শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : শষ্য ভাণ্ডারখ্যাত উত্তরাঞ্চলের জেলা দিনাজপুরে আবারও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে চালের বাজার। বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে প্রায় সব রকম চালে কেজি প্রতি বেড়েছে ৫ টাকা থেকে ৭ টাকা। পাইকারি বাজারে ৫০ কেজি'র বস্তায় বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। খাদ্য বিভাগ বলছে,চালের দাম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ মনিটরিং টিম কাজ করছে। খুচরা ব্যবসায়িদের অভিযোগ, মিল মালিকদের কারসাজির কারণে আবারো অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে চালের বাজার। তবে, মিল মালিকরা বলছেন,প্রকারভেদে ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে চালের দাম। অন্যদিকে কৃষকের অভিযোগ, আগে-ভাগে বিক্রি করে ফেলায় ধানের ন্যায্য দাম থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছেন। উঠেনি তাদের উৎপাদন খরচ।

সোমবার ( ৮ জুলাই) দুপুরে দিনাজপুরের সর্ববৃহৎ চালের আড়ত এন এ মার্কেট বাহাদুর বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রকারভেদে এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে প্রতিকেজিতে চালের দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৭ টাকা। আর বস্তাপ্রতি বেড়েছে ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা। চালের বাজারে ঊর্ধ্বগতিতে বিপাকে পড়েছে সাধারণ ক্রেতা-নিম্ন আয়ের মানুষ। ক্রেতারা বলছেন, বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তির দিকে। সেই সাথে চালের বাজারে উর্ধ্বগতি এজন্য বেশ বেকায়দায় পড়েছেন তারা।

পাঁচ কেজি চাল কিনতে আসা নির্মাণ শ্রমিক মোজাফফর হোসেন জানালেন, ‘আমাদের এখন বেঁচে কথাই দায় হইছে। পাঁচ দিন আগে যে চাউল কিনিছি, ৫২ টাকা কেজি,আইজ সেই চাউল ৫৮ টাকা কেজি। হামরা গরীব মানুষ বাঁচিমো ক্যামনে! শুধু চাউল নাহায়, তামাল জিনিসের দাম বাড়িছে। তরি-তরকারি তো কিনায় যায় না! যা কামাই করি, তা দিয়া চলাই মুশকিল। হামরাতো আর অফিসার নাহায়।যে ঘুষের টাকা আছে। যা রোজগার করি, তাই দিয়ে সওদা করি। পরিবার চালাই। সরকার এইলা দেখেনা কেনো ?'

স্কুল শিক্ষক তরিকুল ইসলাম জানালেন, তার বাড়িতে মেয়ের পরিবারের মেহেমান এসেছে। তাই বাড়ি থেকে ফোন করে বলেছে, ভালো চাল নেয়ার জন্য। তিনি মিনিকেট চাল নিয়েছেন চার কেজি। ৭০ টাকা কেজি নিয়েছে। অথচ কয়েকদিন আগে তিনি এ চাল কিনেছিলেন, ৬৩ টাকা কেজি দরে। কেজিতে তার ৭ টাজা বেশি লেগেছে আজ। এ নিয়ে তার খুবই মন খারাপ। কথাই বলতে চাইছিলেন না এই প্রতিবেদকের সাথে।

দিনাজপুরের সবচেয়ে বড় চাউলের আড়ত বাহাদুর বাজাররের চাল ব্যবসায়ী আশরাফ আলী জানালেন, 'এক সপ্তাহ আগে দিনাজপুরে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। গুটি স্বর্ণ গত সপ্তাহে ছিল ৪৫ টাকা কেজি, বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা। আঠাশ চাল ছিল ৫৫ টাকা কেজি,এখন তা ৬০ টাকা। ঊনত্রিশ চাল গত সপ্তাহে ছিল ৫২ টাকা কেজি, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকায়।বস্তাপ্রতি ৫০ কেজি চালের দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।
বাজারে চালের দাম বৃদ্ধির জন্য আমরাও সমস্যায় পড়েছি। মানুষের কাছে নানা কথা শুনতে হচ্ছে। কিন্তু আমরা করবো কি? আমরা মিল গেট থেকে যে দামে চাল কিনছি, সে দামেই বিক্রি করছি। মিল মালিকেরা কেনো দাম বাড়িয়েছেন এই কৌফিয়ত আর আমরা করতে পারিনা।'

