আবদুল হামিদ মাহবুব


মানুষই স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন বুনে বুনে সামনে এগোয়। আমি বলি, স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সে কারণে স্বপ্ন নিয়ে থাকতে চাই। স্বপ্নগুলো পূরণ করতে চাই। কিন্তু আমি চাইলেই কি আমার মনের স্বপ্নগুলো পূরণ হয়ে যাবে? আমার চারপাশের মানুষকে দেখবো তারা স্বপ্নের পিছনে ছুটছে? আমি দেশটাকে নিয়ে স্বপ্ন ধরে রাখতে চাই। সেই যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার স্বপ্ন, এই দেশটা হবে সোনার দেশ, মানুষগুলো হবে সোনার মানুষ।’ আমরা কি সোনার দেশ পেলাম? পেলাম সোনার মানুষ? সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের যে নজীর আমাদের সামনে উঠে এলো, তাতে কি দেশটা নিয়ে আশার কোনো স্বপ্ন নিয়ে এগোতে পারি?
পাঠক হয়তো বলবেন একজনের কু-কীর্তি কারণে সারাদেশের মানুষের উপর আশা হারানোর কি হলো? কিন্তু এই দেশে কত শত, বেনজীর আছে, সেটা তো দেখছি। ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে তারা দেশটাকে কিভাবে লুটে খাচ্ছে চোখকান খোলা কোনো নাগরিকেরই সেটা অজানা নয়। কোন এক দেশে ‘বেগম পাড়া’ হয়েছে। সেখানে কাদের বেগমরা আছেন? ব্যাংক লুট করে দেশের টাকা বিদেশে কারা কারা পাঠিয়েছেন? সবই দেশের মানুষই জেনেছেও, দেখেছেও।

এসব কারণেই উন্নয়ন অগ্রগতির স্বপ্ন নিয়ে ‘আশায়বসতি’ করা যাচ্ছে না। আমার চেনাজানাদের মধ্যে ইদানীং একটাই প্রবণতা দেখছি পালিয়ে বাঁচো। কোথায় পালাবে? দেশ ছেড়ে, দেশ ছেড়ে। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ আমিও কি এই সোনার বাংলা ছেড়ে পালাবো?

প্রতিদিন কত মানুষের সাথে দেখা হয়। কত-শত কথা হয়। সেরকমই এক দুটো কথা এখানে তুলে ধরছি। ক’দিন আগে তাড়া করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পুরোনো এক বন্ধুর সাথে দেখা। সে বললো দাঁড়াও কথা বলি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও দাঁড়ালাম। আমার এই বন্ধুটি এক সরকারি অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদ থেকে এলপিআরএ গিয়েছিলো। এখন পুরো অবসরে।

কথায় কথায় বন্ধুর কাছ থেকে জানলাম; পেনশন বেনিফিট, প্রভিডেন্ট ফান্ড, কল্যাণ তহবিলসহ আরো অন্যান্য মিলিয়ে কোটি টাকার উপরে পেয়েছে। জানতে চাইলাম, এখন সময় কি ভাবে কাটাবে? বন্ধুটি জানালো, চলে যাচ্ছি। প্রশ্ন করলাম, কোথায়? উন্নত বিশ্বের একটি দেশের নাম জানিয়ে বললো; ‘এইদেশে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নাই। তাই সবাইকে নিয়েই চলে যাচ্ছি। ওখানে থিতু হয়ে আসবো একবার। হয়ত তখন সহায়সম্পত্তিও বিক্রি করে দিয়ে সব নিয়ে যাবো।’ আমি বন্ধুটির মুখের দিকে চেয়ে থাকলাম। অনেকক্ষণ পর আমার মুখ থেকে বের হলো ‘ভালো থেকো, তোমার জন্য শুভ কামনা থাকলো।’

আমার মুখ থেকে বের হওয়া কথাগুলো কি আমার মনের কথা? নিশ্চয় না। এই বন্ধুটিই দেখি পরদিন মৌলভীবাজার বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালে এসে আমার সামনে বসলো। আমি এই হাসপাতালের যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে বিনাপারিশ্রমিকে গরীব মানুষের সেবামূলক কিছু কাজ করার চেষ্টা করি। আমি তাকে জিজ্ঞাস করলাম, কোনো কাজে কি এসেছো? বললো, তুমি আছো, তাই তোমার এখানেই এলাম। চোখটা পরীক্ষা করিয়ে যাই। ওই দেশে এসব পরীক্ষা নিরীক্ষায় নাকি অনেক খরচ। বন্ধুকে আমাদের এক পিয়ন সাথে দিয়ে ডাক্তারের কাছে পাঠালাম। পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে চশমার প্রেসক্রিপশন নিয়ে আসলো। তাকে বসিয়ে রেখেই চশমা বানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম।

তার বসে থাকা সময়টুকুতে আমি জানতে চাইলাম এই বৃদ্ধ বয়েসে তার বিদেশে যাওয়ার আসলেই কি প্রয়োজন আছে? সে বললো, আমার জন্য প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার সন্তানদের জন্য প্রয়োজন আছে। সে-ই বলে গেলো, ‘আমার সন্তানরা সবাই উচ্চ শিক্ষিতি হয়েছে। এইদেশে তাদের চাকুরী হচ্ছে না। আমি তাদের চাকুরীর ব্যবস্থা করতে পারছি না। সেই অর্থে আমি ব্যর্থ বাবা। তুমি বলবে, তাদের যোগ্যতায় তারা চাকুরীবাকুরী পাবে না। পাবে না। তুমি সাংবাদিক, তুমি এই দেশের অবস্থা জানো। আমি একটি অফিস চালিয়েছি। আমি দেখেছি চাকুরী কিভাবে হয়। আমি ঘুষ দিয়ে আমার ছেলে মেয়েকে চাকুরীতে ঢোকালে তারাও ঘুষ খাবে। ঘুষখোর হবে। তুমি বলো, আমি কি আমার ছেলে মেয়েকে ঘুষখোর বানাবো? আমি সততার সাথে চাকুরী শেষ করে ইজ্জত নিয়ে বের হয়ে এসেছি। আমার ছেলে মেয়েরা আমার ইজ্জতটুকু ধুলায় মিশাক আমি এটা চাইনা। সুযোগ যখন পেয়েছি, চলে যাচ্ছি।’

সে আরো বললো, ‘আমাদের ঘরে ঘরে অনার্স-মাস্টার্স করা ছেলে মেয়েরা এখন আবর্জনার মতো। তারা না পাচ্ছে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী পদের কাজ, না পারছে নীচের পদের কাজে যেতে। কিছু করতে না পেরে হতাশার মধ্যে থেকে জীবন পার করছে। সমাজ-রাষ্ট্র তাদের কথা ভাবছে? আমার মনে হয় না ভাবছে। ভাবলে এইদেশ এভাবে পরিচালিত হতো না। ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা কয়েকজন মেরে দিতে পারতো না। তুমিতো ক’দিন আগে ৫৫ হাজার টাকা উঠাতে গিয়েছিলে, ব্যাংক সেই টাকাও তোমাকে দিতে পারেনি। পত্রিকার নিউজে সেটা দেখেছি। আমি পেনশনের পর যে টাকা পেয়েছি, সেটা দেশের কোন ব্যাংকে রাখলে নিরাপদ থাকবে? কোনোখানেই নিরাপদ থাকবে না। তোমার মতো অবস্থা হতো। তাই বৈধপথ হোক, আর অবৈধ পথই হোক, যে দেশে যাচ্ছি সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। তুমি আমার দিকে না তাকিয়ে এদেশের কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সকল সচিব, সামরিক কর্মকর্তা, অধ্যাপক, ডাক্তার, বড় বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, এমন কি তোমাদের সাংবাদিকদের নেতাদের দিকে তাকাও। কতজনের সন্তান এই দেশে আছে?

বন্ধুটি আমাকে বললো, তুমিওতো তোমার ছেলেকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছো! এবার আমি বললাম, আমার ছেলেতো উচ্চ শিক্ষার জন্য (পিএইচডি) বৃত্তি নিয়ে গেছে। সে তার ডিগ্রিশেষ করে চলে আসবে। আমাকে কথা দিয়েছে। বন্ধু বললো, তোমার ছেলে আসলে পরে, আমাকে বলো। যে যায়, সে আর আসে না। আসবে কেনো? তোমার ছেলে পিএইচডি করে আসলে এদেশের কোনো ইউনিভার্সিটিতে চাকুরী হবে? -হবে না। এখানে যোগ্যতার কোনো মূল্য নেই। তুমি তো আওয়ামী লীগও করোনি, বিএনপিও করোনি। ছেলেকে দেশে আসার মন্ত্র দিয়ো না। ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এদেশে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ হয় লীগ আর দলের মাধ্যমে।

লম্বা বক্তৃতা করে বন্ধুটি বিদায় নিয়ে চলে গেলো। একটু পরে আমাদের প্রতিষ্ঠানের এক পিয়ন তার একটি আবেদনপত্র নিয়ে আসলো। তার আবেদনপত্র পড়ে দেখি, সে বিনা বেতনে এক বছরের ছুটি চেয়েছে। তার কাছে জানতে চাইলাম, কেনো সে একবছরের ছুটিতে যাবে? সে জানালো যুক্তরাজ্যের একটি ভার্সিটিতে মাস্টার্স পড়তে যাচ্ছে। আমি একটু রেগেই বললাম, এসএসসি পাসকে তারা মাস্টার্স পড়তে দিলো! জাল কাগজপত্র দিয়ে এটা করেছো কি না? সে আমাকে বললো, ‘স্যার, আমি অনেক আগেই মাস্টার্স পাস করেছি। আপনাদের এখানে মাস্টার্স পাসের সার্টিফিকেট দিলে অতিরিক্ত শিক্ষিত দেখে আমাকে পিয়নের চাকুরী দিতেন না। তাই তখন কেবল এসএসসি পাসের সনদ দিয়েছিলাম।

আমি আইএলটিএস পাস করে যুক্তরাজ্যে কয়েকটি ভার্সিটিতে আমার সকল কাগজপত্র দিয়ে আবেদন করি। একটি ভার্সিটি আমার আবেদন গ্রহন করে আমাকে কাগজপত্র পাঠায়। মাস্টার্স করতে মোট ১৪ হাজার পাউন্ড ফি লাগবে। আমি আমাদের জমি বিক্রি করে ৭ হাজার পাউন্ড ফিস পরিশোধ করে এডমিশনও নিয়ে নিয়েছি। আমার ভিসাও হয়ে গেছে। আমি ওখানে গিয়েতো পড়বো না। টাকা রুজির জন্য কাজ করবো, অথবা স্থায়ী হবার জন্য অন্য কোনো দেশে চলে যাবো। আর যদি সুবিধা করতে না পারি তা হলে ফিরে এলে যেনো চাকুরীটা পাই, তার জন্য এই ছুটি চাচ্ছি।’ তার কথা শুনে নিজেকে হতাশ লাগলো। আমাদের অনার্স-মাস্টার্সের কি মূল্য আমরা দিতে পারছি?

তার আবেদনপত্র খানা আমার পাশেই বসা আমাদের প্রতিষ্ঠানে অবৈতনিক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোসাহিদ আহমদ চুন্নুর হাতে দিয়ে বললাম, তাকে ছুটিটা দিয়ে দেন। পরে আরেকটু খোঁজখবর নিলাম। জানতে পারলাম, ইতোমধ্যে আমাদের এই হাসপাতাল থেকে আরো ছয়জন চাকুরী ছেড়ে যুক্তরাজ্য চলে গেছে। আরো অনেকে এই ভাবে যাওয়ার চেষ্টায় আছে। উল্লেখ্য যে, আমাদের প্রতিষ্ঠানে ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা,কর্মচারীসহ প্রায় দুইশজন কর্মরত আছেন।

চুন্নু ভাইয়ের টেবিলের চারপাশে ভিন্ন ভিন্ন পেশার আরো কয়েকজন বসা ছিলেন। আমরা সকলেই এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। একেকজন একেকভাবে বলছিলেন। আমি বললাম, সকল কিছুতেই আমার কাছে একটা অস্থিরতা লাগছে। সেখানে থাকা আয়কর আইনজীবী মকবুল হোসেন বললেন, ‘না আমি অস্থিরতা দেখি না। যারা অস্থির তারাই অস্থিরতা করছে। উত্থান পতন হবেই। সব যুগে ছিলো, এখনো আছে। এটা চলতেই থাকবে। গা-ভাসালেই ডুবে যাবার সম্ভাবনার মধ্যে পড়বেন। যারা দেশ ছাড়ার প্রবণতার মধ্যে পড়েছে তারা একদিন পস্তাবে। ব্রিটেনে এখন বাঙালিদের থার্ড জেনারেশন কেউ আর বাঙালি নেই!’

আয়কর আইনজীবী বললেন, ‘আমার এক ছেলে এক মেয়ে দু’জনকেই বলেছি বিদেশে যাবার নাম মুখে আনবে না। তোমার বাবা এখানে কিছু করে খাচ্ছে। তোমাদেরকে দেশেই কিছু করতে হবে। ডাক্তার ছেলেকে ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করিয়ে দিয়েছি। মেয়েও আইন বিষয়ে পড়ছে। সে ব্যারিষ্টারি ডিগ্রি নেওয়ার জন্য লন্ডন যাবে। ডিগ্রি নিয়ে ফিরে এসে এখানেই কিছু করবে। আমি আমার দুই সন্তান নিয়ে স্বপ্ন দেখি তারা যেনো এইদেশের মানুষের কাজে লাগে।’

তখন উপস্থিত সকলেই বললেন, ‘আমরাও আশাবদী হতে চাই। কিন্তু বাস্তবতা তো আমাদের হতাশ করে।’ তারপরও দেশ নিয়ে আমাদের স্বপ্ন ধরে (জিইয়ে) রাখতেই হবে। দেশটাতো আমাদেরই।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার, সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব।