রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : বৈষম্যমূলক কোটা সংস্কারের দাবিতে পৃথক বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছে সাতক্ষীরা সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিটিউটের শিক্ষার্থী ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারিরা।

গত মঙ্গলবার সকালে সাতক্ষীরা শহরের সিটি কলেজ মোড় থেকে খুলনা রোডের মোড় পর্যন্ত সাতক্ষীরা সরকারি পলিটেকনিক কলেছের শিক্ষার্থীরা এবং বিকেল পৌনে চারটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাতক্ষীরা জেলা শাখার আয়োজনে শহরের নারকেলতলা মোড় থেকে খুলনা রোডের মোড় পর্যন্ত এক বিক্ষোভ মিছিল শেষে সড়ক অবরোধ করা হয়।

এদিকে আন্দোলনের নামে মুক্তিযুদ্ধ অবমাননাকারীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবিতে মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে সাতক্ষীরা শহরের শহীদ স.ম আলাউদ্দিন চত্ত্বর থেকে কালেক্টরেট চত্ত্বর পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল করেছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড। মিছিলটির নেতৃত্ব দেন সংগঠনের সদস্য সচিব সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ লায়লা পারভীন সেঁজুতি। পরে বিক্ষোভকারীরা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন। বিকেলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা খুলনা রোডের মোড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারিদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখালে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে সাতক্ষীরা সরকারি পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউটের শতাধিক শিক্ষার্থী মিছিল সহকারে বৈষম্যমূলক কোটা সংস্কারের দাবিতে শহরের খুলনা রোডের মোড়ে অবস্থান নেন। এ সময় তারা বিক্ষোভ মিছিল করে কোটা বাতিলের দাবিতে শ্লোগান দেন। সেখানে কিছুক্ষণ স্লোগান দেওয়ার পর পুলিশ তাদেরকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেয়।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, কোটা সংস্কারের যৌক্তিক দাবিতে আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছি। অথচ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। আমরা এই ন্যক্কারজনক হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। হামলায় আমাদের অনেক ভাই ও বোনেরা আহত হয়েছে৷ তাদের রক্ত ঝরেছে। এ ঘটনায় বিচারের দাবি জানাই।অবরোধের ফলে খুলনা রোড মোড়ের তিন রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।

অপরদিকে মঙ্গলবার দুপুরে ১২টার দিকে শহরের শহীদ স.ম আলাউদ্দিন চত্ত্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমা-ের বিক্ষোভ মিছিলটি লায়লা পারভিন সেঁজুতির নেতৃত্বে বের হয়ে কালেক্টরেট চত্বরে যেয়ে শেষ হয়। মিছিলে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন জেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক শিমুন সামস, সদস্য নাজমুন আসিফ মুন্নি, ছাত্রলীগের মেহেদী হাসান, সাতক্ষীরা সন্তান কমান্ডের মো: রিয়াজুল ইসলাম, এস এম পলাশ রহমান, গাজী আরেফিন, কালিগঞ্জের ফারুক হোসেন, সাইফুল ইসলাম, শ্যামনগরের মনিরুজ্জামান ডলার, রফিকুল ইসলাম বাবলু, মোস্তফা কামাল, তালার জাহিদুর রহমান লিটু, তৌহিদুর রহমান প্রমুখ। পরে তারা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর এক স্মারকলিপি পেশ করেন।

স্মারকলিপিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয় যে, কোটা আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে অপমান-অপদস্ত করছে। শুধু তাই নয়, গত ১৪ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা নিজেদের রাজাকার দাবি করার যে কুৎসিত বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছে, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক।

স্মারকলিপিতে আরো বলা হয়েছে, সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিলের যে দাবি আন্দোলনকারীরা তুলেছে, তা নিঃসন্দেহে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(৪) এবং ২৯ (৩) (ক) অনুচ্ছেদের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে কোটাপদ্ধতি বহাল থাকতে হবে। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রেই সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে নাগরিক নানা সুযোগপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কোটাপদ্ধতি চালু আছে। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে কোটা ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। সেখানে চার ধরনের নাগরিকদের জন্য মোট ৪৯.৫ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত।

স্মারকলিপিতে আরো বলা হয়েছে, নেপালের সংবিধানে দলিত, আদিবাসী, নারীসহ অন্যান্য নাগরিকদের জন্য ৫৫ শতাংশ সাধারণ কোটা এবং ৪৫ শতাংশ সংরক্ষিত কোটা চালু আছে। পাকিস্তানে সরকারি চাকুরিতে ৯২.৫ শতাংশ কোটা বিভিন্ন প্রদেশের জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ নীতির আওতায় কেবল শিক্ষালাভ বা সরকারি চাকরিতেই নয়, বেসরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানেও কৃষ্ণবর্ণ, হিস্পানিক জাতি ও আদিবাসীদের জন্য কোটাব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে।

স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, যে কোনো সভ্য রাষ্ট্রে নাগরিকদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতের জন্য কোটা ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। সেক্ষেত্রে কোন যুক্তিতে আন্দোলনকারীরা কোটাপদ্ধতি বাতিলের দাবি জানাচ্ছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যারা মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তরের বীর শহীদদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য দিচ্ছে, নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে স্লোগান দিচ্ছে, তারা রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ করছে।

এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সাতক্ষীরা জেলা শাখার আয়োজনে বৈষম্যমূলক কোটা সংস্কারের দাবিতে মঙ্গলবার বিকেলে সাতক্ষীরা শহরের নারকেলতলা মোড় থেকে খুলনা রোডের মোড় পর্যন্ত বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। খবর পেয়ে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা সেখানে আন্দোলনকারিদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়ায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হলে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

এ সময় সাতক্ষীরা জেলা ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ ইমরান হোসেনের নেতৃত্বে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স চুড়ান্ত বর্ষের ছাত্র কাজী আমিনুর আদনান, বায়ো টেকনলজি বিভাগেররাজুম মুনিরা, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসুদুর রহমান, রিফাত হোসেন, শান্তি ও সংঘর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আব্দুল আজিজ, সাতক্ষীরা পলিটেকনিক কলেজের ইতিহাস প্রথম বর্ষের খাদিজা পারভিন, সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের অর্থনীতি প্রথম বর্ষের রাকিব হোসেন, অর্থনীতি দ্বিতীয় বর্ষের মহসিন হোসেন, গণিত বিভাগের আহম্মদ শাহরিয়াজ, আহম্মদ হোসেন, রাজিবুল ইসলাম প্রমুখ কোটা সংস্কার নিয়ে স্লোগান দেয়।
এ সময় আন্দোলনকারিরা বলেন যে, কোটা বৈষম্য নিরসন করে জাতীয় সংসদে আইন পাশ করার জন্য জরুরী অধিবেশন আহবান করতে হবে। বিদ্যমান আন্দোলনে নেতা কর্মীদের উপর হামলার প্রতিবাদ ও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যাবতীয় মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।

(আরকে/এসপি/জুলাই ১৭, ২০২৪)