পীযূষ সিকদার


নাট্যকেন্দ্রের নাটক ‘পুণ্যাহ’। নাটকটির ৩০তম মঞ্চায়ন হয়ে গেলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল হল ৭ জুন শুক্রবার সন্ধ্যা ৭.১৫ মিনিটে। অর্কের হাত, মাথা ছুয়েছিলো বলে নাটকটির শুরু থেকে শেষ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। ইউসুফ হাসান অর্ক আমার অনুজ। অনুজ হলেও শিল্প সাধনায় আমার অগ্রজ। ইউসুফ হাসান অর্কর কথা বলতে গেলে কত কথাই মনের ভিতরে গুমরিয়া ফেরে!

‘পুণ্যাহ’ নাটকটি লিখেছেন বদরুজ্জামান আলমগীর। সে অনেক আগেই জেনেছিলাম বদরুজ্জামান আলমগীরকে। সৃষ্টির আনন্দে আনন্দে সে কেবলি নাচে। বদরুজ্জামান আলমগীর ও ড. অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্ক একই সুতার মালা। কেউ কখনো কাউকেই ছাড়িয়ে যাননি। ছাড়িয়ে যাননি বলে ‘পুণ্যাহ’ একটি ঢাকার মঞ্চে আলোচিত নাম। সংলাপ, কথকতায়, বর্ণনায় ও সংগীতে সংগীতে নাটকটি পূর্ণতা পায়। অর্কের কাজে একটি গধমরপ আছে। ‘পুণ্যাহ’ নাটকে সেই গধমরপ দেখলাম। ইউসুফ হাসান অর্কের হাতের ছোঁয়ায় পাÐুলিপি পূর্ণতা পায় সুষম চলনে বলনে।

বাংলা নাটকের বিশেষ ধর্ম সংগীত ধর্মিতা। অর্ক শুধু একজন নির্দেশক নন। তিনি নিজেই গীতিকার, সুরকার ও অভিনেতা। নাটকের কাহিনী এগিয়ে চলে অভিনয়ে অভিনয়ে সুরে সুরে কখনো দেহ ভাষা পায়। আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না নাটকের মর্মবাণী।

পুণ্যাহ নাটকটির মধ্যে মাদকতা আছে। আছে অভিনয়। আছে গান। আছে পাপ-পূণ্যের হিসাব। সুখ-দুঃখকে কী শেষ পর্যন্ত জয় করতে পেরেছিলো আম্বিয়া। প্রথম থেকেই আমার আম্বিয়ার জন্য কষ্ট হয়। নাটকটি দেখেছি কেঁদেছি। কখনো হাসিতে হাসিতে ফেটে পড়েছি।

‘পুণ্যাহ’ নাটকটি অনেক আগের লেখা। এর জন্য নির্দেশককে অনেক কষ্ট করে সমকালীন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মঞ্চে সৃজন করলো আরেক পুন্যাহ। বহু গ্রামের মধ্যে একটি গ্রাম কাকরগাছি। এই গ্রামকে ঘিরে নাটকের অগ্রযাত্রা। এই গ্রামের সবকিছু চলছিলো ঠিকঠাক। কিন্তু তৈয়ব-আম্বিয়ার প্রেম। মৌলবী খায়রুল বাশারের ৩২ বছরের ইমামতি জীবন। বটকৃষ্ণ কবিরাজ ভালোইতো চলছিলো কাকরগাছি গ্রাম। সাধারণ মানুষের মধ্যে সুখও ছিলো দুঃখও ছিলো। দুঃখকে জয় করবার বাসনাও ছিলো! এমনকী ঘটে গেলো সে কাকরগাছি গ্রামে। নির্দেশক বারবার খুঁজবার চেষ্টা করেছেন। পাপ কী পূণ্য কী! সুখ কী দুঃখ কী! যদিও আমি বহুদিন পাপ কী পূণ্য কী খুঁজবার চেষ্টা করলাম। পাওয়াটা কী পূণ্যি! ভালোবাসার মধ্যে কী পূণ্যি নাই। একটি অকাল ঝড় এসে কাকরগাছি গ্রাম লন্ড-ভন্ড করে দিলো। মানুষের চাওয়া পাওয়ার হিসেব গোজামিল হয়ে গেলো। ঝাকরগাদি গ্রাম মৃত্যুপুরীতে পরিণত হলো। খালি লাশ আর লাশ। যারা বেঁচে ছিলো তারাতো বাঁচলোই। এখন কাকরগাছিতে শুধু শোক আর শোক। মৌলভী খায়রুল বাসার এই ঝড়ের ক্ষতির জন্য পাপ খুঁজতে থাকেন। বটকৃষ্ণ কবিরাজ কম যান না। ভালোবাসা গুনা। কবিরাজ মশাইও তাই বললো। এই জটলার মধ্যে বহু চরিত্রের আগমন ঘটে। নানা দেহ ভঙ্গিমায়।

