প্রিয় প্রজন্ম,
তোমরা আমার ভালোবাসা নিও। তোমরা ভালোভাবে লেখা-পড়া কর। মানুষের মত মানুষ হও। তোমরা দেশ প্রেমিক হও। দেশ প্রেমিক হওয়ার জন্য মাতৃভূমির জন্ম কথা তোমাদের জানা প্রয়োজন। দেশকে মায়ের মত ভালো বাসতে হবে। আমাদের এই জন্মভূমি বাংলাদেশের জন্ম ২৬ মার্চ’৭১। বাংলাদেশ হিসেবে জন্মের পূর্বে আমাদের এই ভূখন্ডের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান । তখন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে আমাদের দেশের নাম ছিল পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্ম থেকে শাসন করতো পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। তারা আমাদের সাথে বৈষম্য মূলক আচরণ করতো। চাকরি বাকরি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের বঞ্চিত করতো।

এই ছোট একটি চিঠিতে সব লেখা সম্ভব না। তোমরা সব বই পড়ে ও পাকিস্তানিদের শাসন দেখা ও মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখা বড়দের কাছ থেকে শুনে জেনে নিও। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচার ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রায় ১৪ বছর জেল খেটেছেন। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সাধারণ নির্বাচনে তদানীন্তন বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ টিতে বিজয়ী হয়েছিল। তখন পাকিস্তানের সামরিক শাসন চলছিল। সামরিক শাসন ছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী জেনারেল ইয়াহিয়া খান। বাঙালিদের বিজয়ে এই সামরিক শাসক সন্তুষ্ঠ ছিলেন না। তিনি ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। তখন ৩১৩ আসনের পাকিস্তান রাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ছিল। এই ৩১৩ টি আসনের ১৬৭ টির অধিকারী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের যোগ্যতা লাভ করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাঙালিদের হাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা দিতে নারাজ। সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ৩ মার্চ’৭১ প্রহসন মূলক ঢাকায় পাকিস্তানের সংসদ অধিবেশন আহবান করে ছিলেন। ১ মার্চ’৭১ তিনি সাধারণ অধিবেশন অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করলেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকলো। ২৫ মার্চ’৭১ পাকিস্তানের সামরিক শাসকের নির্দেশে রাত সাড়ে ১১ টার পর “অপারেশন সার্চ লাইট” নাম দিয়ে অতর্কিত বাঙালিদের উপর বিশ্বের জঘন্যতম জ্বালাও, পোড়াও, নির্যাতন, হত্যা ও গনহত্যা শুরু করলো। এক যোগে আক্রমণ করলো- পিলখানা ই.পি. আর আর সদর দপ্তর, রাজার বাগ পুলিশ লাইন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবাসিক ভবন, বিভিন্ন ছাত্রাবাস, শাখারী বাজার সহ ঢাকার বিভিন্ন গরুত্বপূর্ণ স্থান ও দেশের বিভিন্ন জেলা সদর ও অন্যান্য যায়গা। নিরুপায় হয়ে বাাঙালি ই.পি.আর পুলিশ, সামরিক বাহিনীর সদস্য ও অন্যান্য বাঙালিদেরা প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করলো। পরে জাতির পিতার নির্দেশে বাঙালিরা শুরু করলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধ হলো- পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের হতে হাত হতে বাংলাদেশ কে হানাদার মুক্ত করা। মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল ভয়াবহ। পাকিস্তানি পেশাদার আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও দূর্ধর্ষ। তাদের সাথে যুদ্ধ করে আমাদের বিজয় অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন ছিল।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার কোন ধরা বাধা নিয়ম ছিল না। ছাত্র শিক্ষক শ্রমিক নারী পুরুষ সেচ্ছায় যে যে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক সেই সেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারবেন। মুুক্তি যোদ্ধাদের কোন বেতন ভাতা ছিল না। ভারতে যে সকল মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে ছিলেন তাদের কে বাংলাদেশ সরকার মাসিক ৫০/- টাকা পকেট মানি ও ৬০/- টাকা রেশনিং এ্যালাউন্স হিসেবে দিতেন। সে টাকাও নিয়মিত পাওয়া যেতো না। কারণ টাকা দিত সেক্টর হেড কোয়ার্টার থেকে। সেক্টর হেড কোয়ার্টার ছিল ভারতে। আমরা থাকতাম বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রণাঙ্গণে। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার অর্থ ছিল সেচ্ছায় মৃত্যু পথে এগিয়ে যাওয়া। আমাদের রান্না বান্নার কোন হাড়ি পাতিল ছিল না। আমরা আজ এ বাড়ি কাল সে বাড়ি খেয়ে-ও আশ্রয় নিয়ে থাকতাম। তখন দেশের স্বল্প সংখ্যক স্বাধীনতা বিরোধীরা ছাড়া সবাই ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। তখন পরাশক্তি সম্পন্ন আমেরিকা ও চীন সহ বেশ কয়েকটি দেশ আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল।

পরাশক্তি সম্পন্ন ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ বেশ কয়েক টি দেশ আমাদের পক্ষে ছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েও আমাদের দেশের স্বাধীনতা ঠেকানোর জন্য কয়েক বার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হয়ে ছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কে ভারতে-পাকিস্তান যুদ্ধে রুপ দেওয়ার জন্য ৩ ডিসেম্বর’৭১ পাকিস্তান আকস্মিক ভাবে ভারতের কয়েকটি বিমান ঘাটিতে আক্রমন করে ছিল। পাকিস্তানের আক্রমনের কারণে ভারতীয় সৈণ্য আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যৌথ ভাবে যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর’৭১ পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্ম সমর্পন করতে বাধ্য করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনের কোন প্রকার নিশ্চয়তা ছিল না। প্রতিটি মুহুর্ত ছিল ঝূঁকি পূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অংশ গ্রহণ করে ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশেরই পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসররা বাড়ি ঘর পুড়িয়েছে। তাঁদের পরিবারের অনেক লোক জনকে হত্যা করেছে।

দেশ নয় মাসে স্বাধীন হবে এমন কোন নিশ্চয়তা ছিল না। তোমরা ইতিহাস পড়লে জানতে পারবে ভিয়েতনাম স্বাধীনতা অর্জন করতে প্রায় ২০ বছর যুদ্ধ করেছিল। মুক্তি যুদ্ধের যাঁরা অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের অধিকাংশ বাবা-মা, ভাই-বোনেরা বাড়িতে থাকতে পারেন নাই। অনেকেই বাড়িঘর সব ফেলে ভারতে শরণার্থী হয়েছিলেন। অথবা বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে অন্যত্র গোপনীয় ভাবে বসবাস করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন পণ মহান মুক্তিযুেদ্ধ গিয়েছিলেন। তারা দেশ প্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে গিয়ে ছিলেন। কোন ব্যক্তি স্বার্থের জন্য যুদ্ধে যান নাই। সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের ভালো বাসিও। তাদের সম্মান করিও। এখনও মুক্তিযুদ্ধ দেখা বয়স্ক জন বেঁচে আছেন। তাঁদের কাছ থেকে সব জানতে পারবে। আর কিছু দিন পর বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ দেখা বয়স্ক মানুষকে পাবেনা। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ দর্শীর স্বাক্ষী পাবে না। সবাই ভালো থাকো।


ইতি-
বীর মুুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল
গ্রামও ডাকঘর-রতন কান্দি,
উপজেলা-শাহজাদপুর,
জেলা-সিরাজগঞ্জ।