স্টাফ রিপোর্টার : গেলো তিন বছরে দেশে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষার্থী বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ। মাদ্রাসার শিক্ষকদের ভাষ্য, ‘আগে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থী খুঁজতে হতো, কিন্তু এখন এমনিতেই মাদ্রাসায় অনেক শিক্ষার্থী আসছে।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে যেমন মাদ্রাসায় সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে, তেমনি  ধর্মীয় কারণে অনেকে মাদ্রাসা শিক্ষায় আগ্রহী। অর্থনৈতিক সংকটময় পরিস্থিতি দীর্ঘ হওয়ার সঙ্গেও মাদ্রাসা শিক্ষায় আগ্রহ বাড়ার যোগসূত্র দেখছেন শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ।

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো- ব্যানবেইসের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী ছিল ২৪ লাখ ৯১ হাজার ২৬৮ জন। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ লাখ ৫৮ হাজার ৫০৪ জনে। অর্থাৎ চার বছরের ব্যবধানে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বেড়েছে ২ লাখ ৬৭ হাজার ২৩৬ জন। একই সময়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৯২ লাখ ৩ হাজার ৪২৭ জন থেকে কমে শিক্ষার্থী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮১ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৮ জনে। অর্থাৎ চার বছরে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ২৩৯ জন শিক্ষার্থী কমেছে মাধ্যমিকে স্কুলে।

গত ২৪ মার্চ প্রকাশিত পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স ২০২৩’-এও সাধারণ শিক্ষার বিপরীতে মাদ্রাসা শিক্ষার পরিসর বাড়ার চিত্র এসেছে। তাতে দেখা যায়, শেষ তিন বছরে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষার্থী কমলেও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষার্থী বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের ২০২২ সালের এক গবেষণা দেখা যায়, কোভিডের সময় দেশে যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমেছে, তখন মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী ভর্তির হার বেড়েছে। মহামারীতে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে দেড় বছর দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘করোনার সময় থেকেই মানুষের আয় কমে গেল। অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়ল। পড়াশোনার খরচ অনেকে বহন করতে পারছিল না। সেই জায়গাটায় ভারসাম্য আনতে বাবা-মায়েরা তার ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে মাদ্রাসায় দিয়ে দিল। অনেক মাদ্রাসায় থাকা-খাওয়ার সুবিধা থাকে। এতিমখানা থাকে। দিনমজুর বাবা-মার জন্য এসব মাদ্রাসা ডে কেয়ারের মত কাজ করে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই এমিরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, আবাসিক ব্যবস্থা থাকায় অনেক মাদ্রাসায় করোনাভাইরাসের সময়ও শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পেরেছে। আর সাধারণ শিক্ষায় দরিদ্র পরিবারগুলোকে সহায়তার সুযোগ না থাকায় তারা মাদ্রাসা শিক্ষায় ঝুঁকছে।

মাদ্রাসায় পড়ালে সন্তান মুসলিম ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ নিয়ে বড় হবে- এমন চিন্তা থেকেও মাদ্রাসায় শিক্ষাথীরা সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করছেন কোনো কোনো শিক্ষক। হবিগঞ্জের মাধবপুরের ইটাখোলা সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আমির হোসেন বলছেন, ‘মুসলিম সেন্টিমেন্ট’ থেকে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের ভাবনা অনেককে মাদ্রাসা শিক্ষায় উৎসাহিত করছে। অভিভাবকদের অনেকে চিন্তা করছে, মাদ্রাসায় পড়ালে তার সন্তান মুসলিম ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ নিয়ে বড় হবে।”

ফেনীর আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ফারুক আহমদ মনে করেন, সুযোগ-সুবিধা বাড়ার উচ্চ শিক্ষা ও চাকরিতে সম্ভাবনা বাড়ায় অনেকে মাদ্রাসামুখী হচ্ছে। ধর্মীয় আগ্রহ বাড়া ও অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হওয়াকেও বিবেচনায় আনতে বলছেন তিনি।

খুলনার পাইকগাছার গজালিয়া কালুয়া আলিম মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবুল কাশেম বলেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জন্য সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন মাদ্রাসার শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে তারা আরও ভালোভাবে শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারে।’

গাজীপুরের কাপাসিয়ার চেংনা বালিকা দাখিল মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা এখন মাদ্রাসাতেই কম্পিউটার শিখতে পারছে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান সম্পর্কে শেখার সুযোগ পাচ্ছে।’

মাদ্রাসায় সুযোগ-সুবিধাও আরও বেড়েছে। ব্যানবেইসের গুণমান নির্দেশক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, স্কুলের তুলনায় মাদ্রাসায় প্রশিক্ষিত শিক্ষক অনেক কম। তবে গত চার বছরে স্কুলের মতই মাদ্রাসায় প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় পাঁচ শতাংশ। ২০১৯ সালের ৮৭ দশমিক ৩২ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন ৮৮ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ স্কুলে কম্পিউটার সুবিধা রয়েছে। অন্যদিকে ২০১৯ সালে ৮২ দশমিক ৯৫ শতাংশ মাদ্রাসায় কম্পিউটার সুবিধা ছিল, সেটি বেড়ে হয়েছে ৮৪ দশমিক ২১ শতাংশ।

(ওএস/এসপি/এপ্রিল ০২, ২০২৪)