গান ছাড়া বাংলা নাটক হয় না। তা জানা যায় গীতি কবিদের রচনা থেকে। আসলেই প্রযোজনাটি দেখে মনে হলো গীতিবাদ্য বাদ দিয়ে বাংলা নাটক হয় না। তাইতো ড. অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্ক অভিনয়ে অভিনয়ে গান বাঁধছেন। সেই গানই ‘পুণ্যাহ’ নাটকটি সুন্দর হয়ে উঠলো।

আমি আম্বিয়ার জন্য কাঁদি। এখনো কাঁদি। ভালোবেসে সে তৈয়বকে বেঁধেছিলো। জানতে পারি এক সময় আমিয়ার পেটে বাচ্চা। পেটে হাত দিয়ে আম্বিয়া হাসে। তৈয়ব, চলো আমরা ঢাকা চলে যাই। তৈয়ব অস্বীকার করে। তাহলে কী আম্বিয়ার পাপি! পাপ পূণ্যের যাতাকলে চলে জীবন। পাপ-পূণ্যের হিসেব মেলে না। পাপ আর পাপী অনুসন্ধান চলে নিয়ত। মৌলভী খায়রুল বাশার এ দুর্যোগ মনে নিতে পারে না। গজব পড়েছে গজব। আম্বিয়া কী তৈয়বকে ভালোবেসে ভুল করেছে! হ্যাঁ, ভুল। সে ভুলের মাসুল তাকে গুনতে হচ্ছে। আম্বিয়ার পেটে তৈয়বের বাচ্চা। খায়রুল বাশার পাপ খোঁজে পাপীর মধ্যে! তাহলে কে পাপী? পুরুষরা বরাবরই পাপ খোঁজে নারীর মধ্যে! কিন্তু তৈয়বের পাপ সমাজ দেখে না। সমাজের চোখ আছে। এ সমাজ আন্ধা কানা। তৈয়বের বাচ্চা আম্বিয়ার পেটেই তৈয়ব অন্যসব পুরুষের মতো শেষ পর্যন্ত নারীর দিকে অঙ্গুলি ইশারা করে। বিচার কার বিচার! শেষ পর্যন্ত পাপীকে খুঁজে বের করে মৌলভী খায়রুল বাশার। বটকৃষ্ণ মহারাজ কমে ছাড়ে না।

চমৎকার একটি দৃশ্য সৃজন করেন ইউসুফ হাসান অর্ক। আম্বিয়াকে যখন তৈয়ব অস্বীকার করে। আমি চোখের জলে ভাসি। ঔষধ খেয়ে আম্বিয়ার বাচ্চা রক্ত ও লালার স্রোতে বেরিয়ে আসে। আম্বিয়ার দেখে তৈয়বের মতো দেখতে রক্ত ও লালার স্রোতে সে দেখে তৈয়বকে। আম্বিয়া শেষ আশ্রয় চেয়েছিলো তৈয়বের কাছে। তৈয়ব কী আশ্রয় দিয়েছিলো আম্বিয়াকে! না পুরুষরা এমনই। আমরা সব ধোয়া তুলসি পাতা। আম্বিয়া হয় পাপী। এই পাপীর জন্য এই তো কাকরগাছি গ্রামে ঝড় হয়েছিলো। গ্রাম যেনো মৃত্যুপুরী। আম্বিয়ার পাপে কাকরগাছিতে রক্ত বন্যা বয়ে গেলো। মৌলভী খায়রুল বাশার পাপী খুঁজে পায়। তৈয়ব নয় আম্বিয়াই পাপী। আম্বিয়াকে পাথর ছুড়ে মারা হয়। মৃত্যুকে নিয়ে আম্বিয়া বেঁচে থাকে। এতো বাঁচা নয়। আম্বিয়া হাহাকারে হাহাকারে তৈয়বই রক্ত লালার ¯্রােতে মাটি রক্তাক্ত হয়।

ড. অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্কের হাতে যে গীতল নাটকটি উপহার পেলাম তা বাংলা নাটকের মূল থেকে শাখা প্রশাখা বিস্তার করে। নাটকে আমরা তো শেকড় সন্ধানী। তাঁর হাতে সেই শেকড়ের যে আলোড়নে আমরা দুলে উঠি। কখনো নাচি। কখনো কাঁদি। কখনো হাসি।

গান যে বাংলা নাটকের প্রাণ। সেই গানকেই দেহভাষে ফুটিয়ে তুলেছেন অর্ক। ‘পুণ্যাহ’ নাটকটি বাংলা নাটকে স্থান করে নেবে। এ আমার দৃঢ় বিশ^াস।

অভিনেতা অভিনেত্রীরা তাদের কথনে, গানে, দেহভাষ্যে দারুন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নাটকটি। ইউসুফ হাসান অর্কের হাতে গানও অভিনয় হয়ে ওঠে। বোঝা যায় অর্কের গীতল ভাষাটি। প্রতিটি অভিনেতা অভিনেত্রী কী সংলাপে কী অভিনয়ে কী বচনে কী কথায় দারুন অভিনয় করেছেন। ইউসুফ হাসান অর্ক তো বাজিকর। তাইতো পুতুলি নাচে। গান গায়। কথায় কথায় গানে গানে একটি অপূর্ব সৃজন নাট্য।

কাকরগাছি গ্রাম। একটি ঝড়। সব লন্ড ভন্ড হয়ে যায়। যারা বেঁচে ছিলো তারা মুখোমুখি হয়। পাপ অথবা পূণ্যের। তারা খুঁজে পায় কী পাপ কিংবা পাপী?

বলেছি আগেও, নাটকটি রচনা করেছেন বদরুজ্জামান আলমগীর। নাটক সম্বন্ধে বলতে যেয়ে নাট্যকার বলছেন, ‘মনে হয়, ওখানে আমি নেই, ঘটনাগুলো ঘটছে নিজের গরজে, আমি তার অংশ নই- অনুষঙ্গগুলো নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিতের অধীন। কিন্তু কার্যত আমরা আছি ওখানে- কেন্দ্রে আছি।

সহজ কথা সহজ হিসেব। তারপরও সহজ নয়। আম্বিয়া কী তৈয়বকে ভালোবেসেছিলো। নাকি আম্বিয়া না বুঝে আগুনে ঝাপ দিয়েছিলো। শরীরী ওম শেষ পর্যন্ত পুরুষকে ছোঁয় না নারীকে ছোঁয়। পুরুষ কী কালে কালে ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়ে যাবে। আম্বিয়া হবে পাপী অথবা যখন করবে পাপ। পুরুষ এতোসব ভাবে না। তাইতো প্রথম পাথরটি আম্বিয়ার গায়ে ছুঁড়েছিলো তৈয়ব। আমার কাছে আম্বিয়া শীতলা মা। সর্বস্ব দিয়ে তৈয়বকে ভালোবসেছিলো। সেই পুরোন কথা নতুন করে বলবার সময় এসেছে।

‘পুণ্যাহ’ নাটকে নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক বলছেন অথবা বয়ান করছেন, “সাম্প্রতিক পৃথিবীর যে বিপর্যকাল, তা আমাদেরকে এমন কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করেছিলো। সেই দায় তেখেই ‘পুণ্যাহ’ নিয়ে কাজ করার তাগিদ অনুভব করেছি আমরা। একটি বিধ্বস্থ জনপদ এখানে প্রেক্ষাপট মাত্র। তারই বিবৃতিমূলক কাহিনী বয়ানে নাটককার যেমন তার চরিত্র-চিত্রন, দ্বানিদ্বকতা ইত্যাদির নানা উদ্ভাস রচনা করেছেন, আমরাও তেমনি একটি সহজ প্রতিভঙ্গিতে নিরাভরণ ক্যানভাসে পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-ভুল ইত্যাদি ধারণা সম্পর্কে আমাদের দরদিয়া অভিব্যক্তি নির্মাণ করবার প্রয়াস পেয়েছি।

ইউসুফ হাসান অর্ক আমার কাছে আরাধ্য দেব। তাকে নিয়ে অথবা তাঁর সৃষ্টি নিয়ে নতুন করে বলার থাকে না। আমার মতো দীনহীন লেখকের সাধ্য কী তার সৃষ্টি নিয়ে লিখবার! তবুও ভক্তের কিছু দায় থাকে কলম কালিতে লিখবার। আজকে প্রথম যখন দেখি তখনই আমার ভালোবাসা তৈরি হয়েছিলো। ৩০ বছর পর ওর নাটক নিয়ে যখন লিখতে বসেছি সেই ভালোবাসা একটুও কমেনি। বরং বেড়েছে।

