মারুফ হাসান ভূঞা


কোটা পদ্ধতি সংস্কারের আন্দোলনে সরকার প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছে। যা সরকার দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে মোটেও করতে পারেন না। সারাদেশে শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন আবার পুনরায় শুরু করেছে, সে আন্দোলনকে নানা কৌশল ও কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে সরকার বাঁধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। সরকার সাধারণ শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় আন্দোলন করেন। পরবর্তীতে সরকার প্রধান সংসদে কোটা প্রথা বাতিলের ঘোষণা দেন। এবং ওই বছরেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি চাকরিতে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে) সব ধরনের কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব ফয়েজ আহম্মদের সই করা প্রজ্ঞাপনে সকল সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত/আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চ তারিখের স্মারকে উল্লিখিত কোটা পদ্ধতি সংশোধন করিল। উক্ত প্রজ্ঞাপনে সংশোধনের ক্ষেত্রে ‘ক’ অংশে বলা হয়, নবম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং দশম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হইবে। ‘খ’ অংশে বলা হয়, নবম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং ১০-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা বাতিল করা হইলো। কিন্তু এই প্রজ্ঞাপনেও স্পষ্টত জটিলতা ছিল। পরবর্তীতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দীপংকর বিশ্বাসের সই করা ২০১৯ সালের ৩০ জুন স্পষ্টকরণ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এই প্রজ্ঞাপনের দুটি অংশের মধ্যে ‘ক’ অংশে বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি-১ শাখার ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর তারিখের স্মারক অনুযায়ী প্রথম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হইবে এবং উক্ত পদসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হইলো মর্মে পরিপত্র জারি করায় কোটা পদ্ধতি বিদ্যমান নেই।‘খ’ অংশে বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ৫ এপ্রিল ২০১৮ তারিখের জারিকৃত স্মারকের (খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ কোটার (মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, এতিম ও শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা সদস্য) কোনো পদ যোগ্য প্রার্থীর অভাবে পূরণ করা সম্ভব না হইলে অপূর্ণ পদসমূহ জেলার প্রাপ্যতা অনুযায়ী স্ব-স্ব জেলার সাধারণ প্রার্থীদের মধ্য হইতে মেধাতালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদের দ্বারা পূরণ করিতে হইবে।

তখন এই পরিপত্রে সম্পূর্ণ ত্রুটি ছিল, এবং সেটি জেনেশুনেই সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়। যাতে পরবর্তীতে আদালতকে ব্যবহার করে কোটা পদ্ধতির সংস্কার বন্ধ করে মুক্তি যোদ্ধা কোটাকে বৈধ করা যায়। ২০১৮ সালে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিল চান নাই, শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল কোটা পদ্ধতির সংস্কার। কিন্তু সেটিকে বাতিল করে সরকার শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়টিকে আদলতের নিকট ভিন্ন ভাবে উপস্থাপনের ভাষা তৈরি করে দিয়েছেন। সেটি খুব সূক্ষ্ম ভাবে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে সরকার করেছেন। সেটি জানবার আগে সাংবিধানিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত বা আধাস্বায়ত্বশাসিত চাকরি বা সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি আসলে কেন? এবং কারা এর সুবিধা ভোগ করতে পারেন সেটি আলোচনা করি। এই কোটা পদ্ধতি সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে চাকরি সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে সবার সুযোগের অধিকার সমান। শুধু নারী শিশু এবং সমাজে যারা অনগ্রসর শ্রেণি আছে তাদের জন্য রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা করতে পারবে। এটা বলা হয়েছে।

অর্থাৎ সমাজে পিছিয়ে পড়া বা অনগ্রসর জনগোষ্ঠী যাঁরা রয়েছেন, তাদের এই সুবিধার অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, নারী সহ অসংখ্য পিছিয়ে পড়া বা অনগ্রসর জনগোষ্ঠী রয়েছেন তাদের জন্য এই কোটা পদ্ধতির সুবিধা চালু করার বিধান রয়েছে সাংবিধানিক ভাবে। কিন্তু আদৌও কি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সে সুবিধা সম্পূর্ণ ভোগ করতে পারছে একদমই পারছেনা। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছাড়া অন্য কোনো কোটার সম্পূর্ণ সুবিধা অনগ্রসর জনগোষ্ঠী একদমই পাই না। নারী, প্রতিবন্ধী, পোষ্য কোটার সামান্য সুবিধা ভোগের চিত্র দেখতে পেলেও সেগুলোর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, এরপর আসুন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর কোটা যে কোটার সম্পূর্ণ অপব্যবহার করা হয়। এমন সরাসরি অপব্যবহার খুবই আশ্চর্য জনক ও বেদনা দায়ক।

উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য নামমাত্র যে ৫ শতাংশ কোটা চালু রয়েছে। যা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশার থেকেও একেবারে সংকীর্ণ। এই কোটার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে ব্যাপকভাবে। কারণ এই কোটার সুফল পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণভাবে পায় না। এর এক-তৃতীয়াংশ সুফল ভোগ করছে পাহাড়ে বসবাস করা সেটেলার বাঙালি। এই সেটেলার বাঙালিরা পাহাড়ের কোটা ব্যবস্থার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সরকারি সকল পরিষেবা ভোগ করছে। অর্থাৎ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য যে ক্ষুদ্র কোটাব্যবস্থা নামমাত্র ছিল সেটিও সম্পূর্ণ ভোগ করছে সেটেলার বাঙালি জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠী যারা রয়েছেন বিশেষ করে হরিজন সম্প্রদায়সহ দরিদ্র, হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা রয়েছেন তাদের জন্য কোন বিশেষ পদ্ধতি কোটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সেটি এখনো স্পষ্ট নয়।

তাহলে দৃশ্যমান হয় যে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী যারা রয়েছেন তারা সাংবিধানিক ভাবে কোটার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অধিকার বহন করলেও সেটি তারা নানা কোলা কৌশলে বঞ্চিত হচ্ছেন। কিন্তু মুক্তি যোদ্ধা কোটা, যে কোটার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে তো বটেই পাশাপাশি কোটা সংস্কারের আন্দোলনও এই কোটা বাতিলের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কেবল মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরুদ্ধে। সেটির যৌক্তিক কারণও রয়েছে। একদিকে মেধাবীদের বঞ্চিত করা, অন্যদিকে দলীয় রাজনৈতিক সুবিধা ভোগের ব্যবস্থা।

এই মুক্তিযোদ্ধা কোটা যখন চালু করা হয়েছে, তখনকার জন্য সেটি অবশ্যই যৌক্তিক ও যথাযথ ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের যে অবদান, সে অবদানের বিপরীতে এই কোটা ব্যবস্থা তখন পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু ৩০ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা অস্বাভাবিক, অস্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা হতে পারে না। পাশাপাশি এই কোটার আওতায় যারা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সেটি স্পষ্টত অপব্যবহার এবং সেটি সরকারের মদদে করা হচ্ছে। যা শুধু আশ্চর্যজনক নয়, ভয়ংকর একটি ব্যাপার। মুক্তি যোদ্ধাদের ছেলে-মেয়ে এবং ছেলে-মেয়ের ছেলে মেয়ে এই সুবিধা ভোগ করছেন। এটি কল্পনা করা যায়, রীতিমতো অবৈধ একটি পদ্ধতি। স্বাধীনতা ৫৩ বছরে এসেও এই কোটা পদ্ধতির প্রয়োজন কেন? আর যদি প্রয়োজনও হয়ে থাকে তাহলে সেটি অনগ্রসর জনগোষ্ঠী থেকে বৃহৎ শতাংশ বেশি কেন হবে? মূল বিষয়টি হচ্ছে সরকারি চাকরিতে দলীয় সুবিধা ভোগের সুযোগ তৈরির একটি পদ্ধতি। যা সম্পূর্ণ ভাবে শিক্ষার্থীরা বুঝতেও অনুধাবন করতে পেরেছেন ভালো ভাবে। এবং সরকারি সমস্ত নিয়োগ যদি পর্যালোচনা করা হয় তাহলে দৃশ্যমান হবে এই কোটা মূলত দলীয় সুবিধা সুযোগের জন্য তৈরি। এবং সেটিকে রক্ষা করার জন্যই সরকার মরিয়া হয়ে পড়েছেন। এবং সেটি ২০১৮ থেকেই সরকার পরিকল্পিত পদ্ধতিতে করেছেন। কারণ তখন শিক্ষার্থীরা দাবি জানিয়েছেলেন কোটা পদ্ধতির সংস্কারের কিন্তু সরকার কোটা পদ্ধতি সম্পূর্ণ বাতিল করেন। এবং সরকার সেটি মনোবৈজ্ঞানিক ভাবেই শিক্ষার্থীদের রুদ্ধ ও বাধাগ্রস্ত করার জন্যই করেন। যাতে শিক্ষার্থীদের দাবিকে বিতর্কিত ভাবে উপস্থাপনের ভাষা তৈরি হয়।

আদলতের নিকট শিক্ষার্থীদের ভাষাকে আগ্রাসী ভাষা হিসেবে উপস্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে পুনর্বহাল করা। সেটি সরকার সার্থক ভাবে পরিকল্পনা করেছেন। সুতরাং শিক্ষার্থীরা এখন যে বিশেষ কোটার পুনর্বহাল অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা কোটার পুনর্বহাল নিয়ে বিরোধিতা করছেন, সেটিকে সম্পূর্ণ কোটার বিরোধিতা হিসেবে বলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে আদলতের নিকট প্রশ্নবিদ্ধ করার পরিবেশ তৈরি করেছেন। সরকারের উচিত শিক্ষার্থীদের মূল দাবি কোটা সংস্কার। সেটিকে মেনে নিয়ে একটি কমিশন তৈরি করে। কেবল দেশের অনগ্রসর,ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা পদ্ধতি চালু করা। এর বাহিরে সমস্ত কোটা বাতিল করা। যদি সরকার এটি করতে ব্যর্থ হোন। তাহলে সরকার শিক্ষার্থীদের সাথে অন্যায় তো করেছেনেই পাশাপাশি দেশের সমস্ত মানুষের সাথে জুলুম করছেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।