আবদুল হামিদ মাহবুব


দাওয়াতে গিয়েছিলাম। সেটা আমার এলাকার বাইরে এক স্বজনের বাড়িতে। পরিচিত কয়েকজনকে পেয়ে শুরু হলো গল্পগুজব। আমাদের বলাবলি পৌঁছালো পুলিশের বিষয়ে। সকলেই সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের সম্পদের বিষয়টি নিয়ে বলতে বলতে দেশের চৌদ্দগোষ্ঠীও উদ্ধার করতে লাগলেন। কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেত্রী নেতা কারোই মু-ুপাত বাদ থাকলো না। বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু কন্যা, নাতি নাতনি সকলেই আমাদের কথার বানে ভেসে গেলেন। সাবেক রাষ্ট্রপতির বাড়িতে যাবার রাস্তাটা (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক) করে যে সিলেট বিভাগের মানুষকে বন্যা দুর্ভোগে ফেলা হয়েছে, এটাও আসোলো। তবে বেনজীরের সম্পদের বিষয়টাই যেনো বার বার ফিরে ফিরে আসছিলো।

আমি পুলিশ বাহিনীতে কি কি ঘটে সেসব বলতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতার একটি সত্য ঘটনা বর্ণনা করলাম। ঘটনাটি এমন; একবার কোরবানী ঈদের আগের রাতে খবর এলো, আমাদের জেলার এসপি’র বাসায় বড় বড় ছয়টি খাসি আনা হয়েছে। কি জন্য? কোরবানীর জন্য। আমি সাংবাদিক তাই, আমাকে এই খবরটি জানানো হয়েছে, আমি যেনো এটা নিয়ে নিউজ করি। একজন বড় কাপড়ের দোকানের মালিক আমাকে সংবাদটি দিয়েছিলেন।

নিউজ হলে উনার লাভ কি হতো? হ্যাঁ, নিশ্চয় লাভ হতো। নিউজের কারণে যদি এই এসপি বদলি হয়ে যান, তা হলে এসপি’র স্ত্রী প্রতি সাপ্তায় তার দোকান থেকে যে কাপড় আনেন, সেটা আর দিতে হবে না। কারণ এসপির স্ত্রীর আনা কাপড়ের কোনো মূল্য তিনি রাখতেন না। তখন আমি বাংলাবাজার পত্রিকার ব্যুরো প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। আমাদের এলাকায় বাংলাবাজার পত্রিকা সাড়ে সাত হাজার কপি চলতো। দুটি মাইক্রোবাস বোঝাই হয়ে প্রতিদিন ভোরে পত্রিকা আসতো। আমি ওই ব্যবসায়ীকে বললাম, নিউজ ছাপনোর আর সুযোগ নেই। ঈদের ছুটির জন্য পত্রিকা প্রকাশ কয়েকদিন বন্ধ থাকবে। আমার কথা শুনে তিনি হতাশ হলেন। তখনও ‘অনলাইন’ ভার্সনের যুগ আমাদের দেশে আসেনি।

তারপরও সদর থানায় কর্মরত থাকা আব্দুস সালাম নামের ওসি’কে ফোন দিলাম। সাংবাদিকতার সুবাদে তার সাথে ভালো পরিচয় ছিলো। ওসি সালাম আমাকে বললেন, যা জেনেছেন তা সত্য। জেলার ছয় থানা থেকে খাসিগুলো স্যারের জন্য পাঠানো হয়েছে! না পাঠালে এসপি’র বিরাগভাজন হতে হবে। তাই ওসি’রা বাজারের সেরা খাসিগুলো সংগ্রহ করে পাঠিয়েছেন।

প্রসঙ্গক্রমে আমি আরেকটি ঘটনা বললাম, আমাদের জেলায় একসময় পুলিশের প্রধান কর্তা হয়ে রওশন আরা নামের একজন আসলেন। একজন মহিলা এমন পদে আসাটা আমাদের জন্য প্রথম ঘটনা। আমরা আশা করলাম তিনি তার পূর্বসূরি পুরুষ কর্মকর্তার মতো ঘুষখোর হবেন না। কিন্তু আশার গুড়ে বালি পড়তে বেশিদিন লাগলো না। বছর খানেকের মধ্যে তিনি রিসোর্ট বানানোর জন্য শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ি এলাকায় বিশাল ভূমি তাঁর নামে রেজিষ্ট্রী করলেন। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, তিনি যা বেতন পান, সে টাকায় এই ভূমি কিনেননি। কিনেছেন অন্য পথে আসা টাকা দিয়ে।

আমাদের মধ্যের এজন বললেন, ‘আমরা এখন কেবল বেনজীর বেনজীর করছি। বাহিনীগুলোতে কত যে বেনজীর কত কত সম্পদ বানিয়ে রেখেছে, সেটা কি কেউ খতিয়ে দেখবে?’ সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের অর্জিত সম্পদের বৈধতা অবৈধতা নিয়ে দুদক তদন্ত করছে। নিশ্চয় এটা দেশপ্রেমিক মানুষের জন্য সুখবর। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এবিষয়ে নেতিবাচক কিছু বলা ঠিক হবে না। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ হিসাবে তাই আমাদের কারোই এই বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তারপরও কেউ কেউ সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামানের বিষয় আলোচনায় আনলেন।

আমি বলি, কেবল কি বেনজীর আর আছাদুজ্জামানের সম্পদের তদন্ত করলেই পুলিশ বাহিনী পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে? তার মতো কত কতজন পুলিশ বাহিনীতে আছেন? আছেন অন্য বাহিনীগুলিতে? সবার খবর কি আমাদের সাংবাদিকরা তুলে আনেন? এখনকার সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশন মালিকদের যার সাথে স্বার্থ সংঘাত হয়, কেবল তাদের সংবাদই গণমাধ্যমে আসে। গণমাধ্যম নিয়ে আমার একটি লেখা আছে। গুগলে ‘গণমাধ্যম সাংবাদিকতা আমার কথা’ লিখে সার্চ দিলেই লেখাটি পাওয়া যায়।বেনজীরের আগের যিনি আইজিপি ছিলেন, তদন্ত করলে কি তার কিছু বের হবে না?

তারও আগে যিনি আইজিপি ছিলেন, তিনি একসময় আমাদের জেলায় কর্মরত থাকার কারণে তাকে কাছে থেকে আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। সেইসময় তিনি অনেক প্রবাসী হুন্ডি ব্যবসায়ীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে ছিলেন। তাদের সাথে অনেকবার বিদেশে সফর করেছেন। পুলিশ প্রধান হবার পরও তিনি ওইসব প্রবাসী ও ব্যবসায়ীদের সাথে নিয়ে বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। তারও অঢেল সম্পদ হয়েছে। শোনা যায় দেশের বাইরে তিনি সম্পদের মালিক হয়েছেন। ছেলেকে বিদেশে বাড়িও কিনে দিয়েছেন। আমাদের এখানে তার এক ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন। সেই সুবাদে তিনি তার বিয়াই, ছেলের শ্বশুরকেও সম্পদের মালিক বানিয়েছেন।

তার বিয়াইতো আমাদের এখানকার সেবামূলক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় চার কোটি টাকা মূল্যের ষাট শতক ভূমি জোর করে দখলে নিয়ে অন্য একজনকে দিয়েছেন। দখল করার সময় তিনি পুলিশ প্রধান ছিলেন। সেকারণে স্থানীয় পুলিশ রাতদিন পাহারা দিয়ে তার বিয়াইয়ের দখল প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করেছে। ওই প্রতিষ্ঠান তৎকালীন এসপিকে বিষয়টি জানিয়ে ছিলেন, এসপি তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। তদন্ত করলে সাবেক সেই আইজিপি’রও অনেক কিছু বেরোবে। দুদক কি তদন্ত করবে?

