রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : ফরিদপুরে মামলা চলাকালীন সময়ে ছুটির দিনে একটি জলমহাল থেকে ইজারাদারদের উচ্ছেদ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত শুক্রবার (৬ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে এ ঘটনা ঘটে ফরিদপুর সদরের চাঁদপুর ইউনিয়নের ‘ধোপাডাঙ্গা বাওড়’ নামের ওই জলমহালে।

এ উচ্ছেদ অভিযানে নেতৃত্ব দেন ফরিদপুর সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো.সম্রাট হোসেন। এই বাওড় নিয়ে আদালতে চলা মামলার তিনজন বিবাদীর মধ্যে তিনিও একজন।

এ উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে ইজারাদারের পক্ষের লোকজন এসিল্যান্ডকে তাদের কথা শোনা ও জলমহালের কাগজপত্র দেখে অভিযান শুরুর অনুরোধ করলে তখন এসল্যিান্ড বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কথাও এখন আমার শোনার সময় নাই।’

জেলা প্রশাসন ও ইজারাদার সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর সদরের চাঁদপুর ইউনিয়নের ধোপাডাঙ্গা মহল্লায় ৩৫ একর জমির একটি সরকারি বাওর রয়েছে। বাওরটি ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করেন জেলেরা। ২০২২ সালের ৮ জুন তিন বছর মেয়াদে এ বাওরটি ২ লাখ ২৫ হাজার ৫৮৯ টাকায় ইজারা নেন ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি গুরুপদ বিশ্বাস।

তবে ইজারা নেওয়ার ১৪ মাস পর ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে বাওরটি বুঝে পান তিনি। তিন বছরের ইজারা চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবছর ইজারার টাকা নবায়ন সাপেক্ষে এ ইজারার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৫ সালের ৭ জুন। তবে মেয়াদ শেষের অন্তত ১৬ মাস আগে এবং বাওরটি বুঝে পাওয়ার সাড়ে পাঁচ মাসের মাথায় গত ৩০ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার এক অফিস আদেশে ইজারার শর্ত লঙ্ঘন করার অভিযোগে জলমহালের ইজারা বাতিল করে দেন। পাশাপাশি ইজারা নেওয়ার সময় জমা রাখা জামানতের সব অর্থ বাজেয়াপ্ত করেন।

ইজারা বাতিলের এ আদেশের বিরুদ্ধে ইজারাদার গুরুপদ বিশ্বাস বাদী হয়ে গত ১৮ মার্চ ফরিদপুরের যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালতে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক, সদরের ইউএনও এবং সদরের এসিল্যান্ডকে বিবাদী করে একটি দেওয়ানী মামলা করেন।

গত ২৪ জুন এক আদেশে রায়ে যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালতের বিচারক মো. নাসির উদ্দিন ৩০ জানুয়ারি দেওয়া জেলা প্রশাসকের ইজারা বাতিলের আদেশের কার্যকরিতা স্থগিত করেন এবং ইজারার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত জলমহালটি অনত্র ইজারা দেওয়া যাবে না মর্মে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন।
আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক জজ কোর্টে আপিল করেন। গত ২ জুলাই জেলা জজ মো. আকবর আলী শেখ ২৪ জুন যুগ্ম জজ আদালতের দেওয়া আদেশের কার্যকরিতা পরবর্তি আদেশ না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেন।

এর দুইদিন পর গত ৪ জুলাই বিচারক আকবর আলীর আদেশ বাতিল চেয়ে ইজারাদার গুরুপদ বিশ্বাস জেলা জজ আদালতে আবেদন জানান। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা জজ আকবর আলী জেলা প্রশাসকের দায়ের করা আপীলের পূর্ণাঙ্গ শুনানির দিন আগামী ২১ জুলাই ধার্য করেন।

এরমধ্যেই জেলা প্রশাসক নতুন করে আরেক ব্যাক্তির কাছে বাওরটি ইজারাও দিয়ে দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২ জুলাই আগের আদেশ স্থগিতের সূত্র ধরে ফরিদপুরের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর দীপজন মিত্র তড়িঘড়ি করে ৩ জুলাই তিন কার্যদিবসের মধ্যে ওই জলমহালটি নতুন ইজারাদার ফরিদপুর সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের রণকাইল মাঝিপাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতিকে দখল প্রদানের জন্য আদেশ দেন।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, এ আদেশ পেয়ে ফরিদপুর সদরের এসিল্যান্ড মো. সম্রাট হোসেন গত ৫ জুলাই শুক্রবার বন্ধের দিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ধোপাডাঙ্গা বাওড়ে গিয়ে ইজারাদার গুরুপদ বিশ্বাসের লোকজনদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেন।

এ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার সময় ইজারাদার গুরুপদের পক্ষে ওই বাওরটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ওই এলাকার বাসিন্দা অরবিন্দু কুমার মালো (৪১) ও মো. সুলতান পায়েক (৬২)।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অরবিন্দু কুমার মালো বলেন, এসিল্যান্ড এসে আমাদের বাওড় ছেড়ে চলে যেতে বললে আমরা তার কাছে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে চাই ও কথা বলতে চাই। কিন্তু তিনি (এসিল্যান্ড) বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কথাও এখন আমার শোনার সময় নাই।’

মো. সুলতান পায়েক বলেন, এসিল্যান্ড তার সাথে নিয়ে আসা পুলিশ সদস্যদের দিয়ে আমাদের জোর করে ধরে এনে কাগজে সই করতে বাধ্য করেন। তার উপস্থিতিতেই নতুন ইজারাদারের লোকজন ওই বাওড়ে নেমে মাছ লুটপাট শুরু করে দেন।

ইজারাদার গুরুপদ বিশ্বাস বলেন, ওই বাওড়ে প্রায় বর্তমানে প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকার মাছ রয়েছে। এরমধ্যে সিংহভাগই পাঙ্গাস মাছ। এগুলোর একেকটার ওজন এখন সাতশো গ্রাম থেকে এক কেজি পর্যন্ত হয়েছে।

তিনি বলেন, বাওড় সংস্কার করে চাষের উপযোগী করা, মাছের পোনা ছাড়া, মাছের খাবার প্রদান করা, পাহাড়াদার নিয়োগসহ ইত্যাদি কাজে ধারদেনা করে অন্তত ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এ অবস্থায় এটি হাতছাড়া হয়ে গেলে তিনিসহ তার অধীনস্থ মাছ চাষিরা বিশাল ক্ষতির মুখে পড়বেন।

গতকাল (৬ জুলাই) শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ধোপাডাঙ্গা বাওড়ে গিয়ে দেখা, ৩৫ একর জমির উপর ওই বাওড়টি ইংরেজি ‘এস’ আকৃতির। এটির দৈর্ঘ্য আনুমানিক এক কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৩০০ মিটার। নতুন ইজারাদারের লোকজান ওই বাওড়ে জাগ দেওয়া পাটের উপর মাচা বানিয়ে বরশি দিয়ে মাছ ধরছেন।

মাছ শিকার করা মো. চুন্নু মাতুব্বর জানান, তারা নতুন ইজারাদার ও তাদের সমর্থকদের নির্দেশে তিনি মাছ ধরছেন।

মাছ ধরতে দেখা যায় ওই এলাকার বাসিন্দা সাব্বির মিয়াকে। তিনি জানান, গত শুক্রবার অনেকে এ বাওড়ে এসে মাছ ধরে নিয়ে গেছে সে খবর পেয়ে আজ তিনি মাছ ধরতে এসেছেন। তিনি বলেন, এক ঘন্টা ধরে তিনি মাছ ধরছেন। এর মধ্যে প্রায় এক কেজি সাইজের পাঁচটি পাঙ্গাস মাছ ধরতে পেরেছেন।

নতুন ইজারাদার রণকাইল মাঝিপাড়া মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি মন্টু কুমার সরকার বলেন, তিনি সরকারি নিয়ম মেনে এ জলাশয় ইজারা নিয়েছেন। মামলা চলমান থাকায় প্রশাসন তাকে সময়মত বওরটি বুঝিয়ে দিতে পারেনি।

মৎস্যজীবীদের দায়ের করা মামলার আইনজীবী মানিক মজুমদার বলেন, ‘এ মামলায় নিম্ন আদালত যে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সেটি জেলা জজ আদালত প্রাথমিক শুনানিতে স্থগিত করেছেন। আদালত নিষেধাজ্ঞা আদেশটি বাতিল করেনি। জেলা জজ আদালত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় মূলে মামলাটি পূর্ণাঙ্গ শুনানির জন্য চলতি মাসের ২১ তারিখ ধার্য করেছেন। ফলে চূড়ান্ত শুনানি ও পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত বিচারাধীন জায়গায় আংশিক রায়ে তড়িঘড়ি করে ইজারাদার উচ্ছেদ কিংবা নতুন ইজারাদারকে বুঝিয়ে দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। এটা করা হলে তা হবে ন্যায় বিচারের পরিপন্থী।’

জানতে চাইলে ফরিদপুর সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসিল্যান্ড মো. সম্রাট হোসেন বলেন, আরডিসির নির্দেশে তিনি শুক্রবার ঘটনাস্থলে গিয়ে বাওরটি নতুন ইজারাদার মন্টু কুমার সরকারকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, এ কাজ দ্রুত করার জন্য ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রামানন্দ পাল তাকে ফোনে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

এসিল্যান্ড বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কথাও এখন আমার শোনার সময় নাই’-এ জাতীয় কোন কথা তিনি বলেন নি। তিনি শুধু ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষের নির্দেশ পালন করেছেন । তিন কার্যদিবসের মধ্যে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলা হলেও তিনি কেন উচ্ছেদ ও দখলে বন্ধের দিন বেছে নিলেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসিল্যান্ড বলেন, শুক্রবার বা বন্ধের দিনে এ অভিযান আইন বিরুদ্ধ নয়।

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, জেলা জজ আদালত যুগ্ম জেলা জজ আদালতের আদেশ স্থগিত করেছেন। এ অবস্থায় নতুন ইজারাদারকে ওই বাওড় বুঝিয়ে দেওয়া আইন বহির্ভূত হয়নি। পাশাপাশি এ ব্যাপারে জিপির পরামর্শ নেওয়া হয়েছে।

বিবাদীর নেতৃত্বে বাদীকে উচ্ছেদ করা হয়েছে প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, পদের নামে মামলা হয়েছে। ওই মামলায় এসিল্যান্ড বিবাদী। তবে তিনি সেখানে গিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এবং উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা ও দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া এসিল্যান্ডের উপরই বর্তায়।

কার্যদিবসে উচ্ছেদ ও বুঝিয়ে না দিয়ে ছুটির দিন বেছে নেওয়ার বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, বর্তমানে এইচএসসি পরীক্ষা চলমান রয়েছে। কার্যদিবসে অনেক কাজে আমাদের ব্যস্ত থাকতে হয় এ জন্য ছুটির দিন এ অভিযান চালানো হয়েছে-এতে আইনের ব্যত্যয় ঘটেনি।

(আরআর/এসপি/জুলাই ০৮, ২০২৪)