের দাম কমলে, বাড়ছে অন্যটির। এতে সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন ভোক্তারা। নতুন সরকারের কাছে বাজারে স্বস্তি ফেরানোর আহ্বান তাদের। এমন পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তিন কৌশলে এগোচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।

বাজারে ভোগ্যপণ্যের সংকট না থাকলেও কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। গত কয়েক বছরে বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজে আসেনি কোনো উদ্যোগ। ভোক্তারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বাজার তদারকির কারণে অনেক পণ্যের দাম হঠাৎ এক থেকে দেড় শ টাকা কমে গিয়েছে। তবে কোনো কোনোটির দাম আবার বেড়ে গিয়েছে। আশা করা যায়, এ সরকার ধীরে ধীরে বাজারে নিত্যপণ্যের দামে স্থিতিশীলতা আনবে। তাদেরকে সময় দিতে হবে।

সরকার পরিবর্তনের পর বাজারে কমেছে চাঁদাবাজি। তদারকি করছে সাধারণ ছাত্ররাও। এতে কিছুটা কমেছে সবজিসহ মুরগির দাম। মূল্যস্ফীতি কমাতে পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, সরবরাহ ঠিক রাখা ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে জোর দিচ্ছে নতুন সরকার।ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আইপি প্রয়োজন হয়। পেঁয়াজের দাম নিয়ে ক্রেতারা এমনিতেই ভোগান্তিতে আছেন। পণ্যটির দাম স্থিতিশীল করতে সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত আমদানির ব্যবস্থা করা সমীচীন।

সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে দেশের পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলা। এতে মানুষের বসতভিটা, ফসলি জমি ও রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দীর্ঘ সময় সড়ক ও রেলপথ বন্ধ থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে। গুরুত্বপূর্ণ এ পথে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে সারা দেশের সরবরাহ ব্যবস্থায়। বণিক বার্তার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এতে চালের বাজারে কেজিপ্রতি দাম বেড়ে যায় ৩-৪ টাকা। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য বন্যাকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। ত্রাণ হিসেবে চালের বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেড়েছে কিন্তু সরবরাহ তুলনামূলক কম। সরবরাহের তুলনায় বিক্রি বাড়ায় মিলাররা দাম বাড়িয়েছেন।

পাশাপাশি বন্যার প্রভাবে দাম বেড়েছে মুরগি ও ডিমের। এবারের বন্যায় তলিয়ে যায় ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুরের কয়েক হাজার মুরগির খামার। মারা গেছে লাখ লাখ মুরগি। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) তথ্যমতে, এ চার জেলায় আগে যেখানে গড়ে প্রতিদিন ডিমের উৎপাদন ছিল প্রায় ৪০ লাখ পিস। এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। বন্যাকবলিত অন্য জেলায় কমেছে আরো দেড়-দুই লাখ পিস ডিম উৎপাদন। বাজারে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে মুরগির দাম বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত। অনেক স্থানে ডিমের দামও বাড়তে শুরু করেছে।

সাধারণ মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণের বড় উৎস ডিম ও মুরগির মাংস। দেশে প্রতিদিন ডিমের গড় চাহিদা চার থেকে সাড়ে চার কোটি পিস এবং মুরগির মাংসের চাহিদা ৫ হাজার ২০০ টন।

বন্যাদুর্গতদের আমিষের চাহিদা পূরণে বর্তমানে অন্তত ডিমের দাম নাগালের মধ্যে থাকা দরকার। এর জন্য প্রয়োজন সরবরাহ ঘাটতি দূর করা। এ পরিস্থিতিতে আমদানির বিকল্প নেই। কিন্তু বিদ্যমান নীতি অনুযায়ী, ডিম শর্তসাপেক্ষে আমদানিযোগ্য পণ্য। ডিম আমদানির ক্ষেত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি নিতে হয়। বিশেষ অনুমতি ছাড়া ডিম আমদানি না হওয়ায় পেঁয়াজ আমদানি থেকে বিদ্যমান শুল্কহারে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করলেও ডিম ও আলু থেকে তেমন রাজস্ব আহরণ হয় না। আমদানির ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আলুর ক্ষেত্রেও, পূর্বানুমতি নিতে হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় ১২ লাখ টন আলু উৎপাদন কম হয়েছে। সুতরাং বাড়তি চাহিদা পূরণে আলু আমদানিরও প্রয়োজন রয়েছে। যেহেতু রাজস্ব আহরণ সেভাবে কমার সম্ভাবনা নেই, তাই পরিস্থিতি ও প্রয়োজন বিবেচনায় এ দুই পণ্যের আমদানি প্রক্রিয়া সহজ ও শুল্কমুক্ত করা উচিত। এতে আমদানি করতে উৎসাহ পাবেন ব্যবসায়ীরা। সরবরাহ ঘাটতি কমে আসবে।

পেঁয়াজের বাজারদরেও দীর্ঘদিন ধরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। প্রতি বছর ছয়-সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। আমদানির অন্যতম উৎস ভারত সরকারের সর্বনিম্ন রফতানি মূল্য প্রতি টন ৫৫০ ডলার নির্ধারণ করে ৪০ শতাংশ রফতানি শুল্কারোপ করা হয়েছে। বিদ্যমান আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আইপি প্রয়োজন হয়। পেঁয়াজের দাম নিয়ে ক্রেতারা এমনিতেই ভোগান্তিতে আছেন। পণ্যটির দাম স্থিতিশীল করতে সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত আমদানির ব্যবস্থা করা সমীচীন। আর দেশে সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য চাল। বন্যায় আমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, চালের চাহিদা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে দাম। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। দেশে টানা দুই বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় আছে। পণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, সে তুলনায় বাড়েনি নির্দিষ্ট বেতনভুক্ত মানুষের আয়। ফলে ক্রয়ক্ষমতা কমেছে সাধারণ ভোক্তাদের। এ অবস্থায় নিত্যপণ্যের দাম না কমলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আয়বৈষম্য কমানো কঠিন হবে। সরকারের উচিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে আনা। এর জন্য প্রয়োজনে নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্কমুক্ত করতে হবে। দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে খোলাবাজারে বিক্রি বাড়াতে হবে। সর্বোপরি জরুরি হলো বাজারে নজরদারি জোরদার করা ও বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরানো।

অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পণ্য উৎপাদনে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি কৃষি মন্ত্রণালয়ের সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এ ছাড়া বাজারে পণ্য ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে যে সাপ্লাই চেইন রয়েছে এই পুরো সিস্টেমের সংস্কার করতে হবে। বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি সেদিকে নজর দেওয়া হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, অন্তর্বর্তী সরকারকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্যনিরাপত্তা হতে হবে সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার বিষয়। খোলাবাজারে সাশ্রয়ী দামে যে নিত্যপণ্য বিক্রি করা হচ্ছিল, তা বজায় রাখতে হবে। আর নিশ্চিত করতে হবে মাথাপিছু খাদ্যনিরাপত্তা। খাদ্য উৎপাদনের তথ্য এত দিন বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা হয়েছে। এগুলো ঠিক করতে হবে। আর ঠিক রাখতে হবে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা। প্রথমে দরকার বর্তমানের খাদ্য মজুত পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং আমন সংগ্রহ অভিযান কার্যকরের পরিকল্পনা গ্রহণ। কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে হবে। খাদ্য উৎপাদনের সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে হবে এবং ঘাটতি থাকলে আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বন্দরগুলোকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখা। তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভোক্তার কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করার দিকে মনযোগী হতে হবে। একই সাথে বিদ্যমান আইনের সংস্কার করতে হবে।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।