‘পুণ্যাহ’ নাটকটি ১ ঘন্টা ৪১ মিনিট। শুরু থেকে শেষ অবধি নাটকটি দেখেছি। কাহিনী বলবার এক অসাধারণ রীতি ইউসুফ হাসান অর্ক আবিষ্কার করেছেন। আবিষ্কারই বলবো। এর আগে এরকম নাটক দেখিনি। বাংলা নাটক যখন মুক্তির কথা বলছে, তখন মনে হলো মুক্তির পথ দিয়ে নাটক হাঁটছে। ভালো লাগে তখন নাটক যখন তার চেনা গন্ডী ধরে হাঁটছে।

চেনা আর অচেনাকে আমি দেখে নিয়েছি। নাটক সব সময়ই মানুষের কথা বলে। মানুষের ভালোবাসা, হিংসা, দ্বেষ সব সময়ই নাটকের বিষয় হয়েছে। অর্ক পারলেন। নাটকের পরতে পরতে কাহিনীর বৈচিত্র আমাকে দারুন ভাবে উদ্বেলিত করেছে।

নাটক তো মানুষের শরীরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। শরীর যখন কথা বলে তখনই নাটক হয়। আমাদের বাংলা নাটকতো গীতল। কী তার ভাষায়, কী তার গানে, কী তার সংলাপ বর্ণনায়। যাই হোক, ইউসুফ হাসান অর্ক নতুন কালের থিয়েটার নিয়ে হাজির হয়েছেন। কী তার চিন্তায় কী তার ব্যাখ্যায়। কী তার দ্বাদ্বিকতায়। সত্য হোক থিয়েটার।

যাদের নিয়ে আমরা কথা বলি। যারা অভিনয় করে মঞ্চ দাবড়ে বেড়ায়। তারাই মূল। তাদের বলাই তো মূল। বলতে যেয়ে আমরা চুপ থাকি। তাদের কথায় আসি।

‘পুণ্যাহ’ নাটকটিতে যারা অভিনয় করেছেন তাদের কথা না বললেই নয়।

যারা সুন্দর অভিনয় করে দিনকে রাত রাতকে দিন বানায়। নিজেকে সাজিয়ে নাটকের কাহিনী এগিয়ে চলে তারা হলেন অভিনেতা। ‘পুণ্যাহ’ নাটকে যারা অভিনয় করেছেনÑ তারা হলেন: ঝুনা চৌধুরী। ছোটবেলায় ইটের উপর বসে যার নাটক দেখেছি। তাঁর অভিনয়ের চলন ভালো। একবারও তিনি অতি অভিনয় করেননি। লেখায় সবাইকে নিয়ে লেখা পাতা আটকে যায়। যারা অভিনয় করলেন। ইকবাল বাবু। ইউসুফ হাসান অর্ক, শেখ মাহবুবুর রহমান, রামকৃষ্ণ মিত্র হিমেল, হাবিব মাসুদ, মনামী ইসলাম কনক, শহিদুল্লাহ সবুজ প্রমুখ।

‘পুণ্যাহ’ নাটকটি লিখেছেন বদরুজ্জামান আলমগীর মঞ্চ, সংগীত ও নির্দেশনাÑ ইউসুফ হাসান অর্ক। সহ নির্দেশনাÑ হাবিব মাসুদÑ আলোÑঅ¤øান বিশ^াসÑ পোষাকÑ খন্দকার সাজিয়া আফরিনÑ আলোক চিত্রÑ বারীণ ঘোষÑব্রæশিয়ার, স্মরণিকাÑ পংকজ নিনাদÑ প্রযোজনা উপদেষ্টাÑ তারিক আনাম খানÑ প্রযোজনা অধিকর্তাÑ ঝুনা চৌধুরী।

নাটক সত্যের কথা বলে। জীবনের কথা বলে। শরীরের চলনে-বলনে। সংগীতে সংগীতে। পুণ্যাহ হোক সবার। তাইতো পুণ্যাহ। আম্বিয়া তুমি হেরে যাওনি। বরং পুরুষ শাসিত সমাজে তুমি একজন প্রতিকী নারী। তুমি হেরে গেছো বলে তারা মিথ্যাবাদী। চলুক সত্যের সন্ধান। বাজিকর ইউসুফ হাসান অর্কের জয় হোক। অর্ক জিতে গেলে আমরা জিতে যাই। পূণ্য হোক ‘পুণ্যাহ’।


সব শেষে বলি, ইউসুফ হাসান অর্কের ‘পুণ্যাহ’র জয় হোক। প্রতি রাত্রিতে বাজিকর ইউসুফ হাসান অর্কের হাতের বাজি হোক ‘পুণ্যাহ’। অঙ্গুলিতে ফুটে উঠুক ‘পুণ্যাহ’।

(ওএস/এএস/জুন ১০, ২০২৪)