চৌধুরী আবদুল হান্নান


বিভিন্ন দেশে কর্মরত এক কোটি ত্রিশ লক্ষাধিক প্রবাসীর মধ্যে অধিকাংশই গরিব, মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, অমানষিক কায়িক পরিশ্রম করেন তারা। চল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সৌদি আরবের খেজুর বাগানে কাজ করা যে কতটা কষ্টের তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারেন।

একটি তথ্যমতে, প্রতি বছর তাদের মাধ্যমে বৈধ চ্যানেলে ১৫০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে দেশে আর হুন্ডির মাধ্যমে যে অর্থের আগমন ঘটে তার পরিমানও কম নয়।

ধার-দেনা করে, জমি-জমা বন্ধক রেখে তারা ভাগ্য পরিবর্তনের আশা নিয়ে অজানা দেশে পাড়ি জমান, পদে পদে বিপদের আশঙ্কা, ভুয়া এজেন্সি, দালাল চক্র কত কি! অনেক সময় জীবন বাজি রেখে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে তারা সাগর-মহাসাগর পাড়ি দেন।

তাঁদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা যখন দেশের রিজার্ভে জমা হতে থাকে, তখন তাঁরা আমাদের “সোনার ছেলে”।

তাঁদের বিদেশ গমন সহজ করা, সেখানে কর্মক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের আচরণ এবং অন্যান্য প্রতিকূলতার বিষয়ে স্থানীয় দূতাবাসগুলোর সহানুভূতিশীল নজর বৃদ্ধি করা হলে তাদের প্রতি আমাদের কিছুটা হলেও দায়িত্ব পালন করা হবে।

অথচ এক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিদেশে কর্মক্ষেত্রে কেউ মারা গেলে অনেক সময় অর্থাভাবে মরদেহ দেশে আনা সম্ভব হয় না, অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি কোনো অনুদান পাওয়া যায় না। একজন প্রবাসী আক্ষেপ করে বলেন, যতদিন জীবিত আছি ততদিনই আমরা অর্থনীতির চালিকাশক্তি। বিদেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেই বোঝায় পরিণত হন প্রবাসী কর্মীরা।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বাইরে আর একটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বড় খাত হলো তৈরি পোষাক রপ্তানি। এ শিল্পে কর্মরত ৪০ লক্ষাধিক শ্রমিক যারা সকলেই দরিদ্র শ্রেনীভূক্ত ও শিক্ষা বঞ্চিত।

অতএব, দেখা যাচ্ছে প্রকৃত পক্ষে সমাজের খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষেরা দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মূল ভূমিকা পালন করছেন।

পক্ষান্তরে উচ্চবিত্ত ধনিক শ্রেনী দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করে দেশকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। অর্থনীতিকে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিয়ে প্রতি বছর কত টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে আছে বলে কেউ মনে করে না, তবে মাঝে মাঝে কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়।

ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টগ্রিটি এর এক রিপোর্টে জানা যায়, এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ৪ (চার) লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানিতে সুচতুর কারসাজি করে এবং হুন্ডির মাধ্যমে মূলত অর্থ পাচার হয়ে থাকে।

অর্থ পাচারকারীদের “বেইমান ও দুর্বৃত্ত” সম্বোধন করে হাইকোর্ট বলেছেন—“উন্নয়নের জন্য অর্থ পাচারও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে; অর্থ পাচারকারীরা দেশ ও জাতির শত্রু।”

অর্থ পাচারকারীরা তো আন্তর্জাতিক নাগরিক, অপরাধ জগতেও প্রভাবশালী। তারা এতটাই ক্ষমতাশালী যে কোনো শক্তি তাদের পাকড়াও করতে পারে, মানুষ তা বিশ্বাস করে না।

সেক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতি রক্ষা করতে এ সকল “বেইমান ও দুর্বৃত্ত”কে আইনের জালে আটকানো যায়কীভাবে ?

সব ডাকাতকে এক সাথে বিচার করতে গেলে তা হবে মৌচাকে ঢিল মারার মতো, তাতে বিচার ব্যবস্থাই নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে।

তা হলে কী করণীয়? একটু বুদ্ধি খাটাতে হবে, কেবল চেয়ে চেয় প্রলয় না দেখে একটু নড়েচড়ে বসতে হবে, অন্যথায় অর্থপাচারের বিষক্রিয়া নিজেকেও আক্রান্ত করবে।

এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, “রাজনীতিবিদরা নয়, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারী কর্মকর্তারা।”

এখান থেকেই কাজটা শুরু করা যায়, ঘর থেকে শুরু করার আলাদা একটা গ্রহণযোগ্যতা থাকে। সরকারি কর্মকর্তারা কোথায় কত টাকা পাচার করেছেন, কোন দেশে কয়টি বাড়ি আছে এমন কর্মকর্তাদের তালিকা নিশ্চয়ই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে রয়েছে। তাছাড়া, আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির যুগে এসব তথ্য খুঁজে বের করা মোটেই অসম্ভব নয়।

তারা সরকারের বেতন-ভাতা ভোগ করবেন আর দুর্নীতির মাধ্যমে পাহাড় সমান বিত্ত বৈভবের মালিক হবেন, বিদেশে অর্থ পাচার করবেন তা মানা যায় না। তাদের আটকানো তো কঠিন কাজ নয়; এই সহজ কাজটা দিয়েই শুরু করি না কেন? শুরুটা তো হোক, শুরু না করলে শেষ হবে কীভাবে?

অন্যদিকে নিশ্চিত করে বলা যায়, অন্তত দুটি খাতের (প্রবাসী ও রপ্তানি) প্রতি একটু বাড়তি নজর দিলে দেশের রিজার্ভ সংকট নিয়ে দুর্ভাবনার মাত্রা কমে আসবে এবং আইএমএফ আর বিশ্বব্যাংকের কাছে ঋণসহায়তার জন্য ধন্না দিতেও হবে না।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।