কানাইপুর বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি-সম্পাদকের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ
![](https://www.u71news.com/article_images/2024/06/29/IMG-20240628-WA0006.jpg)
রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : বেশ কিছুদিন যাবত সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে ফরিদপুরের কানাইপুর বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড এর বর্তমান সভাপতি হাবিবুর রহমান সাইফুল ও সম্পাদক মো. মোতালেব শেখ ওরফে মোতালেব মেম্বারের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সমিতি নিয়ম কানুন এর তোয়াক্কা না করে সমিতির টিন শেড মার্কেটটি তিন তলা বিল্ডিং করা হয়েছে। যেখানে স্বাক্ষর জালিয়াতি, এজিএম না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমিতির সাধারণ সদস্যদের মতামত না নেয়া, টেন্ডার না করে ভবন করা, ভবনটি নির্মাণে নিম্ন মানের নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার, সমিতি মার্কেট ভবনের ঘর ও ফ্লাট বিক্রি করে ইচ্ছেমত লুটপাট ও নথিপত্র জালিয়াতি করে সমিতির সাধারণ সদস্যদের বঞ্চিত করা, কয়েকজন মৃত সদস্যের নথি নিয়ে তাঁর নমিনিকে সদস্য পদ ফিরিয়ে না দেয়া ইত্যাদি বহু অভিযোগ এই কমিটির সভাপতি ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে। সমিতিটিতে ৫৮৬ জন সদস্য থাকলেও এই সমিতির সুবিধাভোগীর সংখ্যা খুবই কম। সমিতির সভাপতি সাইফুল-সম্পাদক মোতালেব মেম্বারের কমিটির মেয়াদ গত বছর ডিসেম্বরে শেষ হয়ে গেলেও সমিতির পরবর্তী এডহক কমিটি ও নির্বাচন কবে হবে সেটা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন অধিকাংশ সদস্য। ইতিপূর্বে সমিতির বর্তমান মেয়াদোত্তীর্ণ সভাপতি সাইফুল এবং সম্পাদক মোতালেব মেম্বার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অবিযোগে ৪৯ ধারায় লিখিত অভিযোগ দিলেও তা গত ১০ মাসেও আলোর মুখ দেখেনি। তদন্ত কর্মকর্তা মো. আমানুর রহমান দিবো দেই দিচ্ছি বলে সময় ক্ষেপণ করছেন। উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকেও ফরিদপুর সদর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা আমানুর রহমান ঈদের পরে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিবেন বলে দাবি করলেও, কোন ঈদের পরে দিবেন বা কত দিন লাগতে পারে সে বিষয়টি স্পষ্ট না করে তিনি তা এড়িয়ে যান।
এদিকে এই কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একটি এডহক কমিটি দিলেও তা সভাপতি-সম্পাদকের মনোপুত না হওয়ায় তাদেরকেও ১২০ দিনের মেয়াদোত্তীর্ণ করে দেয়া হয়েছে, কোন রকম দায়িত্ব দেয়া ছাড়াই। সমিতির সভাপতি সাইফুলের দাবি তিনিও নির্বাচন চান, তিনি আরেকটি এডহক কমিটি জমা দিয়েছেন, কিন্তু ফরিদপুর সমবায় অফিস থেকে সেটাও দিচ্ছে না। এটা ফরিদপুর সমবায় অফিসের গাফিলতি বলেও দাবি সাইফুলের।
সমিতির অনিয়ম ও দুর্নীতি'র অনুসন্ধানকালে উত্তরাধিকার ৭১ নিউজরে সাথে কথা হয় বেশ কিছু সদস্যের। তাঁরা কে কি বলেছেন, তার আলোকপাত করা যাক: কানাইপুর বহুমুখী সমবায় সমিতির সদস্য ও কানাইপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জুলফিকার আলী মিনু বলেছেন, 'এই মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি-সম্পাদক দীর্ঘদিন যাবত চেয়ার দখল করে বসে আছে, এরা সাধারণ সদস্যদের বঞ্চিত করে, নিজেদের মতো লুটপাট করে সমিতিটিকে একদম ধ্বংসের দায় প্রান্তে নিয়ে গেছে। কিছু সদস্য ছাড়া এই সমিতির অধিকাংশ সদস্য এই সমিতির কোন প্রকার সুযোগ সুবিধা পায় না'।
সমিতিটির আরেক সদস্য ও কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফকির মো. বেলায়েত হোসেন জানান, 'আমি দীর্ঘদিন যাবত উল্টাপাল্টা অনেক কিছুই শুনে আসছি। কোন কিছুতেই কর্ণপাত করি নাই, আর মাথা ঘামানোর সময়ও পাই নাই। এখন আমার দাবি দ্রুত এই মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বাতিল করে নতুন নিরপেক্ষ এডহক কমিটি দেয়া হোক। ওই এডহক কমিটি একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সমিতির প্রতিনিধি নির্বাচন করুক। নতুন কমিটি গঠিত হয়ে সুষ্ঠু স্বাভাবিক ও সততার সাথে এই ঐতিহ্যবাহী সমবায় সমিতিটির দায়িত্ব পালন করবেন বলে আশা করছি।’