আমাদের পাশের টেবিলে বসে আমাদের সকল কথা শুনেছে একটি ছেলে। সে আমাদের দিকে চেয়ে আছে এবং কথা শুনছে দেখে আমি তার পরিচয় চাইলাম। সে তার নামসহ পরিচয় দিয়ে বললো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে অনার্স শেষ করেছে। এখন সে বিসিএস দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তার কোন চাকুরিতে আগ্রহ? সে বললো, বিসিএস-এ তার ফাস্ট চয়েজে ‘পুলিশ বাহিনী’ রাখবে। কেনো এটা ফাস্ট চয়েজে রাখতে চায়? সে জানায়, তার বাবা এই বাহিনীতে চাকুরি করেছেন। সে পুলিশ পরিবারের সন্তান। ছোট থাকতে তার বাবা মারা যান। পুলিশের পোষাক পরা বাবার বাধাঁই করা ছবি দেখে দেখে সে বড় হয়েছে। ছোটবেলা থেকে তার স্বপ্ন বড় হয়ে সে বাবার মতো পুলিশই হবে।

ছেলেটির এই স্বপ্ন দেখাটা দোষের কিছু না। তবে তার পাশে বসে থাকা মা ও অন্যান্য স্বজনরা শংকায়, পুলিশে গেলে এই ছেলেটি নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ তার বাবা যখন পুলিশে ছিলেন তখনও সাধারণ মানুষের কাছে এই বাহিনীর সুনাম বলুন আর ভাবমূর্তি বলুন, মোটামুটি ছিলো।

কিন্ত এখন? পুলিশের ভাবমূর্তি বলতে বিন্দুমাত্র নেই। প্রকাশ্যে মানুষ বলছে না। কেনো বলছে না? হয়রানীতে পড়ার ভয়ে। পুলিশ কারণে অকারণে যাকে তাকে হয়রানী করে, এটা আমাদের সকলেই জানা। পুলিশ সম্পর্কে একটা কথা চালু আছে, ‘আকাশের যত তারা পুলিশের তত ধারা।’ যাকে তাকে যে কেনো ধারায় হয়রানী করার ক্ষমতা একমাত্র পুলিশেরই আছে। এদেশের পুলিশ সেটা করেও। কেনো করে? হয়রানী করলে যে টাকা পয়সা আদায় করা যায়।

ছেলেটিও স্বীকার করলো আমরা যেসব আলোচনা করছি সবই ঠিক। যদি ঠিক বলে মানো, তবে কেনো তুমি এই বাহিনীতেই যেতে চাও? তুমিও কি পুলিশ বাহিনীতে গিয়ে অবৈধ পথে টাকা কামাতে চাও? সে বললো, না। আমি সুনাম ফিরিয়ে আনার জন্য আমার বাবার বাহিনী পুলিশে যোগ দিতে চাই। আমি উঠে গিয়ে ছেলেটির পিঠে হাত বুলিয়ে বললাম, সাব্বাশ। তোমাদের মতো তরুণরাইতো আধাঁরে আলোর দিশারী হবে। তোমরাই পারবে এই দেশকে ঠিক পথে আনতে।

আমরা যারা এতোক্ষণ দেশ নিয়ে নেতিবাচক কথা বলছিলাম, সকলেই যেনো ছেলেটির দৃঢ়তার সাথে বলা ‘সুনাম ফিরিয়ে আনার জন্য আমার বাবার বাহিনী পুলিশে যোগ দিতে চাই’ এই কথা শুনে আশার আলো দেখলেন। আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গ দ্রুত পাল্টে গেলো। আলোচনায় পদ্মা সেতু, মেট্টোরেল, কর্ণফুলী ট্যানেলওসহ দেশের অনেক উন্নয়ন অগ্রগতির বিষয়গুলো চলে আসলো।

এই লেখাটা শেষ করি এইটুকু বলে যে, আমরা বুড়োরা অনেক কারণেই ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে হতাশ হয়ে আছি। আমাদের চিন্তায় কেবল নেতিবাচক বিষয়গুলো বেশি আসে। কিন্তু আমাদের সন্তানরা উদ্যমী। দেশকে তারা ভালোবাসে। যারা দেশটা পরিচালনা করছেন, সেই রাজনীতিবিদদের বলি, আপনারা আমাদের তরুণদের পরিবেশটা করে দেন। অসুস্থ পরিবেশটাকে সুস্থ করে তুলুন। মরলে পকেটবিহীন সাদা কাপড় আর সাড়ে তিন হাত মাটির বেশি কেউ পাবেন না। এতো টাকা ধন দৌলত দিয়ে কি করবেন? এই তরুণদের দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করার সুযোগ দেন। আমাদের তরুণরাই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়বে, অবশ্যই গড়বে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার, সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব।