শিতাংশু গুহ


এ আনন্দ-উৎসব হিন্দু বিদ্বেষ থেকে উৎসারিত। ভারত-বিদ্বেষ যা মূলত হিন্দু বিদ্বেষ, এ উপমহাদেশে মজ্জাগত, আপাতত: এ থেকে বেরিয়ে আসার কোন সুযোগ নেই? এজন্যে পাকিস্তান হিন্দু-শূন্য, বাংলাদেশ হিন্দু-শূন্য হবার পথে। অষ্ট্রেলিয়া যোগ্য দল হিসাবে ভাল খেলে জিতেছে, তাঁদের অভিনন্দন। ভারত শক্তিশালী দল, অপরাজিত ছিলো, হেরেছে ফাইনালে। খেলা হচ্ছে, ‘হারি-জিতি’ নাহি লাজ, ভারতবাসী দুঃখ পেয়েছে, কিন্তু অষ্ট্রেলিয়াকে অভিনন্দন জানাতে ভুল করেনি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে ভারতের পরাজয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে। না, এটি কোন গোপন বিষয় নয়, বাংলাদেশের দর্শক প্রকাশ্যেই বলেছেন, ভারত হারায় তাঁরা ঈদের আনন্দ উপভোগ করছেন।

‘দি নিউজ-বাংলা’ হেডিং করেছে, ‘ভারতের হার, বাংলাদেশে উৎসব’। একজন জাহাঙ্গীর আলম সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “মানুষ এত ‘বে-ইমান’ হয় কি করে, শুধুই ধর্মের জন্যে—ছিঃ বাংলাদেশ ছিঃ”? তাঁর পোষ্টে একজন ভারতীয় শুভাশীষ ভট্টাচার্য্য লিখেছেন, ‘যেকেউ অষ্ট্রেলিয়াকে সাপোর্ট করতেই পারে, কিন্তু কারণ জানতে চাইলে বলা হলো, ভারত মুসলিম রাষ্ট্র নয়! অস্ট্রেলিয়াও তো মুসলিম রাষ্ট্র নয়, তাহলে? ভারত হিন্দু। বিষয়টি ভারত নয়, বিষয়টি হিন্দু, এক্ষেত্রে ভারত-হিন্দু সমার্থক। ভদ্রলোক লিখেছেন, বিষয়টি পরিষ্কার, এন্টি-হিন্দু। ভারতের টীমে মোহাম্মদ সামি, সিরাজ আছে, তাঁরা চমৎকার খেলেছেন, তাহলেও হবেনা, হিন্দুর সাথে থাকলে চলবে না?

তামান্না তাবাস্সুম মিথিলা সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ইন্ডিয়া সব ম্যাচে জিতেছে, একটিতে হারলে সমস্যা নেই! তাঁর পোষ্টে একজন শাহরিয়ার নাসিফ একটি উধৃতি দিয়েছেন, ভারত ১০টি জিতেছে, ১টি হেরেছে অর্থাৎ ‘চোরের দশদিন, গৃহস্থের একদিন’। ‘আরকি’ নামের একটি পোর্টাল ছবির আকারে একটি বক্তব্য দিয়েছে, তাতে লেখা, ‘ইন্ডিয়া হেরে যাওয়ার খুশিতে চিৎকার করতে গিয়ে বড়ভাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাঁকে উন্নত চিকিসার জন্যে ভারত নেয়া হচ্ছে’। মো: শাহরুখ ইসলাম এবং আরো অনেকে টিটকারী করে বলেছেন, ‘হে প্রভু, হরি, কৃষ্ণ, জগন্নাথ, প্রেমানন্দ, ‘এ কেয়া হুয়া’। হিন্দুরা বলেছেন, এরপরও তো ওঁরা কৃষ্ণ নাম নিচ্ছে! একজন আরিফুজ্জাম লিখেছেন, ‘ধর্মের ঢোল আপনি বাজে’।

ভারত-পাকিস্তান খেলায় অধিকাংশ বাংলাদেশী পাকিস্তানকে সমর্থন করে, এর হয়তো একটি কারণ থাকতে পারে, কিন্তু ভারত-অষ্ট্রেলিয়া ফাইনালে ভারতের পরাজয়ে এ উল্লাস অনেকাংশে ‘বিজাতীয়’। হিন্দু বিদ্বেষ, ভারত বিদ্বেষ ব্যতিত আর কি কারণ থাকতে পারে? নিউইয়র্কে একটি টক-শো তে দু’জন জানালেন, হয়তো এর কারণ ভারতের দাদাগিরি, ভারত বাংলাদেশ থেকে সবকিছু নিয়ে যাচ্ছে, অথবা বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রতি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের বিমাতা-সুলভ আচরণ? যদিও একজন সম্পাদক শেষের বক্তব্যটি প্রমানসহ নাকচ করে দিয়েছেন! কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের মিডিয়ায় এনিয়ে কোন আলোচনা নেই, কেউ কোন কলাম লিখেনি, কারণ মনে মনে সবাই খুশি!

কেউ যদি বলেন, ভারত হারায় এ উচ্ছাস সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বৈ কিছু নয়, তাহলে এঁরা আপনাকে সাম্প্রদায়িক বানিয়ে দেবে এবং ‘চোরের মা’র বড় গলা’ হাঁকিয়ে বলবে, ‘খেলার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা টেনে আনবেন না’! সন্ত্রাসের কথা উঠলেও এঁরা বলেন, ধর্মের সাথে সন্ত্রাসের কোন সম্পর্ক নেই? জিজ্ঞাসা করুন, খেলার মাঠে নামাজ পড়েছিলো কারা? বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। এটি করে ধর্মের কি লাভ হয়েছে জানিনা, তবে খেলায় জয় আসেনি। এর নিট ফলাফল সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উস্কে দেয়া- যার পরিণতি ভারত বিদ্বেষ, যার উলঙ্গ প্রকাশ ভারতের পরাজয়ের পর সাম্প্রদায়িক উল্লাস। এর বিরূপ প্রভাব পূর্ব-ভারতে পড়েছে, হয়তো আরো পড়বে। সাবেক গভর্নর ড: তথাগত রায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশ অকৃতজ্ঞ, ফের এর প্রমান দিলো’।

একজন চমৎকার একটি হাইপোথিটিক্যাল প্রশ্ন করেছেন, তিনি জানতে চেয়েছেন, ফাইনাল খেলাটি যদি ভারত ও ইসরাইলের মধ্যে হতো, এবং ইসরাইল জিততো, তাহলে বাংলাদেশীরা কি করতেন? আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, আমরা খেলাটি ‘বয়কট’ করতাম। এক ভারতের জ্বালায় বাঁচিনা, এর ওপর ইসরাইল!

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।