সমিতিটির আরেক সদস্য ও কানাইপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম কামাল জানান, 'সমিতির বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক কোন আইন কানুন বা সমিতির সদস্যদের মতামতের কোন তোয়াক্কা করে না। তারা নিজেদের মতো লুটপাট করে খাচ্ছে।’
তিনি বলেন, 'আমি সমিতির সভাপতি সাইফুলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি এজিএম ছাড়া, কোন সদস্যের মতামত ছাড়া ও টেন্ডার না করে কিভাবে সমিতির তিন তলা ভবন করলেন? তিনি কোন সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। সমিতিটি একদম শেষ করে দিচ্ছে লুটপাট করে, সমিতির টাকা পয়সারও সঠিক হিসেব দেন না তারা।’
সমিতির অনিয়ম দুর্নীতি বিষয়ে সমিতির আরেক সদস্য মো. মোশাররফ হোসেন ওরফে মুসা মাস্টার জানান, ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী সমবায় সমিতিটি একদম লুটেপাট করে শেষ করে দিলো, সমিতিটিকে বাঁচাতে হবে। এই সমিতিটি যত আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে এই সমিতিটিতে অনেক সম্পদশালী হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আফসোস তা হয়নি।
সমিতির আরেক সদস্য ও কানাইপুর বাজার বনিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তুষার খান জানান, 'এই কানাইপুর বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড এমন একটি সমিতি - এই বনে যে যায় সেই হয় রাবণ। সমিতিটির গুটি কয়েক লোক ছাড়া আর কোন সদস্য কোন প্রকার সুবিধা পান না, যা দুঃখজনক।’
মো. নান্নু শেখ নামে আরেক সদস্য সমিতির তিন তলা ভবন নির্মানে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে দাবি করে সমিতির ৫১ ধারায় তদন্ত দাবি করেন বলেন, 'যারা সমিতির সদস্যদের টাকা লুটেপুটে খায় তাদের ৫১ ধারায় তদন্ত করে, শাস্তি দেওয়া উচিত।’
জাহিদুল শেখ নামের এক সদস্য সম্পাদক মোতালেব মেম্বারকে দুর্নীতির অন্যতম হোতা উল্লেখ করে তদন্ত সমিতির সভাপতি-সম্পাদকের বিচার দাবি করে বলেন, 'সমিতিকে বাঁচাতে ও সমিতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এবং সাধারণ সদস্যের অধিকার নিশ্চিত করতে সমিতির সভাপতি ও সম্পাদককে অবশ্যই জবাবদিহিতা ও আইনের আওতায় আনতে হবে।’
এদিকে সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোতালেব মেম্বার স্থানীয় বসুনরসিংহদিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও সমিতিটির সদস্য আব্দুল রহমান মুন্সীর মৃত্যুর পর, তার মেয়ে আসমা থেকে সমিতির কিছু কাগজপত্র নিয়ে আসেন, নমিনি মোসা. ছালমা বেগমকে সমিতির সদস্য পদ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। পরে মোতালেব প্রতারণা করে তার নাম বাদ দেন বলে ওই এক আবেদনপত্রে উল্পেখ করেন আসমা বেগম। সদস্য পদ ফিরে পেতে আসমা নেগম জেলা সমবায় কর্মকর্তা নিকট করা ওই আবেদন জমা দিয়েছিলেন ২০২৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। কিন্তু এখনও তার ওই সদস্য পদ ফিরে পাননি আসমা।
এসব যাবতীয় বিষয়ে উত্তরাধিকার ৭১ নিউজের সাথে একাধিকবার কথা হয় সমিতির সভাপতি হাবিবুর রহমান সাইফুলের। তিনি বিষয়টি রাজনৈতিক দাবি করে বলেন, ‘আমি সমিতির জন্য কাজ করেছি, আর কাজ করতে গেলে ছোটখাটো ভুল হতেই পারে। তিন তলার হিসাব আমি কার কাছে দিবো, এজিএম হয় নাই কারণ সমিতিতে গ্রুপিং আছে। তবে সময় হলে হিসেব বুঝিয়ে দেয়া হবে।’
যদিও উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে তিনি কোন হিসাব দেননি, দেখাতে চেয়েও তা দেখাননি। তিনিও এই সমিতির নির্বাচন চেয়ে উপজেলা ও জেলা সমাবায় অফিসের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলেও জানান সাইফুল।
তিনি আরও জানান, ‘আমরা যদি দুর্নীতি করি জেলা সমবায় অফিস তদন্ত করুক, আমি কারও কাছে হিসেব দিবোনা। এখন কারো কাছে দেওয়ার সুযোগও নেই, কারণ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সভা সেমিনার বা এজিএম করার সুযোগ নেই এই কমিটির।’
(আরআর/এসপি/জুন ২৯, ২০২৪)