চাল ব্যবসায়ি এরশাদ আলী জানালেন, 'মিল মালিকরা বলছে, ধানের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বেড়েছে চালের দাম। আমাদের কাছে, মিল মালিকরা এই বলে বস্তা প্রতি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেশি নিচ্ছে। বাধ্য হয়ে আমাদেরও দাম বাড়াতে হয়েছে। কিন্তু পাবলিক এইটা বুঝেনা। তারা আমাদের উপর দোষ চালিয়ে দিচ্ছে। মনে করছে, আমরাই বেশি দাম নিচ্ছি। এ নিয়ে গ্রাহকদের সাথে ঝুট-ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে।'

অন্যদিকেমিল মালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। বাংলাদেশ হাসকিং মিল মালিক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি দিনাজপুর চেম্বারের পরিচালক সহিদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন জানালেন, 'প্রকারভেদে ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে চালের দাম। এতে তাদের করার কিছুই নেই। মিল মালিকরা নিয়ম মাফিক যে ধান- চাল মজুত করার কথা- সেটাও অনেকে পারছেনাকিন্তু,অপ্রত্যাশিতভাবে অন্যকেউ ধান-চালের মজুত করছে । ধানের সংকট এবং বেশি দামে তাদের ধান কিনতে হচ্ছে। ধানের অভাবে অনেক মিলে উৎপাদনও বন্ধ হয়ে গেছে। ধানের বাজার কম হলে চালের দামও কমবে। চালের দাম নির্ভর করে ধানের দামের উপর।বিষয়টি খতিয়ে দেখে মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন।'

এদিকে ধান ও চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুদ্ধ দিনাজপুরের কৃষক। বলছেন, আগে-ভাগে বিক্রি করে ফেলায় ধানের ন্যায্য দাম থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছেন। উঠেনি তাদের উৎপাদন খরচ। অথচ,এখন ধান-চালের দাম বাড়েছে।

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার আদর্শ কৃষক মতিউর রহমান জানালেন, 'আমি দুইশত বস্তা ধান ১৬০০ টাকা বস্তা বিক্রি করেছি। ওই ধান এখন ২৩০০ থেকে ২৪০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ধান রোপন, পরিচর্যা এবং কাটা ও ঝাড়াই-মাড়াইয়ে যে টাকা খরচ হয়েছে।বিক্রি করে সেই মুল্য পাইনি। বরং লস হয়েছে। আর এখন কৃষকের কাছে ধান নাই,তাই ধানের দাম বেড়েছে। আসলে কৃষকের জন্য কেউ কিছুই করছেনা। আমরা কৃষক মরার আগেই মরে ভুত হয়ে যাচ্ছি!'

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুবীর নাথ চৌধুরী জানালেন, ‘দিনাজপুর জেলাতে অভ্যন্তরীণ বোরো সংগ্রহ' ২০২৪ অভিযান চলছে। কৃষকের কাছে ধান এবং তালিকাভুক্ত মিলারদের কাছে চাল ক্রয় করা হচ্ছে। ৭ মে শুরু হয়েছে এবং চলবে ৩১ আগষ্ট পর্যন্ত চলবে। সরকারের সংগ্রহ মুল্য প্রতিকেজি সিদ্ধ চাল ৪৫ টাকা, আতব চাল ৪৪ টাকা এবং ধান ৩২ টাকা কেজি ধরা হয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে সরকার দিনাজপুরের চালকল মালিকদের কাছ থেকে ১ লাখ ১৪ হাজার টন চাল এবং কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ১৭ হাজার টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। ধান-চাল সংগ্রহের পাশাপাশি চালের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং অব্যাহত আছে। কারসাজির মাধ্যমে কেউ যাতে চালের মূল্যবৃদ্ধি করতে না পারে সে জন্য এই বিশেষ টিম কাজ করছে।'

দিনাজপুর জেলায় প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়। এই অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে ৯ লাখ মেট্রিক টন চাল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। তারপরও ধান-চালের কৃত্রিম সংকট এজেলায়। এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি ও দোষিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমুলক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি ভোক্তাদের।

(এসএস/এসপি/জুলাই ০৮, ২০২৪)