মারুফ হাসান ভূঞা


পার্বত্য চট্টগ্রামের জনজীবনের গল্প অনেকটা অদৃশ্য, অদৃশ্য শাসন, শোষণে পরিচালিত। এই অদৃশ্য শাসন থেকে থেকে নানামুখী চাঞ্চল্য যুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম আমরা মাঝে মাঝে সংবাদে বিশেষায়িত হতে দেখি। এই বিশেষায়িত সংবাদ নিয়ে খানিকটা অস্থিরতা পূর্ণ হয়ে উঠে পুরো দেশ। যদিও এর বাহিরে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অপ্রাপ্তি কিংবা দুর্দশার সংবাদ বিশেষায়িত খুব একটা হয় না। বলা চলে সে সংবাদ আড়ালে পড়ে থাকে। এমন নিশ্চয়তা দিয়ে বলবার শক্তি সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো পর্যবেক্ষণ।

পাহাড়ে আজ পর্যন্ত যতগুলো হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তাঁর বিচার তো দূরে থাক অন্তত তদন্ত প্রতিবেদনটুকুও প্রকাশ হয়নি। পাহাড়ে হত্যা কাণ্ড যেন উৎসব কিংবা আমেজ। এখানে হত্যা কাণ্ড হয় কিন্তু এর বিচার হয় না। পাহাড়ে গত বছর বম জাতিসত্তার অন্তত ১১ জনকে হত্যার স্বীকার হতে হয়, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এই বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯ জন রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যার স্বীকার হতে হয়েছে। যার কোনোটির বিচার এখনো আলোর মুখ দেখেনি। উলটো হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীর সময়ক্ষেপণ ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠী সে আদিকাল থেকেই এখানে বঞ্চিত, একদিক তাদের ধর্ম, অন্যদিকে তাদের শারীরিক গঠন। যার কারণে এখানকার সাধারণ বাঙালি জনগোষ্ঠীর একটি অংশ পাহাড়ের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে বর্ণবাদী আচরণ করেন। শুধু এখানকার বাঙালি জনগোষ্ঠীর একটি অংশ না, এখানকার সেনাবাহিনী। ১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠী মুক্তভাবে যেন নিশ্বাস নিতেও পারছেনা। নিষেধাজ্ঞার একগাদা নীতিমালা অনুসরণ করতে বাধ্য করা হয় সাধারণ আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে। তৎকালীন সেনাবাহিনী ও উচ্ছৃঙ্খল সেটেলার বাঙালি জনগোষ্ঠী কর্তৃক, অসংখ্যবার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর আক্রমণ হয়। ১৯৮০, ১৯৯২, ১৯৯৬ বারবার হামলা, নির্যাতন, ঘরবাড়ি পোড়ানোরসহ ঘৃণিত কর্মকাণ্ড সংগঠিত করা হয়। নিরাপদ আদিবাসী নারীদের লাঞ্ছিত করা হয়, নির্যাতন নিপীড়নও করা হয়। যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত পর্যায়। শান্তি চুক্তি ও আলোচনার প্রেক্ষিতে কাগজের পাতায় সেনা শাসন কিছুটা শিথিল থাকলেও কিন্তু আদৌওতে পার্বত্য চট্টগ্রামে অঘোষিত সেনাশাসন জারি রয়েছে।

সম্পূর্ণ পার্বত্য অঞ্চল অস্থিরতাপূর্ণ করে একটা অদৃশ্য শাসনের ক্রিয়া ঘটানোর চেষ্টা অব্যাহত চলছে। সে চেষ্টার আশীর্বাদে পার্বত্য চট্টগ্রামে অঘোষিত সেনা শাসন অব্যাহত রয়েছে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভেতর ও মদদপুষ্ট বিশৃঙ্খল সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করে পাহাড়ে চাঁদাবাজি, হত্যাকাণ্ড, অপহরণ পরিচালিত হয়। যার ফলে অদৃশ্য শাসনের আয়ু দিনে দিনে কেবল বেড়েই চলেছে।

এই অদৃশ্য শাসনের সাথে যুক্ত পাহাড়ের হোটেল ব্যবসায়ীরা। পাহাড়ের অস্থিরতাকে মদদ দিয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর চাষাবাদের জমি দখল করে, আবাসভূমি উৎখাত করে বৃহৎ বৃহৎ হোটেল, রেস্তোরাঁ খুলছে। আর রমরমা ব্যবসা করছে। অর্থাৎ এমন ভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে নিপীড়ন করা হচ্ছে যাতে সে নিপীড়ন দৃশ্যমান না হয়।

সম্প্রতি পাহাড়ে কেএনএফের ব্যাংক ডাকাতি ও একজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে অপহরণ ও যৌথ বাহিনীর চেকপোস্টে হামলার পর সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী , যৌথ বাহিনীর সামান্য পরিমাণে অস্পষ্টার আশ্রয় নিয়েছে। পাহাড়ে কেএনএফের সাথে শান্তি আলোচনার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নিয়ে স্পষ্টভাবে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। কিন্তু কেএনএফের অভিযোগ সেনাবাহিনী ও সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী শান্তি আলোচনা লঙ্ঘন করেছে। কেএনএফের বিতর্কিত ৬ দফা দাবির সম্পূর্ণ সমর্থন পাহাড়ের আদিবাসী জনগোষ্ঠীরাও করছে না। কিন্তু সেনাবাহিনী কীসের ভিত্তিতে শান্তি আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ? কেএনএফ পাহাড়ের একটি বিচ্ছিন্ন সংগঠন। যে সংগঠনটিকে পাহাড়ি আদিবাসীরাও সমর্থন করছেন না। কেএনএফ মূলত একটি অদৃশ্য শক্তির ছত্রছায়ায় পাহাড়ে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালিত করছে। মূলত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের দাবি ও সংগ্রামকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে কেএনএফকে অদৃশ্য শক্তি প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করছে। শুধু কেএনএফ নয়, পাহাড়ে অনেক সন্ত্রাসী প্রক্সি সংগঠন রয়েছে যাদের অস্থিরতা তৈরি করে রাখার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

পাহাড়ি আদিবাসীদের একমাত্র দাবি ও সংগ্রাম হচ্ছে পাহাড়ের স্বায়ত্তশাসন। কেএনএফের আলাদা রাষ্ট্র কিংবা তাদের অযৌক্তিক ৬ দফা দাবির সাথে সম্পূর্ণ পাহাড়ের আদিবাসীদের দাবির সাথে কোন প্রকার মিল নেয়। তাহলে কি কেএনএফ কে শান্তি আলোচনার সুযোগে তাদের বিশৃঙ্খলা করার পথ খুলে দেওয়া হয়েছে? নাকি, কেএনএফের সাথে শান্তি আলোচনা ও কেএনএফের অপতৎপরতা পাহাড়ে অদৃশ্য শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়ার কৌশল?

কেএনএফের ব্যাংক ডাকাতি ও যৌথবাহিনীর চেকপোস্টে হামলার পরবর্তীতে যৌথবাহিনীর অভিযান ত্রুটিযুক্ত। কেএনএফ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের পরিবর্তে বম জাতিসত্তার সাধারণ জনগণকে হয়রানি ও গ্রেফতার করার অভিযোগ । বিভিন্ন কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, আনসার সদস্য জাতীয় জিমনাস্টিক দলের খেলোয়াড়, সামাজিক কর্মী যাদের সাথে কেএনএফের কোনো সম্পর্ক নেয়। তাঁদের মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে । গ্রেফতারের পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে বম জাতিসত্তার নারী,পরুষ সহ প্রায় ৫৩ থেকে ৫৯ জনকে আটক করা হয়েছে। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের পরিবারের দাবি কেএনএফের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেয়। তাহলে কেবল নামের শেষে বম রয়েছ, সে অপরাধে তাদের আটক করা হয়েছে? বান্দরবানে যৌথ বাহিনী রীতিমতো চেকপোস্ট বসিয়ে বম জাতিসত্তা অধ্যাসিত এলাকায় ৫ কেজির বেশি চাউল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী বাসায় নেওয়ার পথে হয়রানি, বাঁধা ও পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যা সম্পূর্ণ ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন।

অথচ আসল কেএনএফ সন্ত্রাসীরা যারা ব্যাংক ডাকাতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিল, তাঁরা ধরা-ছোয়ার বাহিরে, এদিকে সাধারণ বম জাতিসত্তার নাগরিকদের হয়রানি, গ্রেফতারের স্বীকার হতে হচ্ছে। যা যৌথবাহিনীর প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড কে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

সুতরাং এই পরিস্থিতিতে সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ত্রুটিযুক্ত রাজনৈতিক সংলাপ না করে, পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিরতা নিয়ে স্পষ্টত সমাধানের পথ নিশ্চিত করুন। নিরীহ বম জাতিসত্তার নিরীহ নাগরিকদের মুক্তি দিয়ে, বান্দরবানে যৌথ বাহিনীর হয়রানি বন্ধের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান রইলো।

পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের শুধু দীর্ঘদিনের দাবি না, এটা একটা সম্পূর্ণ একটা অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃখ-দুর্দশা, অত্যাচার- নির্যাতন থেকে মুক্তির সংগ্রাম। এইটি বাস্তবায়নের পথে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। দায়িত্বের সাথেই নিতে হবে। এছাড়া সরকার যদি অবহেলা কিংবা এড়িয়ে যাবার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে। আর এতে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা বাড়বে যে এমনটি নয়, সমগ্র দেশেও এর প্রভাব পড়বে।

লেখক : কলামিস্ট ও লেখক।