রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে হিমাদ্রি ঘোষের জমি জবরদখল করে তাতে ঘরবাড়ি বানিয়েছেন জামায়াত নেতা খলিলুর রহমান। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ব্যাংদহা বাজার থেকে বুধহাটা সড়কের হাবাসপুর গ্রামের রুস্তুম আলীর বাড়ির পাশে এ ঘটনা ঘটে। জবরদখলে বাধা দেওয়ায় ওই হিন্দু পরিবারের সদস্যদের বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।

অভিযোগ, ৯৯৯ এ টেলিফোন, থানায় টেলিফোন ও লিখিত অভিযোগ করেও কোন পুলিশের সহায়তা পাওয়া যায়নি। দুপুর সোয়া একটায় ঘটনাস্থল থেকে এক সাংবাদিক টেলিফোন করায় থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশে দুপুর আড়াইটার নির্দেশে স্থানীয় ফাঁড়ি থেকে পুলিশ আসে।

সরেজমিনে আজ শুক্রবার দুপুরে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার হাবাসপুর গ্রামে গেলে হরেন্দ্রনাথ ঘোষের ছেলে হিমাদ্রি ঘোষ জানান, একই গ্রামের ইব্রাহীম সরদারের স্ত্রী ছায়রা খাতুন ২০০২ সালের ১৫ জুন ৫২০৯ নং রেজিষ্ট্রি কোবালা দলিল মূলে হাবাসপুর গ্রামের সুবোধ ঘোষের কাছ থেকে হালদাগ ১১৩৫, ১১৬৯ ও ১১৭১ দাগে ১৭ দশমিক ২২ একর জমি কেনেন। ওই জমি ওয়াজেদ সরদারের ছেলে খলিলুর রহমান ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ৭১৯৭ নং রেজিষ্ট্রি দলিল মূলে কেনেন।

হিমাদ্রি ঘোষ আরো জানান, ১২৩৫ দাগের ৩০ শতক জমি তার বাবার নামে বর্তমান মাঠপড়চায় রেকর্ড না হয়ে হারান ঘোষ ও তার শরীকসহ কৃষ্ণপদ ঘোষের নামে ভূলবশতঃ রেকর্ড হয়। বিষয়টি জানতে পেরে বাবা হরেন্দ্রনাথ ঘোষ বাদি হয়ে সদর সহকারির জজ আদালতে স্বত্ব প্রচারের মামলা (দেঃ- ২৬১/১২)করেন। বিবাদী কালিপদ ঘোষ, হারান ঘোষ, সুবোধ কুমার ঘোষ, দীপক কুমার ঘোষ বাদিপক্ষের অনুকুলে পশ্চিম দিক থেকে জমি উল্লেখ করে না দাবি দিলে ২০১২ সালের পহেলা নভেম্বর আপোষসূত্রে বাদিপক্ষের অনুকুলে সাড়ে ৫ শতক জমি ডিক্রীর আদেশ দেন। এরপর তারা ওই জমি নিজেদের নামে নামপত্তন করে বাংলা ১৪৩১ সাল পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করে শান্তিপূর্ণ ভোগদখলে আছেন।

হিমাদ্রি ঘোষ অভিযোগ করে বলেন, রাস্তার ধারে থাকা ১২৩৫ দাগের সাড়ে ৫ শতক জমি জবরদখলের জন্য চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি খলিলুর রহমান মাছ ধরার নেট দিয়ে ঘিরে রাখার চেষ্টা করেন। ওই জমি তার উল্লেখ করে ৯ জানুয়ারি তিনি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। এরপরও খলিলুর রহমান ও তার সহযোগীরা তাদের জমি জবরদখলের উদ্যোগ নিলে তার ভাই জয়ন্ত কুমার ঘোষ গত ৩০ জুন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে পিটিশন -১২৫৯/২৪ নং মামলা করেন। মামলায় খলিলসহ চারজনকে বিবাদী করা হয়। বিচারক বিষ্ণুপদ পাল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখা, ওই জমিতে কোন পক্ষই নির্মাণ কাজ করতে পারবেন না বলে নির্দেশ দিয়ে আগামি ১২ নভেম্বরের মধ্যে সদর সহকারি কমিশনারকে (ভূমি) দখল সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন। ২ জুলাই সদর থানার উপপরিদর্শক জ্যোর্তিময় উভয়পক্ষকে নোটিশ জারি করেন।

হাবাসপুর গ্রামের কালাচাঁদ সরদারের ছেলে নেছার আলী জানান, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দুটোর দিকে তার ঘুম ভেঙে গেলে কিছুক্ষণ পর তিনি হাতুড়ি দিয়ে আঘাতের শব্দ শুনতে পান। রাস্তার দিকে যেয়ে দেখেন ওয়াজেদ সরদার, তার ছেলে ২০১৩ -১৪ সালে নাশকতা মামলার আসামী খলিলুর রহমান, তার ভাই শফিকুল ইসলাম, হযরত আলী, বিল্লাল হোসেন, ময়েনুদ্দিন সরদারের ছেলে এসএম শাহীন আলম, কুলতিয়ার রজব আলীর ছেলে আব্দুস সাত্তার, ফারুক হোসেন, আব্দুস সবুর সহ ২০/২৫ জন হরেন্দ্র নাথ ঘোষের ছেলেদের জমিতে পাকা পিলার ও এসবেস্টার্স বসিয়ে পৃথক দুটি লম্বা ঘর নির্মাণ করে চলেছেন। শব্দ শুনে সেখানে চলে আসেন রুস্তুম সরদার ও ইসমাইল সরদারের মেয়ে সখিনা খাতুন, জয়ন্ত ঘোষ, হিমাদ্রী ঘোষসহ তাদের পরিবারের সদস্যরা।

জবরদখল করে ঘর নির্মাণে বাধা দেওয়ায় তাদেরকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। থানা পুলিশ ম্যানেজ করেই তারা ঘর বাঁধছেন বলে দাবি করেন খলিল। তাই পুলিশকে ফোন দিয়েও কোন কাজ হবে না বলে হাসতে থাকে খলিল ও তার তিন ভাই। ওয়াজেদ সরদারের ছেলে শফিকুলের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি সদর থানার ৫৯ নং গাছ কাটা ও নাশকতার মামলা রয়েছে। এ ছাড়া খলিল ও তার ভাইদের বিরুদ্ধে ২০১৩ -১৪ সালে তিনটি নাশকতার মামলা রয়েছে। জমি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে তাকেও খলিল বাহিনী বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমায় শান্ত করে ফেলেছে।

সখিনা খাতুন জানান, হিমাদ্রী ঘোষের জমি জবরদখলের নেতৃত্ব দেয় বহুল আলোচিতএসএম শাহীন আলম। শাহীন সেখানে ফজরের নামাজ পড়ে।

হিমাদ্রি ঘোষ অভিযোগ করে বলেন, তাদের জমি জবরদখল করে ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে এমন খবর ভোর সাড়ে ৫টায় জানানো হয় ৯৯৯ এ। সেখান থেকে থানায় কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হয়। থানায় ফোন দিলে কোন সদুত্তর না পাওয়ায় না তিনি সকালে থানায় যান। উপপরিদর্শক নাহিয়ান তাকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলাল তিনি তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে চলে আসেন। কিন্তু দুপুর সোয়া একটা পর্যন্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে আসেনি। একপর্যায়ে একজন সাংবাদিক ঘটনাস্থলে এলে তিনি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিদুল ইসলামকে ফোন দিলে স্থানীয় ব্রহ্মরাজপুর ফাঁড়ির পুলিশ দুপুর আড়াইটার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন। বৃহস্পতিবার রাত দুটো থেকে শুক্রবার সকাল ১০ টা পর্যন্ত খলিল বাহিনী ফিল্মি স্টাইলে যেভাবে ঘর নির্মাণ কাজ চালিয়েছে তাতে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে তিনি মনে করেন।

ফিংড়ি ইউনিয়ন সহকারি ভুমি কর্মকর্তা আকরাম হোসেন বলেন, চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি খলিলের দায়েরকৃত ১৪৫ ধারার মামলায় তদন্তে যেয়ে তপশীল বর্ণিত জমিতে দীর্ঘদিন ধরে হিমাদ্রি ঘোষের দখলে ছিল বলে তিনি জানতে পারেন। দু’এক দিনের মধ্যে যদি খলিল জবরদখল করে ওই জমিতে ঘর বাঁধে তাহলে সেটি আইনের পরিপন্থি।

হাবাসপুর গ্রামের খলিলুর রহমান জানান, তিনি তার কেনা জমি দখলে নিয়েছেন মাত্র। রাতে কেন দখল করলেন এমন প্রশ্নের জবাবে এড়িয়ে যেয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কৌশলগতভাবে একাজ করতে হয়েছে।

সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম শুক্রবার সোয়া ১ টায় বিষয়টি নিয়ে এ প্রতিবেদক অবহিত করলে তিনি এখনি পুলিশ পাঠাবেন বলে জানান। বিকেল তিনটার দিকে তিনি এ প্রতিবেদকে জানান যে, হিমাদ্রি ঘোষ থানার কার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন তা জানতে সন্ধ্যায় থানায় তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন।

(আরকে/এসপি/জুলাই ০৫, ২০